পাবনা প্রতিনিধি : একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এদেশীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দোসররা পাবনার চাটমোহর উপজেলার ফৈলজানা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপিষ্ট চার্চসহ খ্রিস্টানপাড়া ধরেই লুটপাট চালানোর পর আগুনে পুড়িয়ে দেয়। 

ব্যাপ্টিষ্ট চার্চটি মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প স্থাপন করে আশপাশে স্বাধীনতাকামী মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করে রাজাকার ও পাকিস্তানী বাহিনীকে প্রতিহত করতেন। আশপাশের পুরো খবর আদান প্রদানসহ মুক্তিযোদ্ধাদের সাবির্কভাবে সহায়তা করার অপরাধেই ওই খ্রিস্টান পাড়ার হরকুমার বৈদ্যকে ধরে নিয়ে যায় রাজাকার ও পাকিস্তানী বাহিনী। এরপর ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর রাতে নিশংসভাবে হত্যা করা হয় হরকুমার বৈদ্যকে।

খ্রিস্টানপাড়ার বাসিন্দারা জানান, ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার ধারাবাসাই কান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন হরকুমার বৈদ্য। দেশ স্বাধীনের অনেক আগেই কাজের সূত্র ধরেই তিনি বাবার সাথে ফৈলজানা খ্রিস্টানপাড়ায় অবস্থান নেন। পেশায় তিনি কাঠমিস্ত্রি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সক্রিয়ভাবে অবস্থান নেন। তিনি দক্ষ সংগঠকের ভূমিকায় খ্রিস্টানপাড়াসহ আশপাশ এলাকার যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্য উৎসাহ যুগিয়েছেন। প্রশিক্ষণের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতাকামী যুবকদের ভারতে গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানোর ব্যবস্থাও করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে হরকুমার বৈদ্য ফৈলজানা ব্যাপ্টিষ্ট চার্চে অবস্থান নেওয়া তৎকালীন কমান্ডার ওয়াসেফ উদ্দিনের নেতৃত্বে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বক্ষণিক দেখভাল করতেন। পাকিস্তানী দোসর রাজাকার-আলবদর-আলশাসদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার জন্য তারা পুরো খ্রিস্টান পাড়া লুটপাটের পর আগুনে জ্বালিয়ে দিয়ে ধরে নিয়ে যায় হরকুমার বৈদ্যকে। পরে তাকে খ্রিস্টানপাড়ার পাশেই গোড়রী নামক স্থানে গুলি করে হত্যা করে।

হরকুমার বৈদ্যের মেয়ে সুমতি বৈদ্য জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান রাজাকার পয়গম হোসেন পাঁচুর নির্দেশে ন্যাংড়িগ্রামের আব্দুল আজিজের ছেলে আব্দুল জলিলকে ভয়ভীতি দেখিয়ে আমার বাবা হরকুমার বৈদ্যকে নিজ ঘর থেকে ধরে নিয়ে যায়। পয়গম হোসেন পাঁচু ও তার সহযোগিরা হরকুমার বৈদ্যকে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। পরে রাজাকার পাঁচু ও তার লোকজন আমার বাবাকে প্রথমে শারীরিক ভাবে নির্যাতন চালায়। এরপর পাকিস্তানী বাহিনীর নির্দেশেই পাঁচু রাজাকার আমার বাবা হরকুমার বৈদ্যকে পায়ে, বুকে ও মাথায় গুলি করে হত্যা করে।

স্থানীয়রা জানান, খ্রিস্টানপাড়ার মুসলমান ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকজন দীর্ঘ ৩ মাস মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, প্রশ্রয় ও খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাসহ অপারেশনের যাবতীয় সহযোগিতা করার কারণেই পাঁচু রাজাকারসহ তার অনুসারীরা খ্রিস্টানপাড়ার প্রত্যেক বাড়িতে লুটতরাজ করে আগুন ধরে জ্বালিয়ে দেয়। সে সময়ে ৩২ ঘরের বসতি ছিল।

