রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : ওয়াজ মাহফিলে আটককৃত সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য প্রদানকারীকে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার নাম করে তিন লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল লতিফ ও সাতক্ষীরা সদরের লাবসা ইউনিয়নের সভাপতি শেখ মুস্তাফিজুর রহমান শাহানেওয়াজের বিরুদ্ধে। বিষয়টি জানতে পেরে গত সোমবার বিকেলে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ডেকে ভৎসনা করার পাশপাশি টাকা ও চেক ফেরত নেওয়া হয়েছে তাদের কাছ থেকে। এ ঘটনা সাতক্ষীরায় টক অব  দা টাউন হিসেবে আলোচিত হচ্ছে।

স্থানীয় দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গত রবিবার ও সোমবার সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ভাড়–খালি ফুটবল মাঠে ভাড়–খালি হিফজুল ফোরকাহানিয়া মাদ্রাসা তাফছিরুল কোরান মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এ উপলক্ষে বক্তা হিসেবে বগুড়ার আব্দুল্লাহ আল আমিনকে দেড় ঘণ্টা ওয়াজের জন্য ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা বলা হয় ।

অনুষ্ঠানে জেলা আওয়ামীলী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মুনসুর আহম্মেদ ও সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলামকে অতিথি হিসেবে থাকার জন্য দাওয়াত দেওয়া হয়। করা হয় মাইকিং। মাহফিল আয়োজক কমিটির সভাপতি ছিলেন নুরুল ইসলাম। যদিও আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সভায় আসেননি।

ঘোনা ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোত্তাছিম বিল্লাহ ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি আব্দুল কাদের বলেন, রবিবার এক ঘণ্টা ২০ মিনিট ওয়াজ শেষে আব্দুল্লাহ আল আমিন মঞ্চ থেকে নামার সাথে সাথে সদর থানার সহকারি উপপরিদর্শক নূর নবী তাকে ডেকে নিয়ে ভাড়–খালি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে নিয়ে যান।

রাষ্ট্র ও সরকার বিরোধী বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে তাকে আটকে রেখে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে খবর দেওয়া হয়। ডিবি পুলিশের দু’ কর্মকর্তা চলে আসার পরপরই সেখানে হাজির হন সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান ও তদন্ত ওসি আবুল কালাম আজাদ। ওয়াজের কিছু অংশ অডিও রেকডিং শোনার পর আল আমিনকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে সাতক্ষীরা পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হয়।

এ সময় কোন ভিডিও রেকর্ডিং থাকলে তা নিয়ে পরদিন সোমবার সকালে তাদের দু’জন ও মাহফিল আয়োজ কমিটির কয়েকজনকে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে যেতে বলেন থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। সে অনুযায়ি সোমবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তারা দু’জনসহ ভাড়–খালির নূর মোহাম্মদ মুক্ত, নাজমুর রহমান মিন্টু, মাহফিল আয়োজক কমিটির সভাপতি নুর ইসলাম, কমিটির সদস্য বাসারত হোসেন, ভাড়–খালি মাধমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিদ্দিকুর রহমান, গোলাম কিবরিয়া, মাষ্টার আমিনুর রহমান ও আব্দুল্লাহ আল বাকীসহ কয়েকজন পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আসেন। পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান তাদের সঙ্গে থাকা ল্যাপটপে আব্দুল্লা আল আমিনের ওয়াজের ভিডিও ফুটেজ দেখেন।

ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৬৯ সালের মামলা ১৯৮৫ সালে নতুন জন্ম হয়েছে। আবু জেহেল বিনা ভোটে মক্কার কাবা শরীফের চাবি পেয়েছেন। জোয়ার আসলে ভাটা হয়, ভাটা আসলে পানি থাকে না, মাছ ছটফট করে মারা যাবে। ৫০ বছরের মামলার এখন বিচার হচ্ছে অথচ এখন রাস্তা ঘাটে লাশ পড়ে থাকলেও বিচার হচ্ছে না। এসব ছাড়াও বিভিন্ন আপত্তিকর বক্তব্য দেন আব্দুল্লাহ আল আমিন। এ বক্তব্য দেওয়ায় কোন প্রতিবাদ না করায় তাদেরকে ভৎসনা করেন পুলিশ সুপার।

