রণেশ মৈত্র


উত্তর থেকে এবার দক্ষিণে। কুড়িগ্রাম থেকে এবার যশোরে। জেলা হেড কোয়ার্টার থেকে এবার উপজেলায়-যশোরের মনিরামপুরে। জেলা প্রশাসক থেকে উপজেলা রেভিনিউ রাত্রিতে নয়-এবার দিবাভাগেই। অফিস কক্ষে নয়-এবার প্রকাশ্য রাজপথেই।

মানীয় (?) যখন রেভিনিউ কর্মকর্তার ছিল অপরিচিত তাঁর নিজ প্রশাসনিক এলাকাটুকুর বাইরে। আজ দেশজোড়া তাঁর পরিচিতি। নাম তাঁর সাইয়েদা হাসান।

দেশ জোড়া করোনা ভাইরাসের বিস্তৃতি অথবা বিস্তৃতির আশংকায় শতকর্তামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সরকার ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্য্যন্ত টানা ১০ দিন ছুটি ঘোষণা করলেও একই কারণে সরকারি কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করে তাঁদেরকে নিজ নিজ কর্মস্থলে থেকে জনগণের সেবার কাজে সরকারকে সমর্থন করতে বলা হয়েছে। সেই সুবাদে এবং একই মহান উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচিত সাইয়েদা হাসান কর্মস্থলে থেকে যান এবং ছুটিতেও এই অঘোষিত জরুরী পরিস্থিতিতেও সরকারি দায়িত্ব পালন করছিলেন।

সামাজিক দূরত্বের এক অভিযান চলছে বাংলাদেশে। চলছে সমগ্র সমগ্র বিশ্বের সকল দেশের সাইয়েদা হাসানের দায়িত্ব পড়লো আজীবন অনভ্যস্ত যশোরের মনিরামপুরের মানুষ যাতে ঘর থেকে বের না হন অথবা জরুরী প্রয়োজনে দু’চারজন যদি বের হনও, তাঁরা যেন একে অপরের থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ দূরত্ব পালন করে চলেন। পরস্পর গা ঘেঁষা ঘেঁষি যেন না করেন।

যথারীতি মনিরামপুরের রাস্তা পর্য্যবেক্ষণ করতে গিয়ে তাঁর চোখে পড়লো হাড় জির জিরে লুঙ্গি-গামছা পরিহিত জনা তিনেক বয়স্ক গ্রামবাসী পাশাপাশি চলছেন। আর যায় কোথা? ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ঐ তিন পিতৃ বয়সী দরিদ্রজনকে কান ধরে উঠ বস করালেন। আর নিজের মোবাইলে তার ভিডিও ছবি তুলে তা ছড়িয়ে দিয়ে একদিকে বিবৃত আনন্দ পেলেন-অন্যদিকে তিনি যে খুব কড়িতকর্মা তারও প্রমাণ ফেসবুক মারফত জনসমক্ষে তুলে ধরলেন। তিনি নিজেকে জনগণের সেবক বা বন্ধু নন-তাঁদের প্রভু হিসেবে নিজেকে জাহির করলেন।

আত্ম সম্মানবোধ সম্পন্ন সচেতন অসংখ্য মানুষ গৃহবন্ধি থাকা অবস্থায়ও প্রতিবাদে ফেটে পড়লেন। ফেসবুকের পাতা ভরে উঠলো সাইয়েদা হাসানের বিরুদ্ধে। তাঁর গণ-পরিচিতির ব্যাপক বিস্তার ঘটলো। কিন্তু নিঃশব্দ গণ-প্রতিবাদের ঝড় গিয়ে আছড়ে পড়লো বা প্রত্যাহার করে খুলনা বিভাগীয় দফতরে ও এস ডি করে পাঠানো হলো। বলা হলো তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত চলবে-দোষী সাব্যস্ত হলে বিভাগীয় মামলা দায়ের হবে। কিন্তু ঐ বিধানের দ্বারা আমলাদের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা জনরোষ প্রশমিত হয়ে আসার সময় নিয়ে অভিযুক্ত কে কিছুকালের মধ্যেই অন্যত্র বদলি বা তাঁর প্রোমোশনের ব্যবস্থাই সাধারণত: করতে দেখা যায়। ধরপাকড়ে লোক থাকলে সরাসরি পদোন্নতিও সম্ভব। সাইয়েদা হাসান নিশ্চয়ই তেমন কোন সুখবরের অপেক্ষায়। তবে যে ঘৃণা তাঁর প্রতি জনচিত্তে ঠাঁই পেলো-আজীবন তা তাঁকে অনসরণ করবে।
আমরা কুড়ি গ্রামের সাবেক ভিপি কর্তৃক সাংবাদিক নিগ্রহের খবর মাত্র কিচু দিন আগে দেখলাম। তারও আগে দেখেছিলাম জামালপুরের এক ভিসি’র তাঁরই অধীনে কর্মরত একজন নারীর যৌন সম্ভোগের ঘটনা।

