এম এ জলিল


সবধর্মের মানুষদের শিক্ষিত জাতি হিসেবে গড়রার জন্য মহাত্মা অশ্বিনি কুমার দত্ত বরিশালে বিএম স্কুল এন্ড কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। উপমহাদেশের শিক্ষার দূত, শ্রমিক কৃষক ছাত্র জনতার প্রিয় নেতা নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের মুক্তিরদাতা শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক ও ভারতেশ্বরী হোম স্কুল কলেজ ও হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা মানব কল্যাণে কাজ করেছেন। এই তিন মহান কৃতিমান ব্যক্তিদের আদর্শ অনুসরণ করে কাজ করেছিলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ।

ফজলে হাসান আবেদ জন্ম গ্রহণ করেছেন ইংরেজ শাসন শোষন এর আমলে ২৭ই এপ্রিল ১৯৩৬ সনে বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং গ্রামে। পিতা সিদ্দিক হাসান ভূস্বামী ছিলেন ও মাতা সৈয়দা সুফিয়া খাতুন, তার পূর্ব পুরুষরা জমিদার ছিলেন। স্যার ফজলে হাসান আবেদ শিক্ষা জীবন শুরু করেন, হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। তিনি ৩য় ও ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখা পড়া করেন এই বিদ্যালয়। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই তার পিতা অসুস্থ হয়ে যায় এবং গ্রামের বাড়ীতে এসে জীবন যাপন করেন। পিতার অসুস্থ্যতার কারনে সেই মুহুর্তে ফজলে হাসান আবেদ তার চাচার কাছে চলে আসেন এবং কুমিল্লা জিলা স্কুলে ভর্তি হন। তিনি সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানেই লেখাপড়া করেন। তার চাচা জেলা জজ ছিল।

চাচার জজের চাকুরীর কারণে কুমিল্লা থেকে পাবনায় বদলী হন। জনাব আবেদ তার চাচার সাথে যান এবং পাবনা জিলা স্কুলে ভর্তি হন। পাবনা জিলা স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর তিনি ব্রিটেনের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় নৌ স্থাপত্যে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু সেটা বাদ দিয়ে লন্ডনের চার্টার্ড ইনষ্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট একাউন্টট্যান্টসে ভর্তি হয়। চার্টার্ড পাস করার পর সেখান থেকে স্যার ফজলে হাসান আবেদ ১৯৬২ সনে দেশে ফিরে আসেন এবং শেল কোম্পানীতে চাকুরী নেন। তার নিষ্ঠা একাগ্রতা দেখে কোম্পানীর কর্মকর্তারা তাকে দ্রুত পদন্নোতি দেন। এবং ফাইন্যান্স বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পায়। তিনি তার মেধা দিয়ে সামনে চলতে থাকেন।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তা চলছিলো বিরামহীনভাবে। ১৯৭০ শেলে চাকুরীরত অবস্থায় তার সহপাঠী ও বন্ধুদের সঙ্গে নিয়া হেল্প নামের একটি সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলেন। ৭০ এর ১২ই নভেম্বরে ঘুণিঝরে বৃহত্তর বরিশাল ও নোয়াখালীতে ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ১০ লক্ষ লোক মারা যায়। ঐ অঞ্চলে ধন-সম্পদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা আজও পূরণ হয় নাই। সেই সময় তিনি ঘুর্ণিঝরে ক্ষতিগ্রস্থদের সেবা ও পুনর্বাসন করেন। সেবা ও পুনর্বাসনের অঞ্চল ছিল ভোলা জেলা মনপুরায়। ৭০ এর নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধুর কাছে পাকিস্তানী সামারিক শাসক ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টোর যোগসাজসে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র জনগণের উপর সশস্ত্র আক্রমন করেন।

এই আক্রমনের কারণে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দেন। এই আহ্বানের সাড়া দিয়ে স্যার ফজলে হাসান আবেদ য্ক্তুরাজ্যে চলে যান এবং য্ক্তুরাজ্যসহ ইউরোপের সব দেশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করেন এবং বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য অর্থ তহবিল সংগ্রহ করেন। ফজলে হাসান আবেদ বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে অ্যাকশন বাংলাদেশ ও হেলফ বাংলাদেশ নামে দু’টি সংগঠনের জন্মদেন লন্ডনে। এই সংগঠন দু’টির লক্ষ ও উদ্দেশ্য হলো ভারতে যারা শরণার্থী হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতেছেন তাদের সাহায্য সহযোগিতার জন্য। নয় মাসের যুদ্ধের মাধ্যমে প্রবাসী মুজিব নগর সরকারের নেতৃত্বে ১৯৭১ সনে ১৬ইং ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়।

