পুলক ঘটক


এই সময়ে তো ঘরে ঘরে বিনা পয়সায় মাস্ক এবং সেনিটাইজার সরবরাহ করার কথা। মাস্ক উল্টো দুস্প্রাপ্য হয়ে গেছে- দাম হয়ে গেছে ১০গুন। আসকোনার হাজি ক্যাম্পকে করোনা মোকাবিলায় কোয়ারেন্টাইন হিসেবে সাজানোর প্রস্তুতি চলছে। সংক্রামক ব্যধির কোয়ারেন্টাইন কি জিনিস বুঝতে হবে। এটা দুই/তিন হাজার হাজির জন্য ওজুর বন্দোবস্ত করা নয়। কোয়ারেন্টাইন মানে শতভাগ স্টেরিলাইজ করা একটি মেডিকেল।

সংক্রমণ রোধে সেখানে সবধরনের আধুনিক ব্যবস্থা থাকতে হবে। কোয়ারেন্টাইন হবে সম্পূর্ণরূপে ডাস্ট-ফ্রি। প্রত্যেক রোগীর জন্য আলাদা রুম এবং আলাদা বাথরুম লাগবে। ধরুন সেই অনুযায়ী ১ হাজার বাথরুম বানানোর প্রস্তুতি নেয়া হল। এজন্য সম্ভাব্য ব্যয় নিরুপণ, দরপত্র আহ্বান, কাজটা কে পাবে, কে পাবেনা সে নিয়ে টেবিলের নিচের আলোচনা, কার্যাদেশ পাওয়ার পর অর্থ ছাড় করা এবং কাজ সম্পন্ন করা নিয়ে ঠিকাদারের সঙ্গে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের ইদুঁর-বিড়াল খেলা - এইসব সম্পন্ন করে বাথরুমগুলো হস্তান্তরে কতদিন লাগতে পারে?


শনিবার ইতালি থেকে ফেরা ১৫০ নাগরিককে কোয়ারেন্টাইন করার জন্য যখন আসকোনায় নেয়া হয়, তখনও হাজি ক্যাম্পে ঝাট দেয়া হচ্ছিল। সংক্রামক ব্যাধি নিয়ে দেশে ফেরা দেড়শ মানুষকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে কোয়ারেন্টাইন ঝাট দেয়া! এই হল করোনা মোকাবিলার প্রস্তুতি! এ থেকে সারাদেশের প্রস্তুতির কথা কল্পনা করুন। দুর্নীতি একটা রাষ্ট্রকে কিরকম ভারী করে দিতে পারে দুর্যোগ প্রস্তুতিকালে তা বোঝা যায়।


এই যে হোম কোয়ারেন্টাইনের ধোঁয়াটা ছাড়া হচ্ছে না - এটা একদম স্বচ্ছ ধোঁয়া। এই ধোঁয়া করোনার মতোই -- প্রথম ছোঁয়ায় নাও বুঝতে পারেন। বুঝবেন কেবল চোখে ঝাঁঝটা বেশি করে লাগলে। আচ্ছা বলুন দেখি, এমন কোন বাঙালি মা আছেন, যিনি তার সন্তানকে অসুস্থ দেখলে তার কাছে যাবেননা, মাথায় হাত বুলাবেন না, পিপাসায় অসুস্থ সন্তানকে পানি এগিয়ে দেবেন না? ঐ মায়ের কি বিশেষায়িত নার্সিং প্রশিক্ষণ আছে? একজন বাবা হিসেবে ভাবুনতো আপনার অসুস্থ শিশুটিকে আপনি আইসোলেট করে দিতে পারবেন কি-না? আইসোলেট মানে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। একটি আলাদা রুমে পুরোদস্তুর বন্দী করে রাখতে হবে। চোখ ঢাকা চশমা, পুরো মুখাবয়ব ঢাকা মাস্ক এবং বায়োসেফটি গাউন পরে তার কাছে যেতে হবে। ক্ষেত্রবিশেষে রোগীকেও এই পোশাকে ঢাকতে হতে পারে। পুরো শরীর আবৃত না থাকলে রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস এলাকার কাছেও ঘেষা যাবে না। খাবার-দাবার এবং রোগীর (কিংবা সম্ভাব্য রোগীর) প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অনেকটা দূর থেকে ঠেলে দিতে হবে। কিছু স্পর্শ করা যাবেনা -হাত ধোয়ার আগে নিজের চোখমুখ পর্যন্ত স্পর্শ করা যাবেন না। কারও সঙ্গে হাত মেলানো নয়, শিশুদের আদর করা নয়। আমার মাস্ক অন্য কেউ ছোঁবেনা, স্টেরিলাইজ নিশ্চিত না হলে ব্যবহৃত মাস্ক কোথাও রাখাও যাবেনা। ভুল করে কোথাও রাখলে সেই স্থানটিও সেনিটাইজার (টক, ডিটারজেন্ট, স্পিরিট বা এলকোহল যুক্ত পানি,) দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।


