স্টাফ রিপোর্টার : সাহেব উল্লাহ্। নিজ বাড়ির ড্রয়িং রুমে দুই নাতিকে কোলে নিয়ে বসা ছিলেন। বয়স জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘আশির ওপরে।’ কথা হচ্ছিল চকবাজারের চুড়িহাট্টার আগুন নিয়ে। বলছিলেন, তার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিন ছিল ওটা। আরও নানা বিষয়ে কথা বলছিলেন। অনর্গল কথার মাঝে আবার থেমে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ উঠে যাচ্ছিলেন, দেয়ালে ঝুলানো ছবি দেখিয়ে দুই ছেলের কথা বলছিলেন। তাদের ব্যানারের দিকে আঙুল উচিয়ে দেখাচ্ছিলেন।

গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে কেমিক্যাল বিস্ফোরণে ঝরে যাওয়া ৭১ টি তাজা প্রাণের মধ্যে তার দুই ছেলে রানা ও রাজুও ছিলেন। মুহূর্তেই উপার্জনক্ষম দুই ছেলেকে হারিয়ে এই বয়সেও পরিবারের একমাত্র সাহসদাতার কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।

১৮/২০ নম্বর কেবি রুদ্র রোডের বাড়ির ৫ তলার ওই বাসায় মঙ্গলবার দুপুরে তার সঙ্গে কথা হয়। দুই ছেলের ঘরের দুই নাতিকে নিয়ে দিন কাটে তার। বললেন, একবছরে অনেক জায়গায় গিয়েছি, অনেক কিছু করেছি, কিন্তু দুই ছেলেকে হারানোর সেই ভয়াল রাত ভুলতে পারিনি।

বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে বলেন, দুর্ঘটনার পর সহায়তার জন্য সরকার এবং অনেকে পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু এখন আর কেউ খোঁজ-খবর নেয় না। এই দুজনকে (দুই নাতিকে দেখিয়ে) নিয়েই বেঁচে আছি। আমি ছাড়া ওদের কে দেখবে!

রানা-রাজুর ফোন-ফ্যাক্সের দোকান ছিল। আগুনে পুড়ে একসঙ্গেই মৃত্যু হয় তাদের।

দুই ছেলের বিষয়ে জানতে চাইলে আপ্লুত বাবা বললেন, আমার ছেলেরা চুড়িহাট্টাবাসীর গর্ব ছিল। সবার বিপদে-আপদে দৌড়ে যেত। দুই ভাইয়ের মধ্যে অসাধারণ মিল ছিল। একে অপরকে ছাড়া কোথাও যেত না। নিজেদের ফোনের দোকানেই একসঙ্গে প্রাণ গেছে ওদের।

জন্মের পর দুই ভাতিজা রানা-রাজুর নাম রেখেছিলেন চাচা এম এ রহিম। তিনি বললেন, আগুন লাগার ৮-১০ মিনিট আগে ওই দোকান থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। নাহলে ওদের সঙ্গে আমাকেও মরতে হত।

সেই রাতে রাজধানীর চকবাজারে চুড়িহাট্টার মোড়ে কেমিক্যাল গুদামে বিস্ফোরণে ওয়াহেদ ম্যানশনসহ পার্শ্ববর্তী ৪টি ভবন পুড়ে যায়। আগুনে ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান ৬৭। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে আরও ৪ জনের মৃত্যু হয়।

মামলার সর্বশেষ অবস্থা

আগুনের ঘটনায় চকবাজারের ওয়াটার ওয়ার্কস রোডের ৩২/৩৩ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা মো. আসিফ চকবাজার থানায় একটি অবহেলাজনিত মৃত্যুর মামলা করেন। মামলার এজাহারে আগুনের জন্য ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে মো. হাসান ও সোহেল ওরফে শহীদসহ অজ্ঞাত ১০-১২ জনের অবহেলাকে দায়ী করা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, চারতলা বাড়ির বিভিন্ন ফ্লোরে দাহ্য পদার্থ ছিল। মানুষের জীবনের ঝুঁকি জেনেও অবৈধভাবে রাসায়নিক গুদাম করার জন্য ব্যবসায়ীদের কাছে বাসা ভাড়া দেন তারা।

মামলার প্রধান দুই আসামি হাসান ও সোহেল ইতোমধ্যে আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। তবে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই এই মামলায়। এ বিষয়ে মামলার বাদী মো. আসিফ আহম্মেদ বলেন, ‘১ বছরেও মামলার কোনো অগ্রগতি নেই, এটা দুঃখজনক।’

জানতে চাইলে চকবাজার থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) কবির হোসেন বলেন, ‘মামলার প্রধান দুই আসামি জামিনে রয়েছেন। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামাদের তিনজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বিলম্বের জন্য চার্জশিট বিলম্ব হচ্ছে। আমাদের তদন্ত প্রায় শেষপর্যায়ে।’

এদিকে বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) পুলিশের কাছে নিহতদের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট জমা দিয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ। রিপোর্ট প্রদানে বিলম্বের বিষয়ে ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার সোহেল মাহমুদ বলেন, আমরা টিমওয়াইজ করে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করি। এর মধ্যে ডিএনএ’র নমুনা সংগ্রহ করে এগুলো সিআইডিতে পাঠানো হয়। ওসব রিপোর্ট আসতে দেরি হওয়ায় এবং ময়নাতদন্তকারী টিমের কারও কারও বদলি হওয়ার কারণে রিপোর্ট প্রস্তুত হতে দেরি হয়েছে। আমরা গত সপ্তাহে ডিএনএ রিপোর্ট পেয়েছি, তাই ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন প্রস্তুত হতে কিছুটা সময় লেগেছে।

চুড়িহাট্টা ও পুরান ঢাকার বর্তমান অবস্থা

এক বছর আগে চুড়িহাট্টায় কেমিক্যালের কারণে আগুন লাগায় বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পুরান ঢাকার আবাসিক ভবন থেকে কেমিক্যাল তুলে দিতে অভিযান চালায়। জব্দ করা হয় কেমিক্যাল, জরিমানা করা হয় অনেকভবন মালিককে।

তবে বুধবার পুরান ঢাকার আরমানিটোলা, শাবিস্তান হল গলি, বংশাল, মাহুৎটুলি, নাজিম উদ্দীন রোড, মিডফোর্ড ঘুরে অসংখ্য আবাসিক ভবনের নিচে কেমিক্যাল তুলতে দেখা গেছে। এমনকি চুড়িহাট্টায়ও দেখা যায় একই চিত্র।

স্থানীয়রা বলছেন, অভিযানের ২-১ মাস পর থেকেই এলাকার আবাসিক ভবনে রাতের আধারে কেমিক্যাল মজুত শুরু হয়। তবে এরপর থেকেই পুলিশের সামনেই দিনের আলোতেই কেমিক্যাল রাখা হয়। অবস্থার পরিবর্তন না হলে আরও বড় বিস্ফোরণ অপেক্ষা করছে পুরান ঢাকাবাসীর জন্য।

(ওএস/এসপি/ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২০)