এদিকে শুক্রবার বিকেলে ০১৭১২-০৫৩৬৮৮ নং মোবাইল ফোনে এ প্রতিবেদককে আব্দুল্লাহ আল আমিন বলেন, তাকে আটক করে নিয়ে আসার পরপরই জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও জজ কোর্টেও পিপি পরিচয়ে খাটাল লতিফ এবং লাবসা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও অতিরিক্ত পিপি পরিচয়ে শেখ মুস্তাফিজুর রহমান শাহনেওয়াজ পরিচয়ে তাকে মুক্তির জন্য সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ডিবি পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করতে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেন।

একপর্যায়ে তার ফুফাত ভাই যশোরের রবিউল ইসলামের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়া হয়। রবিউল নগদ দেড় লাখ টাকা ও দেড় লাখ টাকার একটি চেক নিয়ে সোমবার দুপুরে সাতক্ষীরায় আসেন। ওই টাকা ও চেক দেওয়া হয় লতিফ ও শাহানেওয়াজের হাতে। দুপুর আড়াইটার দিকে রবিউল ডিবি পুলিশের কার্যালয়ে গেলে তার কাছে টাকা চাওয়া হয়। টাকা লতিফ ও শাহনেওয়াজকে দেওয়া হয়েছে বলায় ডিবি পুলিশ ক্ষুব্ধ হয়ে রবিউলকে একটি ঘরের মধ্যে আটক রাখে।

ডিবি পুলিশের পক্ষ থেকে বিষয়টি পুলিশ সুপারকে অবহিত করা হয়। এতে ক্ষুব্ধ পুলিশ সুপার লতিফ, শাহানেওয়াজকে প্রথমে ও পরে রাসেল নামের এক কলেজ শিক্ষককে সোমবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে তার কার্যালয়ে ডাকান। এ সময় তাকে ও তার ফুফাত ভাইকে তাদের সামনে হাজির করিয়ে টাকা ও চেক লেনদেনের সত্যতা যাঁচাই করা হয়। ঘটনার সত্যতা প্রমান পাওয়ায় লতিফ ও শাহানেওয়াজকে কঠোর অপমানের স্বীকার হতে হয়। পুলিশের নামে নেওয়া টাকা ও চেক ফেরৎ দিতে বাধ্য হন লতিফ ও শাহনেওয়াজ। পুলিশ সুপারের হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চান ওই দু’ নেতা। আপত্তিকর বক্তব্য দেওয়ার জন্য ক্ষমা চেয়ে মুচলেকা দিলে রাত ৯টার দিকে তাকেসহ রবিউলকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর আগে ফিরিয়ে দেওয়া হয় ওই টাকা ও চেক।

জানতে চাইলে লাবসা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জজ কোর্টের অতিরিক্ত পিপি শেখ মুস্তাফিজুর রহমান শাহনেওয়াজ শনিবার সকালে সাংবাদিকদের কাছে মুঠোফোনে তার বিরুদ্ধে তিন লাখ টাকা ও চেক নেওয়ার আনীত অভিযোগ অস্বীকার না করেই বলেন, বিষয়টি মীমাংসা হয়ে গেছে। এ নিয়ে আর কোন কথা লেখার দরকার নেই। (০১৭২১-৮০৪২৮৩)

জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও জজ কোর্টের পিপি অ্যাড. আব্দুল লতিফ শনিবার সকালে সাংবাদিকদের কাছে মুঠোফোনে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করেই বলেন, ভাড়–খালির মাহফিলে সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য দেওয়ায় পুলিশ আল আমিন হুজুরকে ধরে পুলিশ লাইনে নিয়ে যায়। হুজুরকে ছাড়াতে পুলিশের নাম করে তার বিরুদ্ধে টাকা নেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে সোমবার বিকেলে তাকে ও শাহানেওয়াজকে নিজ অফিসে ডেকে পুলিশ সুপার জানতে চান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। (০১৭১২০১০৬৯২)

সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান ভাড়–খালি ওয়াজ মাহফিলে আব্দুল্লাহ আল আমিনকে রাষ্ট্র ও সরকার বিরোধী বক্তব্য দেওয়ার ঘটনায় জ্ঞিাসাবাদের জন্য আটক ও নিঃশর্ত ক্ষমা ও মুচলেকা দিয়ে মুক্তির বিষয়টি সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেই বলেন, লতিফ ও শাহানেওয়াজ হুজুরকে ছাড়ানোর জন্য পুলিশের নাম করে টাকা নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ সুপার তাদেরকে ডেকেছিলেন বলে তিনি শুনেছিলেন। এর বাইরে তিনি কিছু জানেন না।

(আরকে/এসপি/ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২০)