রহিম আব্দুর রহিম


ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের সাইন্স এনেক্স ভবন, মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারের মধ্যবর্তী এলাকায় বিশাল বেদী ও ৬ স্তম্ভ সম্বলিত আমাদের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ’৫২-র ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত এই শহীদ মিনার জাতির সকল আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্র বিন্দু হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। একুশের কাক ভোরে লাখ মানুষের পদচারনায় যে প্রাঙ্গন হয়ে ওঠে মুখরিত জাতীয় ইস্যু ও উৎসবে এই প্রাঙ্গন উদ্বেলিত। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যেসব বীর ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুর গুলির আঘাতে বুকের রক্তে ঢাকার মাটির রঞ্জিত করেছিলেন, তাঁদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার উদ্দেশ্যে, প্রথম শহীদদের রক্ত যেখানে ঝড়েছে, সেই স্থানে ‘৫২-র ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে ছাত্ররা একটা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন, যা পরবর্তীতে শহীদ মিনার হিসাবে ইতিহাসে স্বাক্ষ্য বহন করছে । কিন্তু ভীত প্রশাসন ২৬ ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ ও সামরিক বাহিনী শহীদ মিনারটি নিশ্চিহ্ন করে দেয়। অবশিষ্ট থাকে শুধু একটি ব্লকের বেড়ায় আটকানো, একটি পোস্টার ‘বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা এর যত মূল্য সে কি ধরায় ধুলায় হবে হারা।’

মহান একুশের কবিতা রচিত হয়েছিল তাৎক্ষনিক আবেগে। কিন্তু ওই সময় প্রয়োজন ছিল গানের। তাই একটি কবিতাকে করা হয় গান। আবদুল গাফফার চৌধুরীর কবিতা “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি।” এই কবিতাটি প্রথম আবৃত্তি করা হয় ধুপখোলার মাঠে, যুবলীগের এক উন্মুক্ত অনুষ্ঠানে। পরে এই কবিতার প্রথম সুরারোপ করেন আবদুল লতিফ। আবদুল লতিফের সুরে গানটি প্রথম পরিবেশিত হতে থাকে আতিকুল ইসলামের কন্ঠে। এরপর আলতাফ মাহমুদ গানটি নতুন করে সুরারোপ করেন। বর্তমানে আলতাফ মাহমুদের সুরেই গানটি গীত হচ্ছে।

১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারের সকল চিহ্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পর ‘৫৬-তে আবু হোসেন সরকারের মূখ্য মন্ত্রীত্বের আমলে একুশে ফেব্রুয়ারি সকাল বেলায় মুখ্যমন্ত্রী মিনারের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করবে, এ সংবাদ তাৎক্ষনিকভাবে ছাত্র জনতার মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এমনকি মিনার এলাকায় ছাত্র-জনতার ঢল নামে।

উপস্থিত জনতা মিনার এলাকায় এসেই দেখতে পান, জনৈক পূর্তমন্ত্রী মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু বিপুল সংখ্যক জনতা এতে প্রবল আপত্তি জানান । ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ রিকশাচালক আওয়ালের ৬ বছর বয়স্কা কন্যা বসিরনকে দিয়ে জনতা এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করায়। কিন্তু সরকারি আনুষ্ঠানিকতায় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার, আওয়ামীলীগের তৎকালীন সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং শহীদ বরকতের মাতা হাসিনা বেগমকে দিয়ে। উল্লেখ্য যে, আনুষ্ঠানিক ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনে আবু হোসেন সরকার জুতা পায়ে আগমন করলে উপস্থিত জনতা ক্ষ্যাপে যান। পরে তিনি জুতা খুলতে বাধ্য হন।’ যার কারণে পরবর্তীতে কেউ জুতা পায়ে মিনার বেদীমূলে যেতে সাহস পায়নি। এখনো এ রেওয়াজ যথারীতি চলছে।

