রণেশ মৈত্র


করোনা ভাইরাস এখন বিশ্বব্যাপী একটি ভয়াবহ আতঙ্কের নাম। চীনদেশ থেকে শুরু হয়ে এশিয়া মহাদেশ পেরিয়ে আজ করোনা ছড়িয়ে অষ্ট্রেলিয়ায়, সুদূর মধ্যপ্রাচ্যে, ইউরোপ ও আমেরিকার সর্বত্র। আমাদের ছোট্ট বাংলাদেশ, প্রতিবেশী ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলংকা, পাকিস্তানও আক্রমনের শিকার।

চীন তার বিশাল দেশে করোনা অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণ করে দুনিয়াব্যাপী বিস্ময়ের সৃষ্টি করলেও তার এই বৈজ্ঞানিক সাফল্যকে অনেকে ভিন্নভাবেও দেখেছেন। এই ভিন্নভাবে দেখা লোকের মধ্যে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত সহ সমাজের নানা স্তরের মানুষকেই দেখতে পাওয়া যায়। তাদের সরাসরি বক্তব্য, পৃথিবীর মাতব্বরি নেওয়ার জন্য , পৃথিবীর প্রথম সুপার পাওয়ার হওয়ার জন্যই চীন ঐ ভাইরাস পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছে। ফলে বিশ্বব্যাপী সকল দেশের লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এবং হাজার হাজার মানুষ মৃত্যু বরণ করছে।

যে দিন সংক্রমনের দিক থেকে আমেরিকা বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ইতালি চীন, ইরান প্রভৃতি দেশকে ছাড়িয়ে গেল-তখন তারা তাদের অনুমানকে সঠিক এবং সুপ্রমাণিত বলে ধরে নিলেন। বিশেষ করে আমেরিকাকে চীনের প্রধান টার্গেট ধরে নেওয়ার ফলে আমেরিকা যখন সংক্রমণের দিক থেকে গোটা বিশ্বকে অতিক্রম করে গেল তখন চীনই যেন এটা করে আমেরিকাকে কাবু করে ফেলতে সক্ষম হলো-আমেরিকার বিশ্ব মেডেল কেড়ে নিয়ে চীন নিজেকে সেই আসনে বসানোর কাজে প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করলো। অর্থাৎ চীন বিশ্বের এক নম্বর সুপার পাওয়ারের স্থানটি আমেরিকার কাছ থেকে যেন ছিনতাই করে নিল।

১৯৭১ এ চীনের ভূমিকা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে ছিল একেবারেই শত্রুতুল্য। তারা মাও সে তুঙ এর নেতৃত্বে আমেরিকা ও পাকিস্তানের সাথে হাত মিলিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গলা টিপে ধরে তাকে বিপর্য্যস্ত করার ক্ষেত্রে অন্যতম উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিল। বাঙালি জাতি, ভারত, সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক বিশ্বেও সম্মিলিত উদ্যোগে পাকিস্তান, আমেরিকা ও চীন শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছিল এই এশিয়ার মাটিতেই। আমরা জানি, তৎকালীন বৈশ্বিক রাজনীতি এক্ষেত্রে এক প্রচ- ভূমিকা রেখেছিল যা বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামে এক নেতিবাচক ভূমিকায় পরিণত হয়েছিল।

আজ বিশ্ব পরিস্থিতি যেমন বদলেছে তেমনি মোড়লগিরি নিয়ে তেমন একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাও আগের মত আর ঘটতে দেখা যায় না। যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্রভাবে চলমান, তা হলো বিশ্বের অর্থনীতিতে প্রাধান্য বিস্তারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। চীন অবশ্যই এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এগিয়েছে। আজ বেশ কয়েক বছর যাবতই দেখা যাচ্ছে, আমেরিকা চীনকে সমীহ করে চলেছে। বিশ্বের বাণিজ্যের সূচক দেখলেই বিষয়টি দিব্যি পরিস্কার হবে। চীনে সমাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এক ধরণের পুঁজিবাদ গড়ে উঠেছে কিন্তু বিশ্বব্যাপী মানুষ হত্যার অভিযোগ চীনের বিরুদ্ধে আজও ওঠে নি।

মানুষ খুনের একমাত্র দাবীদার মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ। মধ্যপ্রাচ্য তার দীর্ঘ দিনের আক্রমণেরভয়াবহ শিকার। লক্ষ্য, ঐ দেশগুলির অঢেল তেল সম্পদের মালিকানা অর্জন। সৌদি আরব এ কাজে আমেরিকায় বিশ্বস্ত বন্ধু হলেও অপরাপর দেশগুলি তার দ্বারা নরহত্যার ভয়াবহ শিকার। পাখীর মত মানুষ মেরে মধ্য প্রচ্যকে বহুলাংশে বিরান করে দিয়েছে। এমন কোন দৃষ্টান্ত চীনের ক্ষেত্রে নেই। আছে পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতা।