বাসায় কোয়ারেন্টাইন বানিয়ে এরকম সতর্কতা কি সম্ভব? আপনি না হয় সতর্ক হলেন। আপনার বাসার মধ্যে থুপথাপ করে হেটে বেড়ানো দুই বছরের শিশুটিকে কিভাবে সতর্ক করবেন? ঐ বাবুটি যে অসুস্থ মায়ের, বাবার বা দাদা-দিদিমার বিছানায় উঠে পরবে! আপনার গ্রামের বাড়িতে প্রত্যেকের জন্য আলাদা এটাচড বাথরুম আছে? কোয়ারেন্টাইনের রোগীকে কোন বাথরুম ব্যবহার করতে দেবেন? সম্পূর্ণ মেডিকেটেড ব্যবস্থাপনা ছাড়া কোয়ারেন্টাইন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।


শুধু মেডিকেটেড আয়োজন নয় - অতিমাত্রায় কঠোরতা আরোপ ছাড়া মেডিকেটেড অবকাঠামোর মধ্যেও এর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এই কঠোরতা হয়তো নিষ্ঠুরতার পর্যায়ে পরবে। মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে নিয়ে কোয়ারেন্টাইন করতে হবে। কারণ মায়ের আবেগ দিয়ে শিশুটিকে বাঁচানো সম্ভব নয়। আবেগ প্রশ্রয় দিলে মাকেও বাঁচানো সম্ভব নয়। ছেলে মারা গেছে বলে লাসের উপর উথালি-পাথালি কান্নার সুযোগ দেয়া যাবেনা। প্রচলিত পদ্ধতিতে লাস গোসল দেওয়াও হয়তো সম্ভব হবেনা। বাস্তবতা মানতে হবে। মেডিকেল সায়েন্স পরামর্শ দিলে প্রয়োজনে লাস বিশেষ পদ্ধতিতে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। হ্যা বন্ধুরা, চরম কষ্ট বুকে চেপে চোখের জলকে পাথর বানাতে হবে। কারণ মানুষকে বাঁচাতে হবে। দুর্যোগের প্রস্তুতি এরকমই হওয়া উচিত। মনে করুন আপনি যুদ্ধের মধ্যে আছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশ এবং মানুষকে বাঁচানোর দায়িত্ব আপনার উপর। দেশ এবং মানুষকে প্রচন্ড ভালবেসেই আপনাকে নিষ্ঠুর হতে হবে। একাধারে একজন সৈনিকের ভালবাসা এবং সৈনিকের মত অকাতর নিষ্ঠুরতা--কিছু কিছু সময় আসে যখন এরকম প্রস্তুতি নিতে হয়। আমাদের সামনের সময়টা সেরকম হতে পারে।


চীন যে করোনা নিয়ন্ত্রণে বেশি সাফল্য পেয়েছে, তার প্রধান কারণ এই কঠোরতা। সেখানেও এই রোগ যতদূর ছড়িয়েছে তার পুরোটাই ছড়িয়েছে কঠোরতার ফাকফোকর গলে। যত বেশি সাবধানতা হবেন, এই ভাইরাসের থেকে তত বেশি নিরাপদ হবেন।


