রূপক মুখার্জি, নড়াইল : বিদ্যালয়ের একমাত্র পুরাতন আধাপাকা টিনশেড ঘরটি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। সেখানে উঠছে বিদ্যালয়ের নতুন ভবন। আপাতত ক্লাস নেওয়ার জন্য একটি টিনশেড ঘর তৈরি করতে কার্যাদেশে ছিল। সেটি ঠিকাদার করে দেয়নি। নয় মাসে নতুন ভবন তৈরির কাজটি শেষ করার কথা। তার মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ৩ জানুয়ারি। কেবল হয়েছে ভিত ঢালাই।

এ অবস্থায় গত আট মাস ধরে ক্লাস হচ্ছে বিদ্যালয় চত্বরে গাছতলায় ও জরাজীর্ণ ছাপড়ায়। এতে বিপাকে পড়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। স্থানীয় এলাকাবাসী ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, ঠিকাদারের, অনিয়ম, দুর্নীতি ও গাফিলতির জন্য এ অবস্থা। দ্রুত ভবন করতে হবে, না হলে শিক্ষার কোনো পরিবেশ নেই।

এ অবস্থা নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার শালনগর ইউনিয়নের ভদ্রডাঙ্গা গ্রামে অবস্থিত ২৭ নম্বর বাতাসি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের।

বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৫০ সালে স্থানীয় সাত গ্রামের মানুষ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। সর্বশেষ বিদ্যালয়ে পাঠদানের জন্য একটি আধাপাকা টিনশেড ঘর ছিল। নতুন ভবন করতে সেটি গত বছর মে মাসে ভেঙ্গে ফেলা হয়। তখন থেকে গাছতলায় ও খোলা ছাপড়ায় ক্লাস হচ্ছে।

নতুন ভবনটি তৈরি করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। ওই ভবন তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত এ উপজেলার উপসহকারী প্রকৌশলী মো. জুলহাজ উদ্দিন জানান, এলজিইডির ‘চাহিদাভিত্তিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্প’ এর আওতায় নতুন ভবনটি তৈরি হচ্ছে। চারতলা ভিত্তির এ ভবনটি বর্তমানে হবে পাঁচ কক্ষের একতলা ভবন। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৩ লাখ ৬৮ হাজার ৭৭৬ টাকা।

কার্যাদেশ দেওয়া হয় গত বছর ৪ এপ্রিল। কাজ শেষের মেয়াদ ছিল গত ৩ জানুয়ারি। নড়াইলের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এস এম আলমগীর কবির এর ঠিকাদার। তবে নতুন ভবন তৈরিতে কেন দেরি হচ্ছে এ বিষয়ে জানেন না বলেন জানান প্রকৌশলী মো. জুলহাজ উদ্দিন। তিনি পরামর্শ দেন এ ব্যাপারে এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলতে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুর রাজ্জাক অভিযোগ করেন, ওই বরাদ্দের মধ্যে ১ লাখ ১৬ হাজার টাকা ধরা আছে আপাতত ক্লাস নেওয়ার জন্য একটি টিনশেড ঘর তৈরি করতে। ঠিকাদার সেটি করেনি। বরাদ্দের ওই ঘরটি করে দিলে দুর্ভোগ কমে যেতো। পুরাতন টিনশেড ঘরের জরাজীর্ণ টিন খুলে তা দিয়ে ছাপড়া দেওয়া হয়েছে। মুল ঠিকাদার কাজটি বিক্রি করে দিয়েছেন লাহুড়িয়ার ঠিকাদার কামরুজ্জামান কমরের কাছে। ওই ঠিকাদারের স্বভাব কাজ নিয়ে ফেলে রাখা, তাই মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও কাজের কিছুই হয়নি। গত ছয় মাস কাজ একদম বন্ধ ছিল। গত নভেম্বর থেকে দুই-একজন শ্রমিক এসে টুকিটাকি কিছু করে। কাজে কোনো গতি নেই। এভাবে চললে কত বছর লাগবে তার ঠিক নেই।

স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, বরাদ্দের টাকা দিয়ে আপাতত ক্লাস নেওয়ার জন্য টিনের ঘর না করে ঠিকাদার টাকা অত্মসাৎ করেছেন। কাজের মেয়াদ পার হলেও কাজ তেমন কিছুই হয়নি। ভিত ঢালাইতে নিম্নমানের খোয়া ও রড ব্যবহার করেছে। এসব দুর্নীতির সঙ্গে এলজিইডির কর্মকর্তারাও জড়িত। তারা দেখেও না দেখার ভান করছে।

