আব্দুর রইচ সেরনিয়াবাত


বিশ্বের যে কোন মানুষের কাছেই তার মাতৃভাষা তার কাছে সবচেয়ে বেশী স্বাচ্ছন্দের, আকর্ষণীয়, মর্যাদাপূর্ণ, অহঙ্কার ও শ্রেষ্ঠ গৌরবের। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। আমার ভাষাও আমাদের কাছে মাতৃ সমতুল্য। বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষা সুবিস্তারে অন্যতম ভাষা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় আমরা গর্বিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিপুল সংখ্যক বাংলা ভাষার লোক বসবাস করছে।

বাংলাভাষা আজ আন্তর্জাতিক ভাষা হিসাবে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সেক্ষেত্রে আমাদের মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার গৌরব সমগ্র বাঙালী জাতির। ২১ শে ফেব্রুয়ারী আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রূপে মানব সভ্যতার অহংকারের অংশ। বিশ্বখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র তত্ত্বমতে পৃথিবীতে ২৭৯৬ টি ভাষার অস্তিত্ব আছে। তবে প্রকৃত ভাষার পরিসংখ্যান নির্র্ণিত নাই। মাতৃভাষা মানুষের জন্মগত স্বীকৃত অধিকার মানুষের মাতৃভাষার অনুরাগ চিরকালীন। শাশ্বত বর্ণিল এ পৃথিবীকে আরো স্বপ্নিক আকর্ষনীয় আলোকিত করতে বাংলাভাষার প্রতি আমাদের মমত্ববোধ যেকোন ভাষার চেয়ে একাত্বই অনেক বেশি।

দেশের জন্য আত্মত্যাগ, যুদ্ধে প্রানোৎসর্গ করার ঘটনার নজির থাকলে ও মাতৃভাষার জন্য কোন জাতি তার জীবনকে বিসর্জন দিয়াছে শহীদ হয়েছে এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নাই। পাকিস্তান তথা পূর্ব পাকিস্তানের আইন পরিষদে রাষ্টভাষা উর্দু করার প্রস্তাব হয়। এ ক্ষেত্রে ষাটের দশক ও আশির দশকে বাঙলী জাতির ইতিহাসে অধিকতর অনন্যা সাধারণ আন্দোলনের পথকৃত। ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সূচনায় সেদিনের বাঙলীর কন্ঠে রণ ধ্বণী- ওরে ও বাঙালী ঢাকা শহর রক্তে রাঙালী। এ আন্দোলনের প্রাণশক্তি ছিল মুলত ছাত্ররাই আর সে আন্দোলনে সমগ্র বাঙালী জাতিই উদ্বুদ্ধ হয়। মাতৃভাষাই বাংলাভাব অধিকার আদায় ও স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলনে। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারী ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে যাত্রা শুরু করেছিল।

স্কুল, কলেজ, বিশ্ব বিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীরা দলে দলে সমবেত হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছাত্রীরাই এই আন্দোলন পরিচালনায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। আর এ আন্দোলন ছড়িয়ে পরে ঢাকা ছাড়িয়ে জেলা মহাকুমা, থানা পর্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে আন্দোলন ছড়িয়ে পরে সমগ্র জায়গায় এবং বাঙলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে সর্বস্তরের জনগণকে সচেতন ও সংগঠিত করার আন্দোলন ছড়িয়ে পরে। পাকিস্তানিরা বাঙালীদের অধিকার রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। শত শত রাজনৈতিক নেতাদের বন্দি করা হয় শেখ মুজিবুর রহমান তার মধ্যে থেকে জেল খানায় অনশন পালন করেন। পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল বাঙালী।

এককথায় পাকিস্তানে রাষ্ট্রটির জন্মালগ্নেই বাঙালীরা ছিল গণতন্ত্র মৌলিক অধিকার মানবাধিকার অর্থনৈতিক সাম্যের লক্ষ্যে সোচ্চার। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান গঠিত হওয়ার অল্প কিছুদিন পরেই পূর্ব পাকিস্তানের অংশের মানুষ তথা বাঙালি জাতিকে চিরতরে দাবায়ে রাখার জন্য সর্বপ্রথম আঘাত হানে বাংলা ভাষার উপরে। তারই ফলশ্রুতিতে উর্দূকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার ঘোষনা দেয়। অথচ উর্দু পাকিস্তানের কোন অংশেরই বৃহৎ জগগোষ্ঠেরই ভাষা নয়। উর্দু ভাষা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৬-৭ ভাগ বিহারিদের ভাষা। জনসংখ্যার ৫৪ ভাগ ছিল বাঙালী।

