নচিকেতা চক্রবর্তী


বছর তিনেক আগে একটা গান লিখেছিলাম। ‘এমন কিছু অনুভূতি যাদের গতিপ্রকৃতি না না ফেসবুকে শেয়ার করা যায় না...’— রবীন্দ্রভারতীর এই ছবি বিতর্কে সেটাই বার বার মনে পড়ছে। আরে এই বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো নিজেদের আনন্দানুভূতির জায়গা থেকে একটা কাজ করেছে। পিঠে আবির দিয়ে কিছু শব্দ লিখেছে। আমার প্রথম প্রশ্ন, সেটা সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করার কী আছে? সব কিছু কি শেয়ার করা যায়! এখন তো আর ‘ঘরশত্রু বিভীষণ’ বলছি না, আমি তো বলছি ‘ঘরশত্রু কেজরীবাল’। আর সেই ‘কেজরীবাল’ই এই কাজটা করেছে। বালখিল্যের মতো করেছে কাজটা। আসলে, ওই বাচ্চাগুলো ভুল করেছে। কিন্তু আমরা সকলে ভুলে যাচ্ছি, ওরা কোনও অপরাধ করেনি। এটাকে এমন ভাবে ইস্যু তৈরি করার কোনও মানে নেই।

বাচ্চা বয়সে আমরা সবাই এমন ভুল করেছি। আমি প্রশ্ন করতে চাইছি, যাঁরা এটা নিয়ে গেল গেল রব তুলছেন, তাঁরা নিজেদের ছোটবেলাটা, স্কুলজীবন বা কলেজ জীবনের দিকে এক বার ফিরে তাকান। দেখুন এক বার, কী কী করেছিলেন ওই সময়ে! কতগুলো বাচ্চা বাড়িতে যা বলতে পারে না, সকলের সামনে যা বলতে পারে না, ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে নিজেদের বন্ধুদের সঙ্গে সেটা বলেছে বা শব্দগুলো পিঠে লিখেছে। কেউ এক জন বালখিল্য করে সেটাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দিল। অন্যায় যদি করে থাকে তো, সে করেছে। তাই বলে তাকে ‘গদ্দার’ বলতে পারি না। গদ্দার বলতে গিয়ে মনে পড়ছে, যাঁরা ‘দেশ কে গদ্দারোঁ কো, গোলি মারো সালোঁ কো’ বলেন, তাঁদের কারণে তো কত জনের প্রাণ গেল দিল্লিতে। রবীন্দ্রভারতীতে এই বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর কারণে তো কারও প্রাণ যায়নি! তাই না!

দেখুন, ওরা কিন্তু এই শব্দগুলো কারও সামনে বলেনি। বলেছে নিজেদের বন্ধুদের পরিসরে। লিখে ছবি তুলেছে, সেটাও বন্ধুদের পরিসরে। আপনার বাড়ির ঝুল বারান্দার নীচে এসে কিছু করেনি। আমরাও তো বন্ধুদের পরিসরে কত কিছুই বলি। গালাগাল দিই না? অশালীন শব্দ উচ্চারণ করি না? অহরহ করছি। হ্যাঁ, করছি। সেটা ওই বন্ধুদের পরিসরেই। ফেসবুক বা হোয়াটস্‌অ্যাপে আমি নেই। কিন্তু বন্ধুদের কাছে, এমনকি আমার তরুণী মেয়ের কাছেও তো শুনি, সেখানে কী কী সব শব্দ-বাক্য ব্যবহার হয়। আপনি বললে দোষ নেই, বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো বন্ধুদের পরিসরে সেই কথাগুলো বললে বা লিখলে গেল গেল রব তোলার কী হল!

এরা সরকারকে গালি দেয়নি, কোনও প্রতিষ্ঠানকে গালি দেয়নি, কোনও ব্যক্তিকেও গালি দেয়নি। রবীন্দ্রনাথের একটা গানে একটা শব্দ বসিয়েছে। অন্য কিছু শব্দও নিজেদের বুকে-পিঠে লিখেছে আবির দিয়ে। আপনারা চারপাশে কান পাতলে অহরহ সেই সব শব্দ শুনবেন। ট্রেনে, বাসে, বাজারে— কত লোকই তো বলছে। আপনি সেটা আটকাতে পারেন? পেরেছেন? পারেন না।কারণ, ভাষা তো প্রতিনিয়ত এগোচ্ছে। বঙ্কিম তো ‘মাগী’ শব্দ লিখেছেন। এখন আপনার কাছে সেটা গালি হয়ে গিয়েছে। বাংলা সাহিত্যে বা সিনেমায় বা ওয়েব সিরিজে কত শব্দ বলা-লেখা হচ্ছে। মনে পড়ছে আনন্দবাজারেই ‘চুদুরবুদুর’ শব্দটা পড়েছি। সমাজ কোন দিকে এগোচ্ছে, ভাষা কোন দিকে এগোচ্ছে, তা দেখার ভার কে আপনার উপরে ছেড়েছে বাবা! নীতি পুলিশি? ও সব আমি মানি না।