সাতান্ন সালের ৩ এপ্রিল আইন সভায়, ‘বাংলা একাডেমী এ্যাক্ট-১৯৫৭’ পাশ করা হয়। ওই সময় শহীদ মিনারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে তদানীন্তন চীফ ইঞ্জিনিয়ার এম এ জব্বারের ওপর। জব্বার সাহেব এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন তখন লন্ডন ফেরত শিল্পী হামিদুর রহমানকে মিনারের একটি মডেল তৈরি করতে বলেন। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে গৃহীত শিল্পী হামিদুর রহমানের পরিকল্পনা অনুযায়ী সাতান্ন সালের নভেম্বর মাসে শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং একটানা কাজ চালিয়ে ৫৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির মধ্যে শহীদ মিনারের মূল বেদী এবং তিনটি স্তম্ভ তৈরি সমাপ্ত হয়। এরপর ‘৬২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর লে: জেনারেল আজম খান, পরিকল্পিত মিনারটি পুন:নির্মানের জন্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড: মাহমুদ হোসেনকে সভাপতি করে চৌদ্দ সদস্যের কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটির পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী শহীদ মিনারটি স্থাপন করার সুপারিশ করলে তা পুরোপুরি কাজে লাগে না। ছোট আকারে ১৯৬৩ সালের ২০ ফেবুয়ারির মধ্যে শহীদ মিনারের কাজ শেষ করা হয়। ‘৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নবনির্মিত এই শহীদ মিনারটির উদ্বোধন করেন শহীদ আবদুল বরকতের বাহাত্তর বছর বয়স্কা মাতা হাসিনা বেগম। ১৯৬৩ থেকে ‘৭১ সাল পর্যন্ত এই মিনাটর বাঙালির সকল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ বাংলাদেশে গণহত্যা শুরুর এক পর্যায়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ২৬ ও ২৭ মার্চ ভারী গোলা বর্ষণ করে শহীদ মিনারের স্তম্ভগুলি ধ্বংস করে দেয়। স্বাধীনতার পরে ‘৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ তাদের প্রথম শহীদ দিবস পালন করেছিলেন ওই ভাঙা শহীদ মিনারেই। ১৯৭২ -এর জানুয়ারীর মাঝামাঝি সময় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে সভাপতি করে শহীদ মিনার পুন:নির্মানের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি কেবলমাত্র স্থপতিদের কাছ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নকশা ও পরিকল্পনা আহ্বান করেন। শিল্পী হামিদুর স্থপতি ছিলেন না বলেই তিনি বিশিষ্ট স্থপতি এম এস জাফরের সঙ্গে মিলিতভাবে একটা সংস্থা গঠন করে নকশা প্রণয়ন করেন। সরকারি অনুমোদন থাকলেও ওই সময় তাদের তৈরি মডেলে শহীদ মিনার নির্মিত হয় নি। এরশাদ আমলে এই মডেল অনুযায়ী বর্তমান শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়।

জাতীয় শহীদ মিনার নির্মাণের ক্ষেত্রে মডেল যথাযথ অনুসরণ এবং তা সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদের সকলের। সবচেয়ে বড় কথা এখনো শহীদ মিনার আঙ্গিনায় বিদেশী ভাষায় স্লোগান চলছে। কোন দল, গোষ্ঠি, ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে নয়; বলতে চাচ্ছি, ‘জিন্দাবাদ,’ এই শব্দটি যেমন বিদেশী শব্দ তেমনি ‘জয়বাংলা’ শব্দটি মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনার স্বাক্ষর। অথচ আমরা ভাষা আন্দোলনের মূল স্পীরিট বর্জন করে রাজনৈতিক সংর্কীণতার পরিচয় দিচ্ছি। ডানপন্থি, বামপন্থি, মধ্যপন্থি সবাই আমরা মাতৃভাষার চেতনা থেকে দূর বহুদূরে অবস্থান করছি। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষায় রায় লেখার নির্দেশনা আসে। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে ইংরেজির সাথে বাংলা সন তারিখ লেখার রিট আবেদন উচ্চ আদালতে হওয়া, বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত সু-খবর কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্লোগান বাংলায় হোক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মাখা কবি কাজী নজরুল ইসলামের ঐতিহাসিক চরণ ‘জয়বাংলা’ স্লোগানটি জাতীয় স্লোগানে পরিণত হওয়ার রিট কত দূরে........?


লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, নাট্যকার ও শিশু সংগঠক ।