স্বাধীনতার পরপরই ভারত থেকে শরণার্থীদের বাংলাদেশে আগমন ঘটে। এই শরণার্থীদের সেবা করার লক্ষ্যে এবং পুনর্বাসনের জন্য সুনামগঞ্জের শাল্লা এলাকায় ফজলে হাসান আবেদ বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি সংক্ষেপে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৭২ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্যার ফজলে হাসান আবেদ ও ব্র্যাক একাকার হয়েছে। ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার লক্ষ হলো দারিদ্র বিমোচন ও দারিদ্র নারীদের ক্ষমতায়ন। ব্র্যাক বর্তমানে বিশে^র সেরা এবং একটি সবচেয়ে বড় বেসরকারি সেবা সংস্থা বা এনজিও। এশিয়া ও আফ্রিকার ১১টি দেশে ব্র্যাক এখন কাজ করছে। জেনেভা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এনজিও এডভাইজিং বিশ্বের শীর্ষে থাকা সেরা ৫০০টি এনজিও মূল্যায়ন করে বলেছে প্রভাব, সৃজনশীলতা ও টেকসই হওয়ার বিচারে বিশ্বের সেরা এনজিও ব্র্যাক।

দারিদ্র বিমোচন কাজে বাইরে ব্র্যাক জরুরী ত্রাণ সহায়তা, লিঙ্গসমতা সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নগর উন্নয়ন, মানবাধিকার সবক্ষেত্রে কাজ করেছে স্যার ফজলে হাসান আবেদ। স্যার ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাকের সহায়ক যে সব প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন মানবজাতির জন্য সেগুলি হলো- ব্র্যাক বিশ^বিদ্যালয়, ব্র্যাক ব্যাংক, মোবাইল ব্যাকিং প্রতিষ্ঠান বিকাশসহ বেশকিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে ছিলেন ব্র্যাক ঘিরে। এর মধ্যে আছে আড়ং, ব্র্যাক ডেইরী, ব্র্যাক চিকেন, ব্র্যাক ফিসারিজ, ব্র্যাক নার্সারী, ব্র্যাক প্রিন্টিং, ব্র্যাক সিল্ক, ব্র্যাক লবণ, ব্র্যাক স্যানিটারী ন্যাপকিন এন্ড ডেলিভারী কীট ও ব্র্যাক সীড সহ অনেক প্রতিষ্ঠান।

যার মাধ্যমে গরীব সাধারণ মানুষদের কর্মসংস্থান হয়েছে বিশেষভাবে অসহায় নারীদের কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়ন হয়েছে। দেশের বাইরে ও দেশে স্যার ফজলে হাসান আবেদ কে তার সেবার জন্য অনেক স্বীকৃতি দিয়েছে। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণ সম্মানিত হয়েছে। স্যার ফজলে হাসান আবেদ দেশে ও বিদেশে যে সব সম্মাননা পেয়েছেন সেই সবের মধ্যে ১৯৮০ সালে র‌্যামন ম্যাগসাইসাই অ্যাওয়ার্ড ফর কমিউনিট লিডারশীপ লাভ করার মাধ্যমে তার বিশ্বখ্যাতী অর্জনের সূচনা হয়। এরপর সুনাম সুখ্যাতি পুরষ্কার উপাধি পান মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

১৯৮৫ সালে ইউনেসকো নোমা পুরষ্কার, ১৯৯০ সালে অ্যালানশন ফেইনষ্টাইন ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার পুরষ্কার পায়, ১৯৯২ সালে ইউনিসেফ মরিস পেট অ্যাওয়ার্ডে ভুষিত হন, ২০০১ সালে ওলফ পামে অ্যাওয়ার্ড পান, ২০০২ সালে দ্য শোয়াব ফাউন্ডেশন সোস্যাল এনট্রারপ্রেনিউরশিফ অ্যাওয়ার্ড পুরষ্কার, ২০০৩ সালে গ্লেইটসম্যান ফাউন্ডেশন পুরষ্কার, ২০০৪ সালে গেটস অ্যাওয়ার্ড ফর গ্লোবাল হেলথ পুরষ্কার ও মানব উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য ইউএনডিপি মাহবুবুল হক অ্যাওয়ার্ড, ২০০৭ সালে ক্লিনটন গ্লোবাল সিটি জেনশিপ অ্যাওয়ার্ড ও হেনরি আর ক্রাভিস প্রাইস ইন লিডারশীপ অ্যাওয়ার্ড ও দারিদ্র দূরীকরণ ও সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (বিকেএসএফ) আজীবন সম্মাননায় ভুষিত হন, ২০০৮ সালে স্যার ফজলে হাসান আবেদ ডেভিড রকফেলার ব্রিজিং লিডারশীপ অ্যাওয়ার্ড পান, ২০১০ দারিদ্র বিমোচনে অসাধারণ অবদানের জন্য স্বীকৃতি হিসেবে স্যার ফজলে হাসান আবেদকে যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মানজনক নাইটহুট উপাধীতে ভুষিত করেন এর মাধ্যমে তিনি স্যার উপাধী লাভ করেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখায় কাতার ফাউন্ডেশন ওয়াইপ্রাইজ লাভ করেন ২০১১ সালে।