আমাদের বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সেই নিরাপত্তার আয়োজন কেমন তাকিয়ে দেখুনতো। অথচ অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে আমরা বেশি সময় পেয়েছি। অন্যরা -বিশেষত চীন- শুন্য অভিজ্ঞতা দিয়ে ভাইরাস মোকাবিলা শুরু করেছিল। এখন আমাদের কাছে (কয়েক সপ্তাহের) বিভিন্ন দেশের বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ডাক্তার ও বিজ্ঞানীরা তাদের নিরলস গবেষণায় এই ভাইরাস সম্পর্কে যতটুকু জ্ঞান আহরণ করছেন- তা বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমে পৃথিবীর সকল দেশের চিকিৎসাবিদদের কাছে শেয়ার করছেন। ইন্টারনেট এবং স্যাটেলাইট প্রযুক্তির কারণে জ্ঞান ও তথ্য সরবরাহে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগছে। তবু কেন আমাদের এত পিছিয়ে থাকা? তবু কেন আমাদের অসম্ভবের ধোঁয়ায় রাখা হচ্ছে? করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় যারা এসব হোম কোয়ারান্টাইনের উপদেশ দিচ্ছে, আসলেই তারা স্বচ্ছ ধোঁয়া ছেড়ে দায় এড়াচ্ছে।


প্রস্তুতির কথা আরও শুনবেন? যে ডাক্তার এবং নার্সরা করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিকে সেবা দেবেন তাদের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক বায়োসেফটি গাউনও এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।তারা অরক্ষিত অবস্থায় রোগী বা সম্ভাব্য রোগীদের কাছে যাবেন না-কি? কি একটা তামাসা! এক্ষেত্রে ডাক্তার এবং নার্সদেরও একধরনের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হয়। এজন্য তাদের ভিন্ন বাসস্থান দরকার। নইলে তাদের পরিবার এবং পরিচিতজনরাও আক্রান্ত হতে পারে। তার জন্য কি ব্যবস্থা হয়েছে?


হাজি ক্যাম্পটির কথা আরেকটু শুনুন। জায়গাটা ধর্মমন্ত্রণালয় থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর হয়েছে সবেমাত্র পরশুদিন। সেখানে জমে আছে গাদাগাদা ময়লা-আবর্জনা। গতকাল যখন ইতালিফেরত নাগরিকদের সেখানে ঢুকানোর জন্য নেওয়া হয়, তখন ময়লা সরানোর কাজ শুরু হয়েছে। আমরা তো বিদেশে কামলা খেটে দেশে টাকা পাঠানো ঐ বিপন্ন মানুষগুলোকে যা মুখে আসছে বলে যাচ্ছি।তারা কিন্তু তাদের নিজ দেশে ফেরত এসেছে। এ তাদের অধিকার। তাদের মধ্যে একজন বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে মরিয়া হয়ে ফিরে এসেছেন। এখন এই দেশে তাদেরকে অনিরাপদ পরিবেশে আবর্জনার মত ডাম্পিং করে দেবেন? বাধ্য হয়েই সরকার তাদের কোয়ারেন্টাইন না করে তথাকথিত "হোম কোয়ারেন্টাইনে" পাঠিয়েছে। বিপদটা এবার বুঝুন। এর নাম রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন?


এজন্য কি আমরা বলব যে যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের সবার আন্তরিকতায় ঘাটতি আছে? আমি অন্তত তা মনে করিনা। চিন্তা-ভাবনায় ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু সকলের আন্তরিকতার কমতি আছে তা বলা যাবে না। কারণ আমি যে কঠোরতার কথা বললাম, তা বাস্তবে প্রয়োগ করা মহাকঠিন বিষয়। আমরা বাইরে থেকে যা ভাবছি - বাস্তবায়ন তার চেয়েও কঠিন।
প্রথমতঃ আমাদের স্বল্প জায়গায় বিপুল জনবসতি এবং দ্বিতীয়তঃ নাগরিক জীবনে নিয়মানুবর্তিতার ঘাটতি।
তৃতীয়তঃ দুর্নীতি। দেশে অসংখ্য মানুষ থাকলেও সরকার কোনো দায়িত্ব অর্পন করে শতভাগ ভরসা করতে পারে- এমন মানুষ বেশি নেই।