অনুভব করি, আমেরিকার স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের চাইতে চীনের স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীর অনেক বেশী অগ্রসর অন্তত: করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ও তা দমনের ক্ষেত্রে। নানাবিধ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এতদিন ধারণা ছিল আমেরিকাই বিশ্বে সর্বাধিক অগ্রসর দ্বিতীয় অবস্থানে ইউরোপ বিশেষ করে জার্মানী, ফ্রান্স, ইংল্যা-, ইটালি প্রভৃতি। সে ধারণা এবার নির্মমভাবে ভেঙ্গে চূরমার হলো। অন্তত: এই রোগটির ক্ষেত্রে।

কেউ কেউ চীনের উপর এতই ক্ষুব্ধ হয়েছেন যে, চীনের সাথে কূটনৈতিক অর্থনৈতিক সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবী এবং একই সাথে, চীনা পন্য বর্জনের প্রাপ্তরও তুলছেন। কিন্তু এ ব্যাপারেও মাথা ঠা-া করে একটু ভাবলেই বুঝা যাবে এমন প্রস্তাবের অবাস্তবতা। কারণ বাস্তবতা হলো এই যে ইলেক্টনিক পণ্য সহ বহু নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার বহু আগে থেকে চীন দখল করে আছে। গার্মেন্টসের ক্ষেত্রেও তাই যদিও এক্ষেত্রে বাংলাদেশ এবং ভারতও যথেষ্ট অগ্রসর। তদুপরি দামের প্রতিযোগিতায় ও চীনকে আজও কেউ অতিক্রম করতে পারে নি-পারে নি মানের ক্ষেত্রেও।

আরও একটি যুক্তি কেউ কেউ আনেন। সেটি হলো চীন সরকার সেখানকার উইঘুর নামক একটি মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। যতদূর জানি, এ অভিযোগ বহুলাংশে সত্য। ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে এ জাতীয় হত্যা অবশ্যই নিন্দার্হ। তবে এ নিয়ে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় বা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সমূহে আজতক তেমনকোন খবর বা নিবন্ধটি লেখা হতে দেখি নি। তবে শুনেছি তাদের মধ্যে আই এস এর সৃষ্টি হওয়ায় তারা চীনা জনগণের মূল স্ত্রেবত থেকে ছিটকে পড়েছে এবং সেখানকার মূল বাসিন্দারা ঐ জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে একই কারণে উষ্মা প্রকাশ করে থাকেন।

এ ব্যাপারটিতে সাম্প্রদায়িকতা কাজ করে এমন অভিযোগ আজতক কোন মহল থেকে শুনি নি। তা থাকলে অবশ্যই তা নিন্দনীয়। কিন্তু এ ব্যাপারে আমেরিকা বা মার্কিন প্রশাসন বা স্বয়ং ডোনাল্ড ট্রাম্প কি পিছিয়ে। ভারতের বিজেপি? বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম, বি এন পি এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি অংশই কমে যান? কৈ আমেরিকা, বিজেপি বা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির বিরুদ্ধে কার্য্যকর কোন প্রতিবাদী লেখাতো চোখে পড়ে না?

উগ্র চীন বিরোধিতার কারণে আজতক বিশ্ব মোড়ল মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ বিশ্বব্যাপী যে নরহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে দশকের পর দশক ধরে, এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, তা যেন কদাপি ঘৃণাক্ষরেও বিস্মৃত না হই।

ফিরে আসি করোন পরিস্থিতি নিয়ে। গোটা বিশ্বেও শত শত কোটি কোটি মানুষের কণ্ঠে আজ একটাই রব, করোনা ভাইরাস, করোনা দুর্যোগ বা করোনা মহামারী। এই মহামারী অবশ্য আজও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে তেমন একটা বিস্তৃতি লাভ করে নি-যদিও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এ অঞ্চলে, বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছে। এই আশংকা প্রকাশের ক্ষেত্রে মূলত: এই অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব জনিত কারণই প্রধানত: কাজ করেছে বলে আমার বিশ্বাস। অন্যকোন কারণও থাকতে পারে। তবে অনেকের মত আমারও ধারণা, দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে এখন গ্রীষ্মকাল। আরও তিনমাস কমপক্ষে গ্রীষ্মেও খরদাহ অভ্যাহত থাকবে। ফলে বাতাসে উড়ে বেড়ানো করোনার জার্ম দ্রুতই মৃত্যু বরণ করবে এবং এই প্রাকৃতিক বা পরিবেশগত কারণেই হয়েতো আমরা যারা এই অঞ্চলের অধিবাসী তারা হয়তো তুলনামূলকভাবে কম ভুগতে পারেন যদিও চূড়ান্তভাবে এমন দাবী করার সময় হয়তো এখনও আসে নি। সম্ভবত: বিষয়টি আর মাস খানেক ধরে পর্য্যালোচনা করলে আমরা একটি সিদ্ধান্তে আসেত পারবো।

