মোঃ আব্দুল কাইয়ুম, মৌলভীবাজার : নদী মাতৃক সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা চির শান্তির দেশ, আমাদেরই বাংলাদেশ। এ-মাটির জলে ফুলে ও ফসলে বেড়ে উঠে বাংলার প্রতিটি তাজা প্রাণ। তাইতো কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতির এই দেশে কৃষি ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে নব-বিপ্লব। দেশের সবচেয়ে উৎপাদনশীল ও গতিশীল খাতগুলোর মধ্যে মৎস্য খাত অন্যতম। কৃষি শিল্প আর মৎস চাহিদা পুরণে জেলায় জেলায় গড়ে উঠছে নতুন নতুন কৃষি ও মৎস খামার। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বৃহৎ হাওর গুলোকে কেন্দ্র করেও গড়ে উঠেছে ছোট বড় অসংখ্য কৃষি ভিত্তিক মৎস খামার। এসব কৃষি উদ্যেগ যেমন জেলার মৎস ও কৃষি চাহিদা পুরণে উল্লেখ যোগ্য ভুমিকা রাখছে,তেমনি হতাশাগ্রস্থ বেকার যুবকদের জন্য তৈরি হচ্ছে আত্ম-কর্মসংস্থানের প্রাণবন্ত পথ নির্দেশনা। যার পথ বেয়ে সৃষ্টি হচ্ছে মৎস আর কৃষি ক্ষেত্রে নব-বিপ্লব। 

জেলার সম্ভাবনাময় এই কৃষি ভিত্তিক মৎস খাত নিয়ে দেশী ও প্রবাসী অনেক উদ্যেক্তা বুকভরা সপ্ন নিয়ে মাতৃভুমিকে ভালবেসে বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছেন। তেমনি একজন সফল খামারী ও উদ্যেক্তা সৈয়দ মুকিত আহমদ। ১৯৬২ সালে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার জগৎসী গ্রামে জন্ম নেয়া এই উদ্যেক্তা কিশোর বয়সে ১৯৭৭ সালে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় পরিবারের সাথে পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। সেখানে রেষ্টুরেন্টে ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত থেকে দীর্ঘ প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশে প্রান্থিক জণগোষ্ঠির কল্যাণে ১৯৯৯ সালের দিকে নিজ এলাকায় বিনিয়োগ করে অবসর সময় দেশেই কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

দেশে আসার পর নিজ চোখে বেকারত্ব দেখে তাঁকে মারাত্মকভাবে ব্যতিত করে। আর এজন্য বিলেতে অর্জন করা কষ্টার্জিত অর্থ ও অভিজ্ঞতা দেশে বিনিয়োগ করার লক্ষে সপ্নবাজ মানুষ মুকিত আহমদকে অনুপ্রাণিত করেছে।

গত শুক্রবার দুপুরের দিকে বানিকা গ্রামে অবস্থিত নিজ বাসায় মৌলভীবাজারসহ দেশের সবচেয়ে বড় কৃষি ভিত্তিক মৎস খামার শাহ্ কাদেরিয়া ফিশারীর উদ্যেক্তা সৈয়দ মুকিত আহমদের সাথে দেশে বিনিয়োগে এবং দেশের সবচেয়ে বড় সফল মৎস খামারী হিসেবে তাঁর এগিয়ে যাওয়ার নানা উপাখ্যান নিয়ে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের সাথে।

আলাপকালে তিনি জানান, ১৯৯৯ সালে দেশে এসে বিনিয়োগের নানা সপ্ন দেখা শুরু হয়। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেন কৃষি ভিত্তিক মৎস খামার গড়ে তোলার। তাঁর সিদ্ধান্তের শুরুটা ছিল মৎস খামার ঘীরেই। যেমন সিদ্ধান্ত তেমন বাস্তবায়নের কাজ। ছোট বেলা থেকে বিলেতে বেড়ে উঠা সৈয়দ মুকিত যুক্তরাজ্যের বিলাসী জীবন ছেড়ে অবসরে সময়ে দেশের টানে সাধারণ মানুষের আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষে প্রায় ৩০০ একর ভুমির উপর গড়ে তুলেন দেশের সবচেয়ে বড় কৃষি ভিত্তিক মৎস খামার।