ক্ষতিগ্রস্তরা হলেন; দ্বারিকানাথ বৈরাগী (দোয়ারী মিস্ত্রী), প্রেমানন্দ বৈদ্য, যুধিষ্টি বাড়ৈ, শমূয়েল বৈদ্য, প্রিয় কুমার বৈদ্য, শহীদ হর কুমার বৈদ্য, পিতর হাজরা, মিঃ বিমল দাস, জনমিত্র (হরিপদ মিত্র), মিঃ ভদ্রকান্ত মন্ডল, জিতেন মন্ডল, রশিক চন্দ্র হাজরা, বুদ্ধিশ্বর বৈদ্য, পৌল বৈদ্য, আন্দ্রিয় বৈদ্য, যোহন বৈদ্য, পিতর বৈদ্য, সুশীল বিশ্বাস, সুনীল বিশ্বাস, অনন্ত বৈদ্য, কালু বৈদ্য, যোষেফ বৈদ্য, বসন্ত বৈদ্য, প্রভাত দাস, দেবেন্দ্রনাথ ঝাঁ, শচিন পান্ডে, পৌল পান্ডে, রবীন্দ্রনাথ পান্ডে, মনোহর পান্ডে, প্রভাত পান্ডে, বিজয় দাস (টোকন), মোঃ আমজাদ হোসেন (আনছার) ও মোঃ মিনয়াজ প্রামানিক। এদের অধিকাংশই আর জীবিত নেই।

স্থানীয়দের দাবী, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যে ৩২ পরিবার মুক্তিযোদ্ধাদের নানা ভাবে সহযোগিতা করেছেন। কেউ তথ্য আদান প্রদান করে, কেউ রান্না করে, কেউ খাওয়ার পৌঁছানো, কেউ বা নানা খোঁজ খবর নিতেন। এরা অনেকেই মারা গেছেন। কিন্তু তারা সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। অথচ স্বাধীনের ৪৯ বছর পড়েছে। আজও এই খ্রিস্টান পাড়ার কেউ কোন খোঁজ রাখেনি। কাউকে মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদের সম্মান দেয়া হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মাছ ধরে, নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন ১০৫ বছরের ভদ্র মন্ডল। তিনি জানান, শুনেছি পয়গম হোসেন পাঁচু নাকি মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। ভাতা তুলছে। অথচ সে ছিল কুখ্যাত রাজাকার। একাত্তরে সুন্দরী মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিস্টান মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে তুলে দিতো তখনকার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান পয়গম হোসেন পাঁচু। এছাড়াও স্বাধীনতাকামী মানুষদের ধরে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানী ক্যাম্পে নির্বিচারে হত্যা করতো। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বয়স ১৫ বছর। তিনি শিমসন মন্ডল। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাঁচু রাজাকার ও আকবর রাজাকার হরকুমার বৈদ্যকে চোখের সামনে তুলে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে।

নারীদের ধর্ষণ, অত্যাচার ও তুলে নিয়ে পাকিস্তানে ক্যাম্পে দেওয়াই ছিল তাদের কাজ। তখন থেকেই দাঙ্গাবাজ ও ডাকাত হিসেবে সবাই তাদের ভয় পেত। ৭৫ বছরের আমজাদ হোসেন ওরফে আনসার। যুদ্ধের সময়ে তিনি ছিলেন নৌকার মাঝি। গভীররাতে নৌকা করে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা স্থানে পৌঁছায়ে দিতেন। অপারেশন শেষে আবার তাদের ব্যাপ্টিষ্ট চার্চে পৌঁছে দিতেন।

তিনি বলেন, এই পল্লীতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল হরকুমার বৈদ্য’র। কিন্তু তিনি এখনও শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় স্থান পাননি। ৮৫ বছরের বৃদ্ধ পলু পান্ডে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার নানা ঘটনার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী তিনি। ধর্ম নয়, দেশ বড়। এমন সত্যকে সামনে নিয়ে ধর্মীয় উপাসানালয় চার্চ খুলে আশ্রয় দেয়া হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের। এই ক্ষোভেই রাজাকাররা পাকিস্তানীদের সহায়তায় খ্রিস্টানপাড়া আগুন ধরিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেয়। অধীর বৈদ্য। বয়স ৭১ বছর। খ্রিস্টানপাড়ার গীর্জা থেকে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ওয়াছেফ উদ্দিনের নেতৃত্বে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের ধানুয়াঘাটা থেকে নৌকা যোগে দাপুনিয়া পর্যন্ত পৌঁছে দিতেন। দিনে নৌকা যোগে সাধারণ মানুষকে পারাপার আর রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল অধীর বৈদ্যের অন্যতম কাজ।