কিন্তু ততদিনে বিশ্বের চেহারা কী দাঁড়াবে? শীঘ্রই সংক্রমণ কার্য্যকরভাবে প্রতিরোধ না করতে পারলে বাংলাদেশের পরিস্থিতিই বা কী দাঁড়াবে? এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া দুরূহ। কেমন দাঁড়াবে বিশ্বের পরিস্থিতি তা-ও অনুমান করা অত্যন্ত কঠিন।

যে গতিতে আমেরিকায়, ইতালিতে, ইংল্যা-ে, ইরানে করোনা সংক্রমণ ঘটে চলেছে-যে ভীতিকর সংখ্যায় বিশ্বব্যাপী মানুষের প্রাণহানি ঘটছে তাতে পৃথিবীর ভবিষ্যত রূপ নিয়েও উদ্বেগ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক।

একটু ভাবা যাক আমেরিকা ইতালি জনশূণ্য দুটি দেশে পরিণত হলো। চীনের কি কোন লাভ হবে তাতে? লাভ হবে কি আমাদের বাংলাদেশের বা ইউরোপের বা মারাত্মকভাবে মানব হত্যার শিকার মধ্যপ্রাচ্যেরই বস্তুত: কারও তাতে বিন্দুমাত্র লাভ নেই। তার চাইতে বরং এই মুহুর্তেই যদি করোনা ভাইরাস এ পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নেয় তবেই না আপমরা ও বিশ্ববাসী শেষ হাসিটি হাসতে পারি।

কিন্তু বিজ্ঞান এমন অলৌকিক কোন কল্পনা বিশ্বাসীচিন্তাকে প্রশ্রয় দেয় না। তাই যা প্রয়োজন তা হলো আমেরিকান, ব্রিটিশ, ইতালিয়ান, চীনা এবং অপরপাপর উন্নত দেশের স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা দ্রুত যৌথ বা একক গবেষণায় করোনার সংক্রমণ ও তার চিকিৎসার নির্ভরযোগ্য ও কার্য্যকর ওষুধ আবিস্কার করে গোটা পৃথিবীকে বাঁচাতেন। এই বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্য-বিজ্ঞানীদের সাথে সকল নিষেধাজ্ঞার ঊর্ধে উঠে লাতিন আমেরিকার ছোট্ট কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানে উন্নত কিউবার স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদেরকে যুক্ত করা যায় তবে হয়তো ফল দ্রুততার সাথে পাওয়া যেতে পারে বলে বিশ্বাস করি। সমাজতান্ত্রিক কিউবা ইতোমধ্যেই একটি ওষুধ আরিস্কার করেছে বলে নানা সূত্রে জানা যায় এবং সেই খবর অনেক বেশী বিশ্বস্ততা অর্জন করেছে কিউবা ইতালিতে তাদের বিপুল সংখ্যক ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসা সামগ্রী পাঠানোর খবর বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর সকল দেশের সংবাদ পত্রগুলিতে ছবিসহ খবরটি প্রচারিত হওয়ায়।

আমি জানি আজ বিশ্বের প্রতিটি দেশ অপর দেশ থেকে অনেক দিন যাবত বিচ্ছিন্ন থাকার প্রস্তাটিকে কেউ অবাস্তব বলে উড়িয়ে দিতে পারেন। কিন্তু জোর দিয়েই বলা যায়। সরকারগুলি চাইলেই বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করে তেমন বৈঠক সম্ভব করতে পারেন। আর তা যদি না-ও হয় ইন্টারনেটের মাধ্যমে আজ দূর-দূরান্তের সাথে যোগাযোগ সেকে-ের ব্যাপার মাত্র।

কেউ যেন না ভুলি বৈশ্বিক এই সমস্যার সমাধান ত্বরান্বিত হতে পারে বৈশ্বিক এবং সমবেত উদ্যোগেই। এককভাবেও নিশ্চয়ই হতে পারে তবে তার সময় সাপেক্ষ হতে পারে এবং ঐ একক সাফল্য নানা কারণে সন্দেহের ঊর্ধে নাও উঠতে পারে।

লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।