স্যার ফজলে হাসান আবেদ সবচেয়ে বড় পুরষ্কারটি পেয়েছেন চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে শিক্ষার অসামান্য অবদান রাখার জন্য ‘‘ইদান” পুরষ্কার যার অর্থমূল্য বাংলাদেশের টাকার ৩৩ কোটি। এই পুরষ্কারটি শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশে^র বড় স্বীকৃতি পুরষ্কার। পুরষ্কারটি দিয়েছেন হংকংএর ইদান প্রাইজ ফাউন্ডেশন। ২০০৮ সালে মানবিক ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ব্র্যাক বিশ্বের সর্ববৃহৎ পুরষ্কার কনরাড এন হিলটন হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাওয়ার্ডে ভুষিত করা হয়।

২০১৩ সালে হাঙ্গেরির সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ন ইউনিভার্সিটি থেকে ওপেন সোস্যাইটি প্রাইজ লাভ করেন, খাদ্য ও কৃষিক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৫ সালে তাকে দেওয়া হয় ওয়ার্ল্ড ফুডপ্রাইজ ও ২০১৬ বিশব্যাপী দারিদ্র মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কার্যক্রম পরিচালনা করার করার জন্য স্যার ফজেল আসান আবেদন টমাস ফ্রন্সিস জুনিয়র মেডেল অব গ্লোবা পাবলিক হেলথ পদক লাভ করেন। এছাড়া আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অশোকা স্যার ফজলে হাসান আবেদকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি স্বীকৃতি দিয়েছেন।

বিশ্বের শীর্ষ ফরচুন ম্যাগাজিন স্যার ফজলে হাসান আবেদকে বিশ্বের শীর্ষ প্রভাবশালী ৫০ ব্যক্তিত্বের অন্যতম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এবছর নেদারল্যান্ডের রাজা স্যার ফজলে হাসান আবেদকে নাইটহুট উপাধি দিয়েছেন। স্যার ফজলে হাসান আবেদ এর সকল গৌরবের ভাগিদার বাংলাদেশের জনগণ ও বাঙালি জাতি। যিনি মানবতার পক্ষে কাজ করে জাতির ধর্ম বর্ণ গোত্র সবার প্রশংসা পেয়েছেন সেই মানুষটি স্যার ফজলে হাসান আবেদ। বাংলাদেশের সর্বোচ্চা রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার ‘‘স্বাধীনতা পুরষ্কারটি পেয়েছেন ২০০৭ সালে।

ফজলে হাসান আবেদ ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর ঢাকায় এ্যাপোলো হাসপাতালে মাথায় টিউমার জনিত রোগে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে জাতি যে কৃতিমান পুরুষকে হারিয়েছে, সেই ক্ষতি পুরণ হবার নয়। আর যদি আমরা তার কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করতে পারি বিশেষভাবে শিক্ষাকে। আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশের প্রাইমারি শিক্ষাস্তরে প্রথম শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত ভাষাজ্ঞানে পারদর্শী করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশের মানুষ তাদের নব দিগন্ত সৃষ্টি করতে পারবে। (বাঙালিদের মাতৃভাষা বাংলাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে শিক্ষা দিতে হবে।

এরপর আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজীকে ও আরবী ভাষাকে পারদর্শী করতে হবে এবং যোগ বিয়োগ ভাগ পূরণের মাধ্যমে ছাত্রদেরকে পারদর্শী করতে হবে। তবেই ফজলে হাসান আবেদ এর আত্মার শান্তি পাবে। সাথে সাথে বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বের যেখানেই যাবেন সেখানেই সম্মান কুড়িয়ে আনবেন। কারণ তিনটি ভাষায় পাদর্শী হওয়ার জন্য।

লেখক: এম এ জলিল, সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় গণন্ত্রিক লীগ।