একই সঙ্গে এই বিষয়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে জড়িয়ে ফেলারও কোনও মানে হয় না। অনেকেই ভাবছেন, রবীন্দ্রভারতী, মানে ওটা রবীন্দ্রনাথের জমি। সেই জমিতে দাঁড়িয়ে এই ছেলেমেয়েগুলো কী সব করল! এ সব কী হল রে বাবা! আরে রবীন্দ্রনাথের জমি কী আবার! যেখানে ঘাস জন্মায়, সেখানেই তো মানুষের বসবাস। ওর বলতে ইচ্ছে করেছে, বলেছে। লিখতে ইচ্ছে করেছে, লিখেছে। আপনার কী!

ওদের যা বয়স, সেই বয়সে দাঁড়িয়ে কেউ প্যারোডি করেননি? রবীন্দ্রনাথকে, অক্ষয়কুমার বড়ালকে আপনারা ভুলে গিয়েছেন! আপনাদের বয়সের ভারে ভুলে গিয়েছেন। যে জিনিসটা এত দিন ধরে থেকেছে, তার বিরুদ্ধে যাওয়াটা আপনারা মেনে নিতে পারছেন না। আরে রবীন্দ্রনাথই তো লিখে গিয়েছেন, ‘আমরা নূতন যৌবনের দূত, আমরা অদ্ভুত...’। আপনারা আসলে রবীন্দ্রনাথকে হেরিটেজ বানানোর চেষ্টা করেন। আচ্ছা বলুন তো, রবীন্দ্রনাথ নিজে ভাঙেননি? ভেঙেছেন। তো, এই নতুন যৌবন যদি কিছু একটা ভুল করে, আপনারা এ ভাবে লাফিয়ে পড়বেন!

“আরে রবীন্দ্রনাথের জমি কী আবার! যেখানে ঘাস জন্মায়, সেখানেই তো মানুষের বসবাস। ওর বলতে ইচ্ছে করেছে, বলেছে। লিখতে ইচ্ছে করেছে, লিখেছে...”

আমি আমার গানে একাধিক বার নানা শব্দ ব্যবহার করেছি। সচেতন ভাবেই করেছি। ‘হাসপাতালের বেডে টিবি রোগীর সাথে খেলা করে শুয়োরের বাচ্চা’, বা ‘গোটা দেশ জুড়ে সোনাগাছি’— আরও কত কী! হ্যাঁ, হইচই হয়েছে। কেউ কেউ আমার নিন্দায় চার বেলা বেশি ভাত খেয়েছেন। কিন্তু, আমার কাজটা আমি করেছি। এতে দোষের কী! আপনি সোনাগাছিকে ভারতের ম্যাপ থেকে সরিয়ে দিতে পেরেছেন? পারেননি। তা হলে আমার গানে সেটা থাকলে দোষ কোথায়!

আরে বাবা, এটাও তো বিপ্লব। সব সময় বিপ্লব করতে গেলে সরকারের বিরুদ্ধে বা পক্ষে হ্যাঁ বা না মিলিয়ে বলতে হবে তার কী মানে আছে! ওরা বলে ফেলেছে। লিখে ফেলেছে। কী হয়েছে? আমি আবারও বলছি, কী অসুবিধা হয়েছে? আমরাও বলেছি। আমরাও অক্ষয় কুমার বড়ালের প্যারোডি করেছি। হ্যাঁ, আমি নিজে করেছি। কী হয়েছে তাতে? আপনাদের জীবনে ‘মহায়ণ’ ছিল না? মনে নেই? ভুলে গেলেন? আপনিও কিন্তু সেটা বন্ধুদের পরিসরে বলতেন। আমিও বন্ধুদের পরিসরে বলেছি। এখনও বলি।ওরাও কিন্তু এটা বন্ধুদের পরিসরেই করেছে। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে কোনও কেজরীবাল ছিল না। এদের মধ্যে কেজরীবাল আছে। ওরা সেটা চিনতে পারেনি। বা বুঝতে পারেনি। আর আপনারা সেটা নিয়ে একেবারে ‘তা তা থৈ থৈ’।

আপনার কাজটা আপনি করুন না। সেটা নিয়ে তো কেউ জ্ঞান দিতে যাচ্ছে না। অনেকে গালাগালি দেন। অনেকে দেন না। দিলে নাকি সমাজচ্যুত হতে হয়। আমি তো সমাজচ্যুতই হতে চাই। গাই তো, ‘আমি পথভোলা হতে চাই বার বার...’

আবারও বলছি, ওরা ভুল করেছে। কিন্তু, অপরাধ করেনি।

সৌজন্য : আনন্দবাজার, কলকাতা।