স্টাফ রিপোর্টার : বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) গোডাউনে পড়ে আছে ৭৫ হাজার ‘অ্যামোরফস’ ট্রান্সফরমার। নিম্নমান, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেশি হওয়ায় এগুলো ব্যবহার হচ্ছে না। দীর্ঘদিন গোডাউনে পড়ে থেকে প্রায় সব ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়ে গেছে। গোডাউনে এতগুলো নষ্ট ট্রান্সফরমার রেখে সরকারি টাকা ‘অপচয়’ করে আবারও একই ট্রান্সফরমার ক্রয়ে আরইবিকে চাপের মুখে রেখেছে মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে দরপত্র আহ্বানসহ কেনাকাটার সব সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলেও এখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে খোদ আরইবি।

বাংলাদেশে সাধারণত দুই ধরনের ট্রান্সফরমার ব্যবহৃত হয়, ‘সিআরজিও’ ও ‘অ্যামোরফস’। ‘পল্লী বিদ্যুতায়ন কার্যক্রম সম্প্রসারণের মাধ্যমে ১৫ লাখ গ্রাহক সংযোগ’ প্রকল্পের সিঙ্গেল ফেজ ট্রান্সফরমার কেনার জন্য ২০১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর দরপত্র আহ্বান করে আরইবি। দরপত্রে ‘সিআরজিও’ ও ‘অ্যামোরফস’ - এ দুই ধরনের ট্রান্সফরমার সরবারহের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।

তবে ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর দরপ্রস্তাব খোলা ও মূল্যায়নের পর দেখা যায়, দরপত্রের চারটি প্যাকেজের মধ্যে তিনটিতে টিএস ট্রান্সফরমার লিমিটেড এবং একটি প্যাকেজে কনফিডেন্স ইলেকট্রনিক লিমিটেড নামের আরেকটি কোম্পানি সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে। দরপত্রে উল্লেখিত দু’টি কোম্পানিই ‘অ্যামোরফস’ ট্রান্সফরমার সরবারহের প্রস্তাব দিয়েছে। অথচ একই প্রযুক্তির ৭৫ হাজার পিস ট্রান্সফর্মার গোডাউনে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।

আরইবি সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কয়েকবছর আগে আরইবি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান তোশিবার কাছ থেকে ‘অ্যামোরফস’ প্রযুক্তির ৯০ হাজার পিস ট্রান্সফরমার ক্রয় করেছিল। এ প্রযুক্তির ট্রান্সফরমার বাংলাদেশের বর্তমান বিতরণ ব্যবস্থায় একেবারেই অনুপযুক্ত।

আরইবির প্রকৌশলীদের মতে, স্বল্পমাত্রার ভোল্টেজ তারতম্যের কারণে ব্যবহৃত ১৫ হাজার ট্রান্সফরমারই দুই মাসের মধ্যে বিকল হয়ে পড়ে। বাকি ৭৫ হাজার ট্রান্সফরমার আরইবির সেন্ট্রাল ওয়্যার হাউজ ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বিভিন্ন গুদামে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। এসব ট্রান্সফরমারের কোনো মেরামত ও পুনঃব্যবহারের ব্যবস্থা না থাকায় বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থের অপচয় হয়েছে।

এ বিষয়ে একাধিক জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী বলেন, অ্যামোরফস ট্রান্সফরমারের হিস্টেরিসিস লস ও চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের তীব্রতা সিআরজিও ট্রান্সফরমারের তুলনায় কম। এছাড়া অ্যামোরফস ট্রান্সফরমারের ধাতু খুবই ভঙ্গুর, ক্রমাগত যান্ত্রিক চাপ সহ্য করতে পারে না। তাই যেকোনো কম্পন, স্টেপ-লোড ও শর্ট সার্কিটের কারণে অ্যামোরফস ট্রান্সফরমারের ধাতবের দক্ষতা স্থায়ীভাবে হ্রাস করে ফেলে। একবার অ্যামোরফস ট্রান্সফরমারের ধাতু ছোট ছোট টুকরো হয়ে গেলে কোরটি মেরামত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়, যা কার্য সম্পাদনে ব্যাঘাত ঘটায়।

