মানিক বৈরাগী


বাংলা ভাষার জনপ্রিয় কবি, উত্তর আধুনিক তাত্ত্বিক ও দার্শনিক তপোধীর ভট্টাচার্য সম্প্রতি বাংলাদেশে সফরে আসেন। তিনি বেশ ক'টি সেমিনার সিম্পোজিয়ামে বক্তব্য রেখেছেন। এসব তাঁর আনুষ্ঠানিক সভা ও সেমিনার। তিনি চট্টগ্রামের সেমিনারে বক্তব্য রাখেন। এরপর কক্সবাজার সমুদ্র দর্শনে এলেন সস্ত্রীক। সাথে ছিলেন সাংবাদিক নওজিশ আহমেদ।

আমাকে বাংলাদেশের উত্তর আধুনিক তাত্ত্বিক কবি অনুবাদক জিললুর রহমান মোবাইলে একটি চিরকুট দিলেন "তপোধীর ভট্টাচার্য এখন কক্সবাজার, আর তাঁর বাংলাদেশের মোবাইল নাম্বার।" এদিকে আমার সকাল হয় দুপুর একটায়। ঘুম থেকে জেগে প্রাতকর্ম সেরে আত্ম অন্নাহার সেরে শাহীনের জন্য বিশেষ খাবার তৈরি ও তাকে খাইয়ে দি। এরপর নিজের চা পান করতে করতে সাইলেন্ট করা মোবাইলের মিসডকল গুলো চেকিং করে, মোবাইলের ডাকবক্সে কোম্পানির অপ্রয়োজনীয় চিরকুট ডিলিট করছি, তাতে চোখ গেলো জিললুর ভাইয়ের চিরকুট এ। পড়ে তপোধীর দা'র মোবাইলে রিং দিলাম সাথে সাথে বৌদি তা রিসিভ করেন, নিজের পরিচয় দেয়ার সাথে সাথেই চিনে ফেলেছেন। হয়তো জিললুর ভাইয়ের পূর্বেই তাঁদের ব্রিফিং দিয়েছিলো। এরপর বৌদি মোবাইল দাদা কে দিলেন, দাদা বলাতেই তিনি হাস্যমুখে বল্লেন চলে এসো,আমি সৈকতের কলাতলি পয়েন্টের সাইমন বিচের ছাতার নিছে বসে আছি।

ওপ্রান্তে দাদা'র কথা শেষ হলে নিজের দৈহিক ও শাহীনের কথা বুঝিয়ে বল্লাম। এবং তাঁকে আমার বাসায় কবিতা আড্ডার দাওয়াত দিলাম। দাদা সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলেন। এরপর বল্লাম দাদা আমি আপনাকে সমুদ্রসঙ্গীত শোনানোর জন্য একজন কে পাঠাচ্ছি। আপনি সৈকতে কিটকট চেয়ারে আরাম করে বসে সমুদ্রপানে চেয়ে চেয়ে ঢেউ আর উচ্ছল নীল জলরাশি দেখবেন আর গান শুনবেন।

দাদা এ কথায় খুব খুশি হলেন, সাথে বৌদি কে ও জানালেন।তারপর সমুদ্রের সূর্যাস্ত দেখে আমার বাসায় ঝালমুড়ি, ছোলা, পিয়াজু খেতে খেতে আড্ডা চলবে। আড্ডার ফাকে চা কবিতা পাঠা আর গানের সুরে মজবো ঘন্টাদুয়েক। দাদা খুব খুশি আড্ডার কথা শুনে। আমি এর মধ্যে মোবাইলে কক্সবাজারে অবস্থানরত কয়েকজন কবি কে ফোনে তপোধীর দা'র আগমন ও আড্ডায় অংশ নিতে আহবান করলাম আমার বাসায়। আহবান করি সংস্কৃতি কর্মী, নাট্যজন, সংগঠক, সঙ্গীত শিল্পীদের।

বিষয় টি আমি শাহীন কে বিনয়ের সহিত জানালাম।দেখো বউ তোমার অসুস্থতার ভেতরে আমার একটা আড্ডার আয়োজন করতে হচ্ছে তপোধীর ভট্টাচার্য কক্সবাজার আগমন উপলক্ষে। চট্টগ্রাম থেকে কবি ডাক্তার জিললুর ভাই মোবাইলে মেসেজ দিয়েছে, দাদা'র কথা জানিয়ে। এখন বিষয় হচ্ছে তুমি তো আমার থেকে অসুস্থ, গতকাল হাসপাতাল থেকে এসেছো, তোমার কিছুই করতে হবে না।