পলুপান্ডে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ শেষ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভিটেমাটিতে এসে দেখি বসবাসের মতো কিছু নেই। সব শেষ। দেখা করি স্কয়ারের প্রতিষ্ঠাতা স্যামসন এইচ চৌধুরীর সাথে। তিনি আমাদের দুঃখ, দুর্দশা শুনলেন। তিনি আমাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমাদের খাবার, কাপড়চোপড় ও কম্বল দিলেন। স্বাধীনের পর তিনিই আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে আর কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি।

খ্রিস্টানপাড়ার একাধিক বয়োজেষ্ঠ্য নারীর সাথে আলাপকালে তারা আবেগাপ্লুত হয়ে যান। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে সবারই চোখের পানি আপনাআপনি চলে আসছিল তাদের। তারা বলেন, কাটাজোলা ছিল ভরসা। মাথার উপর দিয়ে নদীর ওপাশ থেকে শনশন শব্দে বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তো পাকিস্তানী বাহিনীরা। রাজাকারদের উপদ্রুপ বেড়ে গেলেই কাটাজোলা দিয়ে নিরাপদ দুরত্বে চলে যেতে হতো। তিনদিকে নদীর পানি। পাকিস্তানী বাহিনী পথঘাট কিছুই চিনতো না। কিন্তু রাজাকার পাঁচু তাদের পথ চিনিয়ে দিয়ে আমাদের একের পর এক সর্বনাশ করেছে।

নিজের বিরুদ্ধে রাজাকার ও পাকিস্তানী বাহিনীকে সহযোগিতার অভিযোগ অস্বীকার করে পয়গম হোসেন পাঁচু বলেন, আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করা হয়েছে। যা কোন অবস্থায় সঠিক নয়। আমি একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা। আমি রীতিমতো সরকারি ভাতা পাচ্ছি। আমাকে সামাজিক ভাবে হেয়প্রতিপন্ন করতেই একটি চক্র এ ধরণের মিথ্যা রটনা রটাচ্ছেন।

চাটমোহর উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ মাস্টার বলেন, ফৈলজানা খ্রিস্টানপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বর্বরোচিত হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। অনেকেই মারা গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘরবাড়ি। লুণ্ঠন করা হয়েছে সহায় সম্বল। খ্রিস্টানপল্লীর মানুষ স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের সবক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন। তারা যেমন শহীদের খেতাব দাবীদার। তেমনি সহযোগি মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তাদের নাম অন্তর্ভূক্তি হওয়া দরকার বলে মনে করি।

চাটমোহর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. মোজাহার হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ফৈলজানা খ্রিস্টানপাড়ায় মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে খ্রিস্টান চার্চে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প স্থাপন করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন, সেখানে বাড়িঘরে লুটপাটের পর আগুন ধরিয়ে দেয়া বা মুক্তিযোদ্ধাদের কোন সহযোগীকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে এমন কোন তথ্য আমার জানা নেই।

এদিকে আটঘরিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. জহুরুল হক বলেন, ফৈলজানা এলাকায় শীর্ষ দস্যু ও ডাকাত খ্যাত আকবর আলীর বন্ধু ছিল পয়গম হোসেন পাঁচু। স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থানকারী আকবর আলী পয়গম হোসেন পাঁচুকে সাথে নিয়ে সেই সময়ে ডাকাতি ও লুণ্ঠন করতেন। মুক্তিযোদ্ধারা যখন আকবর আলীকে হত্যা করেন। সে সময়ে পাঁচু তার সাথে থাকলেও সেখান থেকে পালিয়ে যায়। পরে পয়গম হোসেন পাঁচু মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পন করেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা তাকে বিশ্বস্ততায় আনতে না পারায় পরে ৫ জন রাজাকারকে ধরে নিয়ে এসে আসে পাঁচু। এরপর পাঁচু মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সরকার মোহাম্মদ রায়হান জানান, নতুন এসেছি। আমার কাছে কোন তথ্য নেই। তবে খোঁজ নিয়ে জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

(পিএস/এসপি/জানুয়ারি ২৫, ২০২০)