গত ৮ জানুয়ারি দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তরে বিদ্যালয়টি অবস্থিত। নতুন ভবনটির শুধু ভিত ঢালাই হয়েছে। আরিফ মোল্লা ও ইমদাদুল শেখ নামের দুজন শ্রমিক গ্রেটবিম তৈরি করতে রড বাঁধছেন। আশপাশে ঘুরাঘুরি করছেন ঠিকাদারের ব্যবস্থাপক পলাশ মোল্লা। এদিকে ওই চত্বরে গাছতলায় হচ্ছে একটি ক্লাস। সেখানে চট বিছিয়ে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। ছাপড়ার টিনে অসংখ্য ছিদ্র ও ভাঙাচোরা। ছাপড়ার একপাশে পাঠকাঠি দিয়ে ঘেরা। অন্য তিন পাশ খোলা। ধুলাবালু উড়ে সবার শরীরে লাগছে। শরীরে লাগছে রোদও।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুর রাজ্জাক ও সহকারী শিক্ষক আছরা খাতুন বলেন, ওই ছাপড়ার যে অবস্থা, গছতলা ও ছাপড়া একই কথা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বসার জায়গা নেই। বৃষ্টি হলে শিক্ষার্থীরা দৌড়ে অন্যের বাড়িতে গিয়ে উঠে। সকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হলে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসে না। এ পরিবেশে উপকরণ ব্যবহার করা যায় না। শিশু শ্রেণির জন্য আলাদা সজ্জিত শ্রেণিকক্ষ রাখার নির্দেশনা আছে, সেটি হচ্ছে না। খোলা জায়গায় বসে শিক্ষার্থীরা টিফিন খায়। পরীক্ষার সময় হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টি হলে পরীক্ষাও নিতে সমস্যা হয়। খোলা পরিবেশে পাঠদানে ও পরীক্ষায় মনোযোগ নষ্ট হয়। এ অবস্থায় শিক্ষার প্রতি কোমলমতি শিশুদের নেতিবাচক ধারণাও জন্ম নিচ্ছে।

পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাব্বি, বাধন, রাখি, চন্দ্রাবতী, অমিত, সৌরভ, নাহিদ, অনন্যা, মল্লিকা ও রিয়াদ এবং তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী নূপুর, দিদার, বিল্লাল, হালিমা, মিতালী, উৎস, পিয়াস ও সয়নের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা বলে, মাঝেমধ্যে ধুলাবালুতে চোখ-মুখ ভরে যায়, বাতাসে বইখাতা উড়ে যায়। গাছতলায় নিচু হয়ে লেখা যায় না। ভয়ে থাকি গাছের ডাল ভেঙ্গে মাথায় পড়ে কি না, আবার ঝড় ও বজ্রপাতের ভয় হয়।

ঠিকাদারের ব্যবস্থাপক পলাশ মোল্লা বলেন, ‘গত বছর কাজ শুরু করতে মে মাসে ভিতঢালাই দেওয়ার জন্য মাটি খুড়া হয়। এরপরই বর্ষা মৌসুম শুরু হয়। বর্ষায় কাঁচা রাস্তা দিয়ে মালামালও আনা সম্ভব হয়নি। তাই আর কাজ করা যায়নি।’ অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।

উপজেলা প্রকৌশলী অভিজিৎ মজুমদার বলেন, ‘গত বর্ষায় কাজ করা যায়নি। এ ছাড়া কাজটি মূল ঠিকাদার বিক্রি করে দিয়েছে অন্য ঠিকাদারের কাছে। এসব কারণে কাজ করতে দেরি হয়েছে। তবে আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চের মধ্যে মূল কাঠামো হয়ে যাবে। এরপর ফিনিশিং করা হবে।’ আপাতত ক্লাস নেওয়ার জন্য অর্থ বরাদ্দ হওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ছাপড়াটি মডিফাইং করতে হবে। অন্য কাজ নি¤œমানের হয়নি বলে তিনি দাবি করেন।

(আরএম/এসপি/জানুয়ারি ১২, ২০২০)