আমরা নিজেরাই সব করবো, তোমার ক্ষেত্রে আমাদের আড্ডার কারণে হয়তো শব্দদুষণ হতে পারে,তবুও তোমার একটু সইতে হবে লক্ষী সরস্বতী। তিনি হাস্যজ্জোল মুখে সদয় হলেন। এরপর পুরো বিষয় টি আমার অত্যন্ত প্রিয় সজ্জন সঙ্গীত শিল্পী অজয় মজুমদার কে খোলে বল্লাম মোবাইলে। অজয় তখন বাসায় যেয়ে দুপুরের খাবার খাবে। প্রিয় অজয় তার বৌদি শাহীনের মতো সদয় হয়ে খাবার খেয়ে তার গিটার নিয়ে ছুটে যায় কলকতলি। তপোধীর ভট্টাচার্য কে খোজে তাঁর সাথে সঙ্গদিয়ে ঠিক সন্ধ্যা ছয়টায় দাদাকে আমার বাসার লোকেশন বুঝিয়ে দেয়।যাতে সহজে চিনতে পারে অজয়ের বন্ধু ছোটন কে দাদার সাথে দেয়। ছোটন দাদাকে সাথে করে আমার বাসায় নিয়ে আসে।

অজয়ের পর মনির মোবারক কে রিংদিলামা। বল্লাম তুই কই, সে বল্লো বলেন না,বল্লাম ভারতের বিখ্যাত তপোধীর ভট্টাচার্য এখন কক্সবাজার, কিছুক্ষণের মধ্যে আমার বাসায় আসবে, আমরা আড্ডা জমাবো তোর দল নিয়ে আসবি। গান শুনাবে আর আবৃত্তি করবে।

মনিরের সাথে কথা বলার সময় পেয়ে যাই সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সত্যপ্রিয় চৌধুরী দোলন কে।তাকেও দাওয়াত দিলাম। দোলন দা'কে বল্লাম তাপস রক্ষিত দাদা কে আসার সময় যেনো সাথে করে নিয়ে আসে।দোলন দা বল্লো তাপস দা আমার পাশে আছে ধরো কথা বলো বলে মোবাইলটা তাপস দা কে দিলো।

আমি তাপস দা কে সালাম দিয়ে তপোধীর ভট্টাচার্য এর কথা জানালাম। তিনি ও রাজি হলেন আসতে।এরা সবাই আমাদের বিখ্যাত পাল বাবুর মিষ্টির দোকান" পলস এন্ড সুইটস"এ বসে হয়তো আড্ডা দিচ্ছে।
এরপর শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার সুদীপ্তা চক্রবর্তী কে রিং দিলাম বল্লাম আপনার দল নিয়ে বাসায় আসবেন, ভারতের বিখ্যাত কবি তপোধীর ভট্টাচার্য এসেছেন কক্সবাজার। আপনি গান শুনাবেন আর আড্ডা দিবেন দাদা'র সাথে। আর আপনি আপনার একাডেমির সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ পাল বিষু কে জানাবেন এবংআমার বাসায় আসতে বলবেন।সুদীপ্তা রাজি।

কবিদের মধ্যে যাদের পেয়েছি এর মধ্যে আমার অগ্রজ কবি আসিফ নূর ও আলম তৌহিদ ভাইকে পেলাম। তারাও আড্ডার খবরে আড্ডা দিতে সম্মতি জানানোর পর,কবি শান্তনু মনির, উন্নয়ন কর্মী হেলাল আজাদ কে রিং দি,কবি মহিউদ্দিন আজাদ সহ বেশ কয়েকজন কে।এরমধ্যে কবি সিরাজুল হক সিরাজ এর নাম্বার না থাকায় তাকে রিং দিতে পারিনি।

আমাদের আড্ডা ঠিক সন্ধ্যায় শুরু হয়ে গেলো, তপোধীর ভট্টাচার্য আসার আগেই এসেছেন নাট্যজন তাপস রক্ষিত, নাট্যজন সত্যপ্রিয় চৌধুরী দোলন,আবৃত্তি শিল্পী পরেশ কান্তি দে।দাদা'র আগমনের পরপরই সত্যেন শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতি নাট্যজন খোরশেদ আলম,সত্যেন এর সাধারণ সম্পাদক মনির মোবারক ও সংস্কৃতি কর্মী তৌফিকুল ইসলাম আসে।

বিজয় মুখ এর ছোটন তপোধীর ভট্টাচার্য কে সাথে করে নিয়ে আসেন আর অজয় মজুমদার ও আমাদের সবিনা ইয়াসমিন খ্যাত সঙ্গীত শিল্পী আনিকা তাসনীম সহ আসেন।

