কবীর চৌধুরী তন্ময়


বঞ্চিত, নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের মানবতার দূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাস ৭ই মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ‘...সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবা না...।’ জাতির পিতার ওই উদ্যোমী বক্তব্য শুধু সাত কোটি মানুষকেই মন্ত্রমুগ্ধ করেনি, হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মাত আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের মরণ-পণ মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে সহায়তা করেছে। শুধু তাই নয়, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও পাকিস্তানের বর্বরতা আর শোষণ, নির্যাতন ও শত্রুমুক্ত করে একটি স্বাধীনত সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র বিশ্ব মানচিত্রে জন্মদিতে ত্রিশ লাখ তাজা প্রাণ তাঁদের বুকের লাল রক্ত এদেশের সবুজ জমিনে ঢেলে দিয়েছে। দুই লক্ষেরও বেশি নারী সম্ভ্রব বিনাশের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানীদের পাশবিক অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশ ভূমিষ্ঠ করেছে।

পিতা মুজিব তাঁর জীবনের ২৩ বছর জেল-জুলুম আর অত্যাচার সহ্য করে আমাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, একটি স্বাধীন জাতিগোষ্ঠীর নাম-পরিচয় দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকণ্যা শেখ হাসিনা তলাবিহীন রাষ্ট্রকে প্রথমে মাথা তুলে দাঁড়ানোর শিক্ষা দিয়েছেন, নিজেদের ভিতরে ‘আমিই বাংলাদেশ’ গর্বিত করার ‘মনমন্ত্র’ দিয়ে আমাদের করেছেন উদ্যোমী।

এই উদ্যোমী বাংলাদেশ এখন নিজের পায়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের বলার মত গল্প-এই বাংলাদেশ এখন বিশ্বময়। শত-সহস্র ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে উদ্যোমী বাংলাদেশ যেখানে নিজেস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে দৃঢ় অঙ্গিকারবন্ধ, আত্মপ্রত্যয়ী ও সাহসী-এখানেও আমাদের দাবায়ে রাখবে কে?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোনও এক অজানা কারণে ‘বঙ্গমাতা’ কবিতায় লিখেছেন- “সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙ্গালি করে-মানুষ কর নি।” সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ও রাজনীতির কবি মুজিব এদেশের বাঙালিকে শুধু সাহসী যোদ্ধা আর আত্মপ্রত্যয়ই করে তুলেননি; মানুষও করেছেন। আর তাই ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গর্ববোধ করে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘কবি তুমি দেখে যাও, তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’

হ্যাঁ! আমরাই পারি। আমরাই বাঙালি। এই বাঙালিকে পারার মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন বঙ্গবন্ধুকণ্যা শেখ হাসিনা। ৭৫’র পরবর্তী সময় জুড়ে শুধু ‘আত্মবিশ্বাস’ আর ‘আমরাও করতে পারি’-সাহসটুকু একক চিত্তে আমাদের দিয়ে চলেছেন। শুধু বাংলাদেশে নয়, সমস্ত পৃথিবী জুড়ে একমাত্র শেখ হাসিনার মতন রাষ্ট্র নায়ক শত-সহস্র অপপ্রচার, ব্যক্তিগত আক্রমনাত্মক মন্তব্য শুনেও-‘বাঙালি’ ও ‘বাংলাদেশ’র জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, শত্রুর ষড়যন্ত্রের জাল ছিঁড়ে মৃত্যুর খুব নিকট থেকে ২৯ বার ঘুরে দাঁড়িয়েছে-আগামী প্রজন্মের ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্রমুক্ত অর্থনৈতিক মুক্তির বাংলাদেশ গড়তে। এমন কোনও মানুষ নেই যে বঙ্গবন্ধুকণ্যা শেখ হাসিনার আদর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আমরা যাঁরা স্যোশাল মিডিয়ায় থাকি বা কাজ করি, আমরা জানি-একজন দিনমজুরের সাথে এই শেখ হাসিনা কিভাবে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেন।