১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালীরা রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে পাকিস্তানিদের দমন নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়। ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে ১৯৫২ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান মানুষেরা তোলপাড় করা বিজয় অর্জন করে। জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক, তরুণ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বিজয়ের নেতৃত্ব দেন। বাঙালীদের এ বিজয় সহজভাবে মেনে নিতে পারে নাই বলেই পাকিস্তানী শাসকরা বাঙালী জাতির অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইউব খাঁন পাকিস্তানের প্রথম সামরিক আইনজারি করে। তারই ধারাবাহিকতায় বাঙালী জাতির কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সাহিত্য সর্বপরি মাতৃভাষা বাঙলা ভাষার উপর নানাভাবে জুলুম নির্যাতন চালাতে থাকে অর্থনৈতির বৈষম্য পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তথা বাঙালীদের
ক্ষুদ্ধ করে তোলে। বাঙালীরে ধ্বংস করতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পরে পশ্চিমা হায়েনারা।

বর্তমান বাংলাদেশের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলের ছাত্র-তরুণ-যুবকসহ সমগ্র জনগণ পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পরে ১৯৬২ ও ১৯৬৪ শিক্ষা আন্দোলন তীব্র গণআন্দোলনে রূপ নেয়। ১৯৬৫ পাক-ভারত যুদ্ধে প্রমানিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করতে পারবেনা। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্বশাসনের ছয় দফা ঘোষনা দেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেককে পাকিস্তানিরা গ্রেফতার করে। বাঙালী জনগণ ক্ষুদ্ধ হয়ে জোট ও একই সঙ্গে ছাত্ররাও ১১ দফা দাবি আদায়ের আন্দোলনে তীব্রতর গণআন্দোলন গড়ে তোলে। ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনই হচ্ছে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূথান। আর ২৪ জানুয়ারি সর্বাত্মক হরতালের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের মূল ভিত নড়ে ওঠে। মুক্ত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দেশব্যাপী প্রচারে জনপ্রিয় করে তোলে।

তৎকালীন ডাকসুর সহ-সভাপতি তোফায়েল আহম্মদ নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৮ বঙ্গবন্ধুসহ বহু নেতাদের নামে সামরিক বাহিনী আইয়ুব শাহী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করেছিল। সর্ব ষড়যন্ত্র বাঙালীদের আন্দোলনের দাবানলে পাকিস্তানি তর্লতে তাউদ কেপে ওঠে। ৬৯ গণ আন্দোলনের ফলশ্রুতিতেই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে ও বাঙালীদের কাছে পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্থান্তর না করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে এদিকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালীদের আন্দোলন এক দফা আন্দোলনে রুপ নেয়। সর্বপরিই বাঙালী জাতির তখন একজনই নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই নেতার নির্দেশই মুলত পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ জীবন যাপন আন্দোলন করছে। আর এই আন্দোলনের মূল দাবি একটাই সেটা হলো স্বাধীনতা।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানীদের কাছে মাথানত না করে বাঙালী জাতির অধিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের চুড়ান্ত ঘোষনা দেন সকল প্রস্তুতি নিয়ে। ১৯৭০ সালের ৭ মার্চে ঢাকার রেসকোর্চ বর্তমান সোহরোয়ার্দী উদ্দ্যানে ১০ লক্ষাধিক মুক্তি পাগল বাঙালীদের মাঝে ঘোষনা দেন এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয়বাংলা। আর এই আহবানের মাধ্যমে ২১শে ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ সালের শহীদের রক্তের পথ ধরে ২১ এর চেতনায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ঝাপিয়ে পরে। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের ও ত্যাগের যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি তা সুচিত হয়েছিল ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদদের দেখানো পথ ধরে একুশের চেতনায়।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, চেয়ারম্যান, আগৈলঝাড়া উপজেলা পরিষদ।