আলাপকালে তিনি জানান, তাঁর খামারের যাত্রা শুরুকালে সেখানের রাস্তাঘাটসহ অবকাটামো নানা উন্নয়ন কাজে কয়েক হাজার মানুষ যুক্ত থাকলেও অবকাটামো উন্নয়ন কাজ সমাপ্ত হওয়ায় বর্তমানে সেখানে প্রায় শতাধিক মানুষ কাজ করছেন। তাঁর এই মৎস খামারের পাশাপাশি আছে দুগ্ধ ও খাসির খামার,রয়েছে দেশী-বিদেশী হাঁস মোরগ, কবুতরসহ নানা প্রজাতির পাখি।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কাদেরিয়া খামারের প্রবেশ পথের বাম পাশে রয়েছে বিশাল শাহী ঈদগাহ, মসজিদ আর মধ্যখানে রয়েছে খামারে প্রবেশের আলিশান প্রধান ফটক। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার গিয়াসনগর ইউনিয়নের বানিকা গ্রামের বিশাল হাওর এলাকায় প্রথমে মাত্র তিন একর ভুমির উপর শাহ্ কাদেরিয়া মৎস খামার নামে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু করেন তিনি। খামারের পাশেই নিজের পরিবার নিয়ে বসবাস করার জন্য রিসোর্টের আদলে গড়ে তুলেছেন নান্দনিক কারুকাজ খচিত ডুপ্লেক্স বাড়ি।

বাড়ির চার পাশের আঙিনা ঘীরে তৈরি হয়েছে মিনি পার্ক। যেখানে নিজের সন্তানদের বিনোদন আর দর্শনার্থীদের বসার জন্য এক নির্জন পরিবেশে সময় কাটিয়ে দেওয়ার উপযুক্ত স্থান। চারিদিকে পাখির কলকাকলী মুখর সবুজ এই উদ্যান ঘীরে সাধারণ মানুষ আর দর্শনার্থীদের পদচারনায় মুখর থাকে সারাক্ষণ। এক সময়ে যেখানে ধানি জমি আর চারিদিকে কাঁদামাটি ছাড়া কিছুই ছিলনা, সেখানে এসব ধানি জমি আর হাওর এলাকা একাকার হয়ে দ্রুত তৈরি হয় বিশাল সাম্রাজ্য।

খামার ঘীরে তৈরি হওয়া এই সাম্রাজ্য দেখতে আর প্রকৃতির নয়নাভিরাম রূপ উপভোগ করতে প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্থ থেকে ছুটে আসেন পর্যটকরা। বিশেষ করে শীতকালে খামারের সবুজ গাছগাছালি ছোট বড় পুকুরের জলরাশিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা সবুজ এই উদ্যানে অতিথি পাখির আনাগুনা অনেকাংশে বেড়ে যায়। এই খামার জেলার মৎস চাহিদা পুরণ করে দেশের নানা প্রান্তে রপ্তানি হচ্ছে নানা প্রজাতির দেশীয় মৎস।

বর্তমানে শাহ্ কাদেরীয়া মৎস খামারে ছোট-বড় মিলিয়ে ৬০টি পুকুর রয়েছে। এসব পুকুরগুলোতে রয়েছে রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার, তেলাপিয়া, কার্পু, কৈই, মাগুর, শিং, বোয়াল, গজার ও ঘণিয়াসহ নানা প্রজাতির সাদা জাতের দেশীয় মাছ। এসব মাছ সংগ্রহ করে জেলার বিভিন্ন হাটে বিক্রির উদ্দেশ্যে প্রতিদিন সকাল হলেই পাইকারদের আনাগোনা বেড়ে যায়।

শাহ্ কাদেরীয়া মৎস খামারের স্বত্তাধিকারী সৈয়দ মুকিত আহমেদ বলেন, আমি দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকে অনেক কষ্ট করে অর্থ উপার্জন করে অবসর সময়টুকু দেশে কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। এর পর দেশে এসে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষে মৎস খামারে বিনোয়গ করি, যার সূফল এখন আমি ভোগ করছি।

(ওএস/এসপি/জানুয়ারি ১৪, ২০২০)