শতবর্ষী বৃদ্ধা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে আসার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে এবং শেখ হাসিনার সাথে ওই বৃদ্ধার দেখা করার ইচ্ছে জানার সাথে সাথে গণভবনে ডেকে আদর-আপ্যায়ন, ছবি তোলা, বৃদ্ধার জীবন-জীবিকার বিষয়াদির খোঁজ খবর নেওয়াসহ তাঁর আন্তরিকতার ঘাটতি রাখেনি। কোথায় কোনও ছোট্ট বাচ্চা মুক্তামণি টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না-এটি জানার সাথে সাথে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া, যশোরে রাস্তার দু’পাশে শতবর্ষী বটবৃক্ষ রেখে নতুন রাস্তার কাজ শুরু করা; শেখ হাসিনার মায়া-মমতা, রাজনৈতিক দীক্ষা, দুরদৃষ্টি ও শাসনামল-আমাদের সত্যিই গর্বিত করে তুলে, করে তুলে উদ্যোমী। শুধু ছোট বাচ্চা বা শতবর্ষী বৃদ্ধই নয়, আমাদের বিশ্ববিখ্যাত ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের জন্যেও তিঁনি রান্না করে খাবার পাঠানোর ছবি যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছয়লাভ-তখন এ প্রজন্ম কেন উদ্যোমী হবে না। কেন গর্ববোধ করবে না। কেন বলবে না, আমরাই বাঙালি। আমরাই পারি।

ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশ এক বারুদ। কাটার মাস্টার মুস্তাফিজ থেকে অলরাউন্ডার সাকিব-সবই বাংলাদেশ। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বোলিংয়ে ছিল আগুন, ফিল্ডিংয়ে রীতিমত বারুদ। লক্ষ্যটাও ছিল স্থির। ব্যাটিংয়ের শুরুটাও ছিল দারুণ। খেলার মাঠে নানান নাটকীয়তার মাঝে টাইগাররা একেবারে খাদের কিনারা থেকে যেন আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা-এক কথায় অসাধারণ। এই লড়াকু মনসিকতার সঙ্গে পেরে ওঠেনি ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ দল। তাদের হারিয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছে বাংলাদেশ।

৯ ফেব্রুয়ারি আমাদের জন্য সত্যিই স্মরণীয় দিন। এমন দিন কখনও আসেনি বাংলাদেশের ক্রিকেটে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ, গৌরবান্বীত হওয়ার কৃতিত্ব। ক্রিকেট উন্মাদনার এই রেকর্ড অর্জন আমাদের করতেই হবে, আমরা বাঙালি, আমরাই পারি-এই বিষয়গুলো প্রচন্ডভাবে কাজ করেছে। চারবারের রেকর্ড ট্রফি জয়ী ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে অভূতপূর্ব সাফল্যের দিন-আমাদের পারার দিন, আমাদের বাঙালির দিন।

অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের শিরোপাজয়ী বাংলাদেশ দলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

মুজিববর্ষের প্রাক্কালে এই জয়ে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দল, কোচ, ম্যানেজার এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রাণঢালা অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “এই খেলোয়াড়ী মনোভাব ধরে রেখে এভাবেই ভবিষ্যতে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।”

এখানে আমার লেখাও ছিল আমাদের পারার ‘মনোবল’ নিয়ে। ‘আমরাও পারি’-এই সাহস আর আত্মপ্রত্যয় নিয়ে। বঙ্গবন্ধুকণ্যা শেখ হাসিনাও তাঁর অভিনন্দন বার্তায় ‘মনোভাব’-এর কথা বলেছেন। এবং আত্মবিশ্বাস নিয়েই তিঁনি যেভাবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে এসেছেন-আমাদেরও সাহস আর বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। বাঙালি ও বাংলাদেশের এ পারার, এ জয়ের অভিনন্দন বার্তায় ছয়লাভ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও। বিশ্ব ক্রিকেট তারকারাও বাংলাদেশ ও উদ্যোমী ক্রিকেটারদের অভিনন্দন জানাতে ভুল করেননি।

সাবেক ভারতীয় স্পিনার হরভজন এ আকর্ষণীয় ফাইনাল দেখে মুগ্ধ, ‘অনূর্ধ্ব-১৯ দলের দুর্দান্ত একটা ফাইনাল ছিল এটা। অভিনন্দন, বিসিবি টাইগার্স বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য। টিম ইন্ডিয়ার চিন্তার কোনও কারণ নেই, তোমরা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতোই খেলেছো।’