আরেক প্রকৌশলী বলেন, ক্ষমতা অর্জনের জন্য একটি অ্যামোরফস ট্রান্সফরমারের বৃহত্তর কোর প্রয়োজন হয়। এছাড়া সিআরজিও ট্রান্সফরমারের চেয়ে অ্যামোরফস ট্রান্সফরমারে কপার ওয়েল্ডিং বেশি লাগে, যা ফুল লোড লসের অন্যতম কারণ। পাশাপাশি সিআরজিও ট্রান্সফরমারের ব্যবহারবিধি ও রক্ষণাবেক্ষণ অ্যামোরফস ট্রান্সফরমারের তুলনায় সহজ। সিআরজিও এর সহায়ক যন্ত্রাংশগুলো বাজারে খুব সহজেই পাওয়া যায়। তাই এ ধরনের সিআরজিও বাদ দিয়ে অ্যামোরফস ট্রান্সফরমার কেনার সিদ্ধান্ত একান্তই বোকামি ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

আরইবিতে কর্মরত কয়েকজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী বলেন, সিআরজিও ও অ্যামোরফস ট্রান্সফরমারের মধ্যে যে পার্থক্য তাতে সিআরজিও ট্রান্সফরমারই বেশি সুবিধাজনক। বাংলাদেশে বজ্রপাত এখন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। প্রায়ই বজ্রপাতের কারণে ভোল্টেজের তারতম্য ঘটে। ভোল্টেজ তারতম্যের কারণে সিআরজিও ট্রান্সফরমার ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। এছাড়া সিআরজিও ট্রান্সফরমারে ব্যবহৃত কোর ম্যাটেরিয়াল হিসেবে সিলিকন স্ট্রিপ ইস্পাত বজ্রপাতেও টেকসই। এ ট্রান্সফরমার বহুদিন টেকে এবং মেরামতযোগ্য। দেশে এ ধরনের ট্রান্সফরমার ব্যবহার ও পরিষেবার দক্ষ জনবলও গড়ে উঠেছে।

এর আগে ‘আরইই এসডিপি অ্যান্ড আইইডি’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের দরপত্র ‘অ্যামোরফস’ ট্রান্সফরমার সরবারহের বিধান রাখতে আপত্তি করে আরইবি। তবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সে আপত্তি নাকচ করে দেয়। আরইবির পক্ষ থেকে ‘অ্যামোরফস’ প্রযুক্তির ত্রুটিপূর্ণ দিকগুলো অফিসিয়ালি অবহিত করা হলেও মন্ত্রণালয় তা মানতে নারাজ, তারা একই সিদ্ধান্তে অটল।

আরইবি সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ১৩টি প্রতিষ্ঠান সিআরজিও ট্রান্সফরমার তৈরি করছে। বিপরীতে ‘অ্যামোরফস’ প্রযুক্তির ট্রান্সফরমার তৈরি করছে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান। তারা হলো- টিএস ট্রান্সফরমারস লিমিটেড ও কনফিডেন্স ইলেকট্রনিক লিমিটেড। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগাযোগ রেখে এ দুটি প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত ‘অ্যামোরফস’ প্রযুক্তি আরইবির পারচেজ ম্যানুয়ালে ঢুকিয়ে নেয়।

আরইবির একাধিক সূত্র জানায়, প্রকৌশলীদের মতামত উপেক্ষা করে উল্লেখিত দুটি কোম্পানি মন্ত্রণালয়ের অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বাংলাদেশে ‘অচল’ অ্যামোরফস প্রযুক্তির ট্রান্সফরমার কিনতে আরইবির চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চাপের মুখে রেখেছে। এ অবস্থায় আগের দরপত্রটি বাতিল করে শুধুমাত্র সিআরজিও প্রযুক্তির ট্রান্সফরমার কেনার বিধান রেখে পুনঃদরপত্র আহ্বান করার কথাও আরইবির পক্ষ থেকে চিন্তা করা হচ্ছে।

‘পল্লী বিদ্যুতায়ন সম্প্রসারণের মাধ্যমে ১৫ লাখ গ্রাহক সংযোগ’ প্রকল্পের পরিচালক (তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশল) বিশ্বনাথ সিকদার বলেন, ‘আমরাও অ্যামোরফসের বিষয়ে এ ধরনের তথ্য জেনেছি। আজ (বুধবার) সন্ধ্যা ৬টায় আমাদের বোর্ড সভা হবে। দরপত্র ও ট্রান্সফরমার কেনার বিষয়টি মিটিংয়ের অন্যতম একটি এজেন্ডা। সেখানে এ বিষয়গুলো উঠবে। এ বিষয়ে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হবে কি-না, বোর্ড সভায় সেই সিদ্ধান্তও নেয়া হবে।’

(ওএস/এসপি/জানুয়ারি ২৯, ২০২০)