মাঈনুল ইসলাম নাসিম : তিন মাস না পেরুতেই আবার তৎপর হয়ে উঠেছে গ্রীসের চিহ্নিত দালাল সিন্ডিকেট চক্র। পুরনো অভিযোগনামা মিথ্যা প্রমাণিত হবার পর রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদের বিরুদ্ধে এবার সুকৌশলে চাপানো হয়েছে জনৈক মহিলাকে যৌন নির্যাতনের কাল্পনিক অভিযোগ। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, চলতি বছরের প্রথমার্ধে রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে একটি হোমমেড অডিও ক্লিপসহ বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগনামা ঢাকার পররাষ্ট্র দফতরে পাঠানো হয়।

দালাল সিন্ডিকেটদের মিথ্যা প্রোপাগান্ডার জবাব দিতে গত মে মাসে সশরীরে ঢাকায় যেতে হয় রাষ্ট্রদূতকে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধানে যাবতীয় অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয় তখন। সরকারের দূরদর্শীতায় ক্যারিয়ার ডিপ্লোমেট গোলাম মোহাম্মদ সসম্মানে গ্রীসে ফিরে এলেও থেমে থাকেনি ষড়যন্ত্রকারীদের নোংরামি, যার লেটেস্ট এপিসোড এবারের নারী কেলেংকারির সাজানো নাটক। অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই নাটকে ভিলেন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে গ্রীক পাসপোর্টধারী এক বাংলাদেশি নারীকে। নাম লায়লা এন্টিপাস।
গ্রীক নাগরিককে বিয়ে করার সুবাদে গ্রীক ভাষা তুলনামূলকভাবে অন্যদের তুলনায় ভালো জানা ছিলো লায়লার। কমিউনিটির জনৈক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির সহায়তায় লায়লাকে দোভাষীর কাজ দেয়া হয় অভিবাসন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম)-এর গ্রীস অফিসে। স্বদেশীদের সেবা করার পাশাপাশি ভিনদেশীদের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবেন লায়লা, কমিউনিটির এমন প্রত্যাশা থাকলেও দালাল সিন্ডিকেটেরে পাতা ফাঁদে পা দিয়ে নিজের ও আইওএম-এর ভাবমূর্তি ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন আজ বাংলাদেশি এই দোভাষী।
রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী দালালদের লিখে দেয়া অভিযোগনামা নিজের নামে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেন লায়লা, যেখানে উল্লেখ করা হয় রাষ্ট্রদূত মদ্যপ অবস্থায় তার স্পর্শকাতর অঙ্গে হাত দিয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, নিজে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন লায়লা এমন অভিযোগ রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে করতে এবং ঢাকায় অভিযোগনামা প্রেরণে তাকে রাজি করাতে এথেন্সের মুখচেনা দালালদের শুধু অনেক কাঠখড়ই পোড়াতে হয়নি, গুণতে হয়েছে বেশ ভালো অংকের অর্থ।
দোভাষির কাজ করার ফাঁকেই নিরীহ বাংলাদেশিদের কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে নগদ অর্থ হাতিয়ে নিতো লায়লা এন্টিপাস, এমন অভিযোগ বহুদিনের। নিজে অভিযোগের বোঝা মাথায় নিয়ে লায়লা এবার গিলেছেন দালাল সিন্ডিকেটের টোপ, আইওএম-এর নাম ভাঙিয়ে রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদের বিরুদ্ধে ঢাকায় পাঠিয়েছেন ভূয়া অভিযোগপত্র। লায়লার অভিযোগের প্রেক্ষিতে এবং দূতাবাসকে ঘিরে গ্রীসে আসলে বিগত পাঁচ বছরে কী ঘটেছে কেন ঘটেছে কারা ঘটিয়েছে এবং এখনো ঘটাচ্ছে তথা নেপথ্যের আদ্যোপান্ত জানতে এ যাত্রায় সরেজমিনে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