আড্ডার শুরুতেই কক্সবাজার থিয়েটার, গণমুখ ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষ থেকে অতিথি কে পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে বরণ করে নেন তাপস রক্ষিত, সত্যপ্রিয় চৌধুরী দোলন ও পরেশ কান্তি দে।তারপর পরিচয় পর্বের মধ্যদিয়ে শুরু হয় আড্ডা।

আড্ডার প্রথম ভাগে যেহেতু নাটকের লোকজন তাই কথা পর্ব চলে নাটকের উত্তর আধুনিকতা প্রসঙ্গ।
আমাদের তাত্ত্বিক আলোচনার ফাঁকে আড্ডার ছেদ ঘটে কবি আসিফ নূর ও কবি আলম তৌহিদের আগমনে। আমি যেহেতু অনানুষ্ঠানিক সঞ্চালক ও আয়োজক সেহেতু আমাকে আবার কবি পরিচিত পর্ব করতে হলো। এরমধ্যেই তাপস দা বল্লো কক্সবাজারে জাতিয় নাট্যোৎসব চলছে আমাদের একটু নাটকের মহড়ার তাড়া আছে, আপনি এসেছেন শুনে মহড়া থেকেই উঠে এসেছি।

তপোধীর ভট্টাচার্য বল্লেন আমিও বুঝি মহড়ার তাড়া কি,কারণ আমি ও নাটকের অংশ।তো তারা বিদায় নেয়ার পরপর এলো কক্সবাজার শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার সুদীপ্তা চক্রবর্তী ও বিশ্বজিৎ পাল বিষু। তাদের ও পরিচয় পর্বের সাথে পুষ্পাঞ্জলি প্রদানের মধ্য দিয়ে আড্ডা যথারীতি শুরু হলো।

এবার যেহেতু সঙ্গীতশিল্পীর সংখ্যা বেশি তাই আড্ডা ঘুরে গেলো সঙ্গীতের উত্তর আধুনিক প্রসঙ্গ।
তপোধীর দা সঙ্গীত শিল্পীদের সাথে পরিচয় হলেন। কে কি গান করে জানলেন।অজয় মজুমদার বল্লেন আমি আপনাকে একটা গান শুনিয়েই নিজে কি গান করি জানাই।দাদা সাথে সাথে বল্লেন অবশ্যই অবশ্যই। অজয় গিটারে টুংটাং করতে করতে ছোটন অজয়ের মোবাইলের নোট অপশন থেকে গানের লিরিক বের করে দেয়।

অজয় গাইলেন তার সুর করা বিখ্যাত আহমদ ছাফা'র "আমি গেলে তো আর ফিরবো না" গান টি।অজয়ের গান শেষ হলে নওজিশ আহমদ বল্লেন এ গানের লিরিকের মধ্যেই উত্তর আধুনিকতা আছে। তপোধীর ভট্টাচার্য বল্লেন সুর টা উত্তর আধুনিক এবং লিরিকের মাঝের অন্তরাটি সম্পুর্ন উত্তর আধুনিক পর্যায়ের।
তারপর সঞ্চালক হিসাবে আমি কবিতা প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে

তপোধীর ভট্টাচার্য বাংলাদেশের উত্তর আধুনিকতা চর্চা, ভারতীয় সাহিত্যে উত্তর আধুনিকতা চর্চা আর ইউরোপের উত্তর আধুনিকতা এক নয়।

ভারতের বাংলা ভাষি ও বাংলাদেশের উত্তর আধুনিকতার মধ্যে সামঞ্জস্য আছে। ইউরোপের পোস্ট মর্ডানিজম এর বাংলায়ন করতে যেয়ে আমরা আসলে শব্দের রাজনীতির শিকার হয়েছি।এরমধ্যে কবি আসিফ নূর তার এবার একুশের বই মেলায় প্রকাশিত কবিতা "অপার অপেরা" গ্রন্থ অতিথি কে উপহার দেন।

আসে অজয়, মনির, মহিউদ্দিন এর যৌথ ভাবে বানানো ঝালমুড়ি,ছোলা। আমরা খেতে খেতে আড্ডা জমে উঠে তৌহিদ ভাইয়ের আধুনিক, উত্তর আধুনিক, আধুনিকতাবাদ নিয়ে।এর মধ্যে আবারও আড্ডার ছেদ ঘটন বিশ্বজিৎ পাল বিষু। তিনি বিদায় নিলেন। চলে আসে চা বিস্কুট ও কেক।

