চৌধুরী আবদুল হান্নান


প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই বেসিক ব্যাংক নিজস্ব বেতন কাঠামোতে পরিচালিত হয়ে আসছে, তাদের বেতন-ভাতা রাষ্ট্রমালিকানার অন্যান্য ব্যাংক থেকে বেশি। কিন্তু গত ২২ ডিসেম্বর অন্যান্য সরকারি ব্যাংকের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বেতন কাঠামো কার্যকর করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বেসিক ব্যাংক। ফলে বিদ্যমান বেতন-ভাতা কমে গেছে ওই ব্যাংকের দুই হাজারেরও অধিক কর্মীর। সঙ্গত কারণেই তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে তাদের মধ্যে।

সরকারি কর্মচারিদের সময়ে সময়ে বা বাজার দরের সাথে মিল রেখে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি পেতে দেখা যায় কিন্তু কমিয়ে দেয়ার নজির নেই। পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর সময়ে ব্যাপক ঋণ জালিয়াতি, অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে এক সময়ের অত্যন্ত ভালো এই ব্যাংকটি বর্তমানে ক্রমাগত লোকসানে চলছে, মূলত এ জন্যই বেতন কাঠামো পরিবর্তনের এই উদ্যোগ।

এ ব্যাংকে জাল-জালিয়াতি, দুর্নীতির বিচার না করে ব্যাংকের লোকসান কমানোর জন্য কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বেতন কমিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত কেবল হাস্যকরই নয়, অপরিনামদর্শীও। ২০১৩ সালে ব্যাংকটির কেলেঙ্কারী প্রথম প্রকাশ পেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে এবং তৎকালীন পর্ষদ চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়।

হিসাব খোলার আগে, শাখার সুপারিশ ছাড়া বা শাখার নেতিবাচক মতামত সত্বেও, এমনকি ঋণের আবেদন করার আগেই ঋণ মঞ্জুর করার ঘটনা ঘটেছে এবং সুনির্দিষ্ট প্রমানাদি থাকা সত্বেও পর্ষদ সদস্যদের আইনের জালে আটকাতে কেনো এতো বিলম্ব তা এক বড় বিস্ময়।

ঋণ যখন মাথায়, রক্ষা করবে কে? শাখা কর্মকর্তাদের অপরাধ কতটুকু?

তারা তো কেবল তাদের কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালন করেছেন, অনৈতিক নির্দেশ অমান্য কওে নৈতিকতা স্থাপনের সৎ সাহস সকল পেশাজীবীদের থাকে না। কেউ কেউ হয়ত লোভে আক্রান্ত হয়েছেন, তবে তারা তো কেবল জলের স্রোতে হাত ধুয়েছেন, কিন্তু জল তো গড়িয়েছে সাগরে। এ সাগর-জলের মালিকেরা এখন বনের সিংহ। বেচারে ব্যাংক কর্মকর্তা জেলে আর সাগর চোর বনের রাজা।

এ সকল হিহ্নিত রাঘব বোয়ালদের আইনের আওতায় না আনায় ব্যাংকিং খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এবং বার্তা দিয়েছে যে, ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নিতে পারলে, পরিশোধ না করে পারা যায় না।

গত বছর এক তথ্য-বিবরণীতে জানা যায়, শীর্ষ ১০০ জন ঋণখেলাপির কাছে বিভিন্ন ব্যাংকে পাওনা ২০ হাজার কোটি টাকার ওপর। মনে হবে অর্থশক্তির কাছে আইনশক্তি পরাজিত, কোনো আইন এখানে কাজ করছে না।

চিহ্নিত অপরাধীদের শাস্তি না দিয়ে বেহাত হওয়া অর্থ আদায়ে ব্যর্থ হয়ে এখন ঘরের মুরগি জবাই, ঘরের বউ পেটানো। বেসিক ব্যাংকের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা কমিয়ে ব্যাংটির লোকসান কমানোর উদ্যোগ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ক্ষুব্ধ কর্মীবাহিনী দিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান ভালো চলতে পারে না।

অহেতুক অপরের দায় বহন, সুকুমার রায়ের “হযবরল” গল্পের সেই উক্তি আমাদের মনে করিয়ে দেয় “উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে।”

লেখক : সাবেক ব্যাংকার।