তারই অংশ হিসেবে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ৩ সদস্যের একটি সরকারী ইনভেস্টিগেশন টিম চলতি আগস্ট মাসের ৯-১৪ তারিখ এথেন্স সফর করবে। সেগুনবাগিচা থেকে সংশ্লিষ্ট সূত্র এই প্রতিবেদককে জানাচ্ছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ম্যারিটাইম এফেয়ার্স ইউনিটের প্রধান রিয়ার এডমিরাল (অব) খোরশেদ আলমের নেতৃত্বে এই টিমে থাকছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক আবদুস সবুর মন্ডল এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এডমিনিস্ট্রেশন উইংয়ের পরিচালক কাজী আনারকলি।
উল্লেখ্য, ৫ বছর আগে প্রথমবারের মতো গ্রীসের রাজধানীতে বাংলাদেশ দূতাবাস প্রতিষ্ঠার পর প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে সুইডেন থেকে এসে যোগ দেন মুহম্মদ আজিজুল হক। তাঁর সাথে কাউন্সিলর হিসেবে ছিলেন বি এম জামাল হোসেন। সিনিয়র কূটনীতিক আজিজুল হক নিজে সৎ থাকলেও অনেক চেষ্টা করেও সংযত রাখতে পারেননি সহকর্মী বি এম জামালকে। এথেন্সের চিহ্নিত দালাল চক্রকে সাথে নিয়ে দূতাবাসের ভেতরে বাইরে কাউন্সিলর জামাল গড়ে তোলেন লক্ষ লক্ষ ইউরোর বিশাল পাসপোর্ট বানিজ্য।
অভিযোগ আছে, ৩ বছরে ৫ কোটি টাকা কামিয়ে নেন কাউন্সিলর জামাল। লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয় এথেন্সের বাংলাদেশ দূতাবাস। মিজান-কামরুলের মতো স্থানীয় শীর্ষ দালালরা হয়ে যায় আঙুল ফুলে কালাগাছ। রাষ্ট্রদূত আজিজুল হক চীনে বদলি হলে ২০১৩ সালের গোড়ার দিকে দূতাবাসের হাল ধরেন পেশাদার কূটনীতিক গোলাম মোহাম্মদ। একাত্তরের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা শুরু থেকেই ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বন করলে ছন্দপতন ঘটে গ্রীসের দালাল সিন্ডিকেট জগতে। লুটপাটের ধারা অব্যাহত রাখতে দেয়া হয় নানান প্রলোভন, সাড়া দেননি রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ।
কাউন্সিলর বি এম জামাল চেয়েছিলেন যে করেই হোক আরো একটি বছর গ্রীসে থাকতে, কিন্তু নয়া রাষ্ট্রদূতের ছাড় না দেয়ার নীতিতে ঢাকায় ফিরতে বাধ্য হন কাউন্সিলর। ২০০৯-১২ কাউন্সিলরের অপকর্মের আরেক সহযোগি কনস্যুলার এসিস্টেন্ট রাজিব আহমেদ অবশ্য থেকে যান গ্রীসেই, কিন্তু আয় রোজগার বন্ধ হওয়ায় বি এম জামালের মতো সেও ক্ষিপ্ত হয় রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদের উপর। অন্যদিকে বি এম জামাল ঢাকায় বসেই এথেন্সে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন রাজীবসহ দালাল চক্রের সাথে।
দূতাবাসকে পুনরায় দুর্নীতি ও অপরাধের অভয়ারন্য বানাবার পথ প্রশস্ত করার অংশ হিসেবে রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদকে হটাতে চালানো হয় একের পর এক ষড়যন্ত্র, যার সর্বশেষ সংস্করণ আইওএম-এর নাম ভাঙ্গিয়ে লায়লার বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগনামা। এদিকে ঢাকা থেকে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের এথেন্স সফরকে ঘিরে গ্রীসের রাজধানীতে বাংলাদেশ কমিউনিটিতে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনেক বিলম্বে হলেও সরেজমিনে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় বাংলাদেশ সরকারকে সাধুবাদ জানিয়েছেন তাঁরা।
(এএস/আগস্ট ০৯, ২০১৪)