চতর্থতঃ আমাদের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ দেশের বাইরে থাকে। (অসুখ নিয়ে হলেও) তাদের দেশে ফেরা বন্ধ করে দেওয়া নীতিগত এবং আইনগত কারণে কঠিন।


পঞ্চমতঃ অর্থনীতিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতার ঘাটতি। আমদানি এবং রপ্তানির জন্য আমাদের পরদেশের উপর নির্ভর করতে হয়। চীন থেকে পন্য আমদানি ব্যহত হচ্ছে। ভারতও সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। অবস্থাটি বুঝুন। সাপ্লাই চেইন বন্ধ হয়ে গেলেও বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে এবং মানুষকে অন্তত খাদ্য দিয়ে বাঁচাতে হবে -যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বা বাক্য বিতরণ করার আগে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হচ্ছে। সুতরাং শুধুশুধুই তাদেরকে দোষ দিতে চাইনা।


আমার বিবেচনায় পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য বাজার শান্ত রাখা এবং কোটি কোটি মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখা সরকারের বড় কনসার্ন। দ্বিতীয়ত, অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার জোগানটাও ঠিক রাখতে হবে। চীনে রোগ শুরু হওয়ায় প্রথম ধাক্কায় গার্মেন্টসের কাচামালের সাপ্লাই-লাইন কেটে গেছে। এরপর ইউরোপে করোনাভাইরাসের আক্রমণের ফলে ক্রেতার সংকট দেখা দিয়েছে। শেষতক এর সঙ্গে যদি দেশের ভেতর শ্রমঘন ফ্যাক্টরিতে করোনা আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে তাহলে শিল্পের অবস্থা কি হবে?


এই সংকট সময়ে কাউকে দোষারোপ করে খান্ত হওয়া নয় - ঐক্য, সাহস ও মনোবল নিয়ে টিম-বাংলাদেশের এগিয়ে চলা প্রত্যাশা করি। বাঙালি ঐক্যবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল হলে সব সংকট জয় করতে পারে। যেখানে সংকট (অর্থাৎ আতঙ্ক বা ভীতি সৃষ্টির সম্ভাবনা) সেখানেই মুক্তির সূচনা। ভীতি সঞ্চার নেতিবাচক হলেও ভীতির কারণেই মানুষ করোনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যগত শৃঙ্খলা মেনে নেবে। ভীতির মাঝ থেকে সাহসী তরুণদলও বেরিয়ে আসবে। তারা টিম-বাংলাদেশ হিসেবে কাজ করে স্বেচ্ছাসেবা দিয়ে জাতিকে সংকট থেকে উদ্ধার করবে বলে মনে করি। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে ডাক্তারির চেয়েও সতর্ক নার্সিং বেশি দরকার। যুবকদের নার্সিং প্রশিক্ষণ দেয়া এখনই শুরু করুন এবং পর্যাপ্ত বায়োসেফটি গাউনসহ প্রয়োজনীয় নার্সিং উপকরণের সরবরাহ বাড়ান। হোম কোয়ারান্টাইন সুস্থদের জন্য হতে পারে। সন্দেহভাজন রোগী এবং আক্রান্তদের তৎক্ষনাৎ সরিয়ে নেয়ার জন্য আপৎকালীন অস্থায়ী মেডিকেল স্থাপনা গড়ে তুলুন। এজন্য অনেক সরকারি স্থাপনা খালি করার প্রয়োজন হতে পারে। নগরীর ভালমানের আবাসিক হোটেলসমূহ অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য অধিগ্রহণ করে কোয়ারান্টাইন বা মেডিকেল হিসেবে ঘোষণা দিতে পারেন। জরুরি বাস্তবতায় জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকার যেন নির্ভিক হয়। জনগণও যেন বাস্তবতা বুঝে সরকারকে সহযোগিতা করে। জয় বাংলা। জয় মানুষ।

লেখক : সংবাদ কর্মী