অন্যদিকে এ ট্রফি আকবরদের প্রাপ্য বললেন ধারাভাষ্যকার হার্শা ভোগলে, ‘এটি বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য একটি বিশাল মুহূর্ত। আজ বাংলাদেশ যেভাবে খেলেছে তাতে ট্রফিটা তাঁদেরই প্রাপ্য।’
ভুলে যায়নি ভারত ক্রিকেট বোর্ডও। বিসিসিআই অভিনন্দন জানিয়েছে বাংলাদেশকে, ‘ভালো লড়াই করেছো টিম ইন্ডিয়া। বিশ্বকাপের ফাইনালে দারুণ সমাপ্তি, অভিনন্দন বাংলাদেশ।’

আবার পাকিস্তানের অলরাউন্ডার শোয়েব মালিকও প্রশংসা করেছে। ‘অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বিজয়ী হওয়ার জন্য অনেক অভিনন্দন। আমি টুর্নামেন্টটি খুব কাছ থেকে দেখেছি এবং দেখে মনে হচ্ছে বিশ্বের অনেক তরুণ প্রতিভা এখান থেকে উঠে আসছে। তাঁদের অগ্রগতি দেখতে আমি উন্মুখ হয়ে আছি। তবে আপাতত ছেলেরা উদযাপন করুক’ -বলে সে তাঁর টুইট বার্তায় অভিনন্দন জানিয়েছে। সাথে যোগ হয়েছে পাকিস্তানের নারী দলের ক্রিকেটার সানা মীরও। বাংলাদেশের প্রশংসায় অভিনন্দন বার্তায় তুলে ধরেন, ‘বিশ্বকে শক্তিশালী বার্তা দিলো বাংলাদেশের ক্রিকেট। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের নতুন চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দল।’

‘বিশ্বকাপ জেতার জন্য বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে অভিনন্দন। ক্রিকেটের জন্য অবশ্যই দুর্দান্ত কিছু করা উচিত’ -বলে মন্তব্য করে ভারতের সাবেক ক্রিকেটার ইরফান পাঠানও তাঁর অভিনন্দন জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশি ক্রিকেট তারকা থেকে আরম্ভ করে ক্রিকেটভক্তকুল বাঙালির ক্রিকেট এই জয়ের আনন্দ নিয়ে ভাসছে। সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, গবেষক ও সকল শ্রেণিপেশার মানুষজনসহ সেই দুরের গ্রামের ছোট্ট কিশোরও বাংলাদেশের এই জয়ে নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি।

আমাদের আটকে রাখা সম্ভব নয়। আমরা দুর্দান্ত। আমরা উদ্যোমী। আমরা উড়ে যাবো দেশ থেকে দেশান্তরে। আমরা জয় করবো আমাদের স্বপ্নকে। আমাদের পূর্বের নারী-পুরুষদের সর্বস্ব ত্যাগে অর্জিত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাবো। মুক্তিযোদ্ধার বাংলাদেশ, আমাদের বাংলাদেশ নিয়ে আমরাই গর্ববোধ করবো। কারণ, আমাদের আছে শেখ হাসিনার মতন ব্যক্তিত্ব। পিতার মতন নিপীড়িত, নির্যাতীত মানুষের পাশে দাঁড়াতে সাত-সমুদ্র-তের নদী পাড়ি জমাতেও তাঁর ক্লান্তি নেই। বিশ্ব নেতাদের সামনে সত্য ও সোজা কথা বলতে, মানুষ ও মানবতার সেøাগান ধরতে শেখ হাসিনাও এক দৃষ্টান্ত। আমরা তাঁরই উত্তরসুরী।

পিতা মুজিব আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন, বাঙালিরা বীরের জাতি। বাঙালিরা একত্রিত হয়ে সকল কিছু জয় করতে পারে। যে বাঙালি তাঁদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মুক্তির সংগ্রামে সমবেত হয়ে অধিকার অর্জন করতে পারে, যে জাতি সকল অন্ধকারের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে পারে-এ জাতিকে কে দাবায়ে রাখার ক্ষমতা রাখে?

বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ যুব বিশ্বকাপ জয়ের এই দিনে বঙ্গবন্ধুর বাঙালির ‘জয় বাংলা’র জয় হয়েছে, জয় হয়েছে আমাদের আত্মপ্রত্যয় ও সাহসের। এই প্রাপ্তি বাঙালি জাতিকে দিয়েছে ক্রিকেট বিশ্ব বিজয়ের গৌরব। অভিনন্দন টাইগারস। অভিনন্দন বাংলাদেশ ক্রিকেট।

আসুন, আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে বাংলা মায়ের বিজয়ে সমস্বরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গান গাই-

‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!
ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।।’


লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট ফোরাম (বোয়াফ)।