* সঠিক তদন্তের মাধ্যমে চাকরি থেকে বহিস্কার এবং তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত

মানিক সরকার মানিক, জলঢাকা থেকে ফিরে : বনভোজনের অতিরিক্ত মাত্র ৫০ টাকা দিতে না পারায় ৫ম শ্রেণির এক সংখ্যালঘূ ছাত্রীকে মানসিক লাঞ্ছিত করে সরকারীভাবে দেয়া তার সকল পাঠ্যবই কেড়ে নিয়ে বিদ্যালয় থেকে বের করে দিয়েছেন প্রধান শিক্ষক। লজ্জা ক্ষোভ আর অভিমানে ওই ছাত্রী বাসায় গিয়ে বিষয়টি দরিদ্র বাবাকে জানালে তিনি বিদ্যালয়ে গিয়ে অনুনয় বিনয় করলেও প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ে তাকেও অপমানিত করে বের করে দেন এবং পরবর্তীতে তার মেয়েকে কোন স্কুলে ভর্তি করাবেন, তা দেখে নেবেন বলেও হুমকি দেন। পরে তার বাবা মেয়েকে ব্র্যাকের উপআনুষ্ঠানিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। ঘটনাটি ঘটেছে গত ২৬ জানুয়ারি নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার গাবরোল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

নীলফামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে গত ২৭ জানুয়ারি ওই গ্রামের দিনমজুর কৃষ্ণ চন্দ্র রায়ের লিখিত অভিযোগে জানা যায়, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বনভোজনে যাবার নামে প্রত্যোক ছাত্রছাত্রীর কাছে ২৫০ টাকা করে চাঁদা ধরেন। কিন্তু দরিদ্র কৃষ্ণ চন্দ্র ২৫০ টাকার স্থলে তার মেয়ে কাজলী রানীকে ২০০ টাকা দিয়ে প্রধান শিক্ষকের কাছে পাঠান এবং তা দিয়েই বনভোজনে যাবার অনুরোধ জানান। কিন্তু প্রধান শিক্ষক তা মেনে না নিয়ে কাজলীকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং সরকারীভাবে তাকে দেয়া পাঠ্যবই ফেরত নিয়ে তার বাবাকে ডেকে পাঠান। পরে তার বাবা স্কুলে গেলে ওই প্রধান শিক্ষক তাকেও গালিগালাজ করেন। পরে কৃষ্ণ চন্দ্র বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ জানালে নির্বাহী কর্মকর্তা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে বিষয়টি তদন্ত করে দেখার দায়িত্ব দেন।

অভিযোগ উঠেছে, মেয়ের বাবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং রংপুরের সাংবাদিকসহ উপজেলার সুধীজনদের আগে পুরো বিষয়টি জানালে প্রধান শিক্ষকের টনক নড়ে এবং তার কাছ থেকে জোর পূর্বক অভিযোগপত্র প্রত্যাহারের একটি চিঠি লিখিয়ে নেন। শুধু তাই নয়, প্রধান শিক্ষক প্রভাবশালী এক ব্যক্তিকে ধওে ওই শিক্ষার্থী, তার বাবা এবং অন্যান্যদের ম্যানেজ করেন। এক পর্যায়ে তিনি মেয়ে, বাবা এবং তার আত্মীয় স্বজনকে ভয়ভীতি দেখান যে, তারা যা কিছু শিখিয়ে দেবে, তাই যেন তদন্ত কমিটির কাছে বলা হয় নইলে ভবিষ্যতে তাদের বিপদ হবে। এতে বিপাকে পড়েন পরিবারটি।

এদিকে তদন্তের দায়িত্ব পাবার পর শিক্ষা কর্মকর্তা ২৯ তারিখ পিকনিকে যাবার প্রাক্কালে কোন ঘোষণা ছাড়াই আকস্মিক সেদিনই তদন্তের জন্য বিদ্যালয়ে যান এবং তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত পিকনিকে না যাওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি অভিযোগকারী, তার মেয়ে এবং অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেন এবং একটি মনগড়া তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। তাতে তিনি এও উল্লেখ করেন যে, সরকারীভাবে দেয়া বইগুলো অভিভাবক নিজেই চেয়ে নিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ওই শিক্ষার্থীকে ভবিষ্যতে নিরাপদ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতকরণসহ নিবিড় তত্ত্বাবধানের আওতায় নেয়া হবে।

কৃষ্ণচন্দ্র ওই সমঝোতা সভায় বসার আগেই সাংবাদিকদের জানান, সমঝোতা বৈঠকে তিনি সাংবাদিকসহ সকলের উদ্দেশে সত্য কথা বলবেন। কিন্তু সেখানে যাবার পর ইউএনও এবং উপজেলা চেয়ারম্যান বাহাদুর আলীর হস্তক্ষেপে তারা আর কোন কথাই বলতে রাজি হননি। ফলে উভয়ে ভুল ‘বুঝাবুঝি’র অযুহাত এনে প্রধান শিক্ষক ও প্রশাসনের পক্ষে এক তরফা বিচার ইউএনও ও সংশ্লিষ্টরা।

এলাকার শিক্ষাবীদরা এ ঘটনাটিকে অত্যন্ত অমানবিক, লজ্জাকর এবং একজন শিক্ষকের জন্য গর্হিত কাজ বলে মনে করেন। তাদের মতে, শিক্ষক হলো মানুষ গড়ার কারিগর। তাদের এই আচরণে কোমলমতি ওই শিক্ষার্থী অভিমানে মারাত্মক কিছুও করে ফেলতে পারতো। যেমনটি আমরা সোমবারেই দেখেছি পার্শ্ববর্তী উপজেলা ডোমারে। সেখানে শিক্ষকের ভুলের কারণে বাণিজ্য বিভাগের এক এসএসসি পরীক্ষার্থীর এ্যাডমিশন কার্ড এসেছে বিজ্ঞান বিভাগের। ফলে ওই পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে না পারায় ক্ষোভে আত্মহত্যা করেছেন। শুধু তাই নয়, এমন ঘটনা দেশে অহরহই ঘটছে।

রংপুরের অপর শিক্ষাবীদ নজরুল ইসলাম হাক্কানী জানান, প্রাথমিক শিক্ষকদের অনেকেই জানেন না ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ক কী? তিনি বলেন, অশালীণ আচরণের কথা বাদই দিলাম, তিনি যে, সরকারী বই শিক্ষার্থীর হাত থেকে ফেরত নিয়ে তাকে বিদায় দিয়েছেন এই অপরাধে তার বিরুদ্ধে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে চাকরি থেকে বহিস্কার এবং তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুজা-উদ দৌল্লা ও উপজেলা চেয়ারম্যান বাহাদুর আলী জানান, তাদের মাঝে একটি ভুল বোঝাবুধি হয়েছিল। আমরা উভয়ের মীমাংসা করে দিয়েছে। কাজলী এখন নিয়মিত ওই স্কুলেই পড়বে।

অন্যদিকে প্রধান শিক্ষক সমঝোতা বৈঠক শেষ হওয়ার আগেই ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে তার মুঠো ফোনে বিভিন্ন নম্বর থেকে ফোন করলেও তিনি তার ফোন রিসিভ করেননি।

(এমএস/এসপি/ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০২০)