আমরা চা খেতে খেতে আমার "নৈনিতালের দিন" কবিতা গ্রন্থ থেকে একটি কবিতা পাঠ করে আমার
কবিতা গ্রন্থ "শুভ্রতার কলঙ্ক মূখস্ত করেছি " ও "নৈনিতালের দিন" বই দুটি উপহার দি কবি তপোধীর ভট্টাচার্য কে।

চা পর্বা শেষে তপোধীর ভট্টাচার্য কক্সবাজারের নিজস্ব গান শুনতে চাইলেন। আমাদের একটা মৌলিক আঞ্চলিক গান গেয়ে শুনান অজয় মজুমদার। এরপর মনির মোবারক এর সাথে সবাই মিলে জলের গান ব্যান্ডের গান গাই।

চলমান আড্ডার ভেতর সময় পার হয়ে যায় দু'ঘন্টা। সুদীপ্তা সর্দি জনিত অস্বস্তির কারণে বিদায় নিতে চাচ্ছেন। তপোধীর ভট্টাচার্য ও আমাদের অনুরোধে সুদীপ্তা একটা আধুনিক গান পরিবেশন করে।তার আগে আনিকা তাসনীম সাবিনা ইয়াসমিন এর একটি গান গেয়ে শুনান অতিথি কে।

যথারীতি আড্ডার ইতিতে কবি ও দার্শনিক তপোধীর ভট্টাচার্য সস্ত্রীক শাহীনের রুমে যায়।তার সাথে পরিচয় হয়।তার সুস্থতা কামনা করেন।দাদা শাহীনের সাথে ছবি তোলেন।

আমাদের ২০ফেব্রুয়ারি ২০২০ বৃহস্পতিবারের মুখরিত কবিতার সান্ধ্য আড্ডা অসাধারণ প্রাণবন্ত হয়।
প্রতিটি সুখ ও আনন্দের সাথে একটা দুঃখ থাকেই সেটা হলো কবি সিরাজুল হক সিরাজ নওজিশ আহমদ কে তাঁর মোবাইলে রিং দেয় কয়েকবার। নওজিশ তো আমার বাসার লোকেশন জানেনা, তিনি বার বার বলছেন আমরা আড্ডা দিচ্ছি চলে আসেন। নওজিশ আমাকে মোবাইলটা দিয়ে বলে সিরাজ এর সাথে কথা বলে আপনার ঠিকানা টা বলেন। আমি মোবাইল নিয়ে তাকে সম্মানের সহিত কবি সম্মোধন করে সালাম দিয়ে নিজের নাম বলে আমার বাসার নতুন ঠিকানা বল্লাম।এবং এ-ও বল্লাম আপনি বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম মোজাম্মেল হক সাহেবের বাসার সামনে আসেন, আমি লোক পাঠাবো যাতে আপনাকে নিয়ে আসে।দু'ঘন্টা পার হওয়ার পর ও তিনি আসেননি।

বিগত কুড়ি তারিখের কবিতার সান্ধ্যা আড্ডায় কক্সবাজারের কবি শিল্পী নাট্যজন,সংস্কৃতি কর্মীরা বিখ্যাত কবি দার্শনিক তপোধীর ভট্টাচার্য কে কক্সবাজারে পেয়ে প্রীত হয়েছে আমি বলবো।

আমরা উত্তর আধুনিকতা সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি, কেটেছে অনেক খটকা ধোঁয়াশা কেটেছে। সর্বোপরি খুব অল্প সময়ের আহবানে যারা সাড়া দিয়ে আড্ডায় অংশ নিয়েছে প্রত্যেকের প্রতি অশেষ ভালোবাসা ও ধন্যবাদ জানাই।

বাসায় যেহেতু আমার স্ত্রী অসুস্থ তরুণ কবি ও সংস্কৃতি কর্মীরা নিজদের চা নিজেরা বানিয়ে খেয়ে অতিথি কে আপ্যায়ন করে সম্মান করেছেন তার জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

আর আমার তাৎক্ষণিক অবস্থা অগ্রীম বুঝে তৌহিদ ভাই নিজ উদ্যোগে চা পাতা,গুড়ো দুধ ও ড্রাই কেক না আনলে আড্ডা চলতো রঙ চা দিয়ে। কবি শান্তনু মনির চানাচুর, মুড়ি ও টক দই না পাঠালে আড্ডা হতো শুধু ঘরে থাকা মুড়ি ও লাল চা সহযোগে।তো তৌহিদ ভাই শান্তনু মনির কেও ধন্যবাদ। পরিশেষে সকলের মঙ্গল কামনা করছি।


লেখক : কবি ও নব্বইয়ের নির্যাতিত প্রগতিশীল ছাত্রনেতাকক্সবাজার, বাংলাদেশ।