চলমান করোনা বিরোধী অভিযানে পুলিশ সর্বত্র সক্রিয়। কিন্তু তাঁদের একাংশের বাড়াবাড়িও জনগণের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারছে না। কোন কোন ছবিতে পথিমধ্যে মানুষকে লাঠিপেটা করতে, কখনও রিকসা বা ষ্কুটার চালককে থামিয়ে পেটাতে পেটাতে তাদের রিকসা স্কুটার পর্য্যন্ত ভেঙ্গে ফেলার ছবিও চোখে পড়েছে। এই পুলিশ কর্মীরা অপরাধী হলেও তাদের প্রতি ন্যূতম শাস্তি দানের খবর না পাওয়া গেলেও সম্প্রতি পুলিশের মহাপরিদর্শককে মানুষের প্রতি মানবিক আচরণকরার জন্য পুলিশ কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানাতে দেখা গেল।

আমলাতন্ত্র একটি দেশের প্রশাসন ব্যবস্থা সচল রাখার জণ্যেই ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অপরিহার্য্য। কিন্তু আমলাতান্ত্রিকতা অত্যন্ত নিন্দনীয়। অভিজ্ঞতায় ইদানীং দেখছি, আমাদের দেশের আমলাতন্ত্র ভাইরাকে আক্রান্ত রোগাক্রান্তও বটে। তাই এই আমলাতন্ত্রকে জনস্বার্থে পরিচালিত করতে হলে তাকে ভাইরাস মুক্ত করা অপরিহার্য্য।

আমরা যখন অবিভক্ত ভারতে ইংরেজ বা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা শাসিত ছিলাম তখন দেখেছি, ইংরেজরা তাদের প্রশাসন চালাতে ভারতীয়দেরকে আমলা পদে নিয়োগ দিত তাদের স্বার্থে। বিশাল ভারতবর্সের শাসনকার্য্য চালাতে যে বিপুল সংখ্যক সরকারি আমলার প্রয়োজন তা ইংল্যা- থেকে এনে চালানো অত্যন্ত দুরূহ এবং ব্যয় সাধ্যও বটে। কারণ ইংরেজ আমলাদের বেতন, ভাতাদি অনেক বেশী পরিমাণে দিতে হতো। তদুপরি যে বিপুল সংখ্যায় আমলা ভারতবর্ষের প্রশাসন চালাতে প্রয়োজন ছিল-সেই বিপুল সংখ্যক তরুণ ইংল্যা-ে তখন পাওয়াও কঠিন ছিল।

এ কারণেই বিভিন্ন রাজ্য ও অঞ্চলের উচ্চতম ও উচ্চতর পদগুলিতে ইংরেজদের নিয়োগ দিয়ে তাদের অধীনে ভারতের অধিবাসী কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল প্রধানত: দুটি কারণে। এক. সমগ্র ভারতবর্ষের প্রশাসন চালানোর ভারতীয় তরুণদের নিয়োগ দিয়ে তাদেরকে ইংরেজদের বশংবদ হিসেবে গড়ে তোলা এবং দুই. ঐভাবে ভারতীয়দের নিয়োগ দিয়ে তরুণরা যাতে ইংরেজ-বিরোধী আন্দোলনে প্রবৃত্ত না হয়ে তাদের প্রতি মোহগ্রস্ত থাকে তেমন ব্যবস্থা করা।

ইংরেজরা বিতাড়িত হলো ভারতবর্ষ থেকে ১৯৪৭ সালে। ভারত বর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রাম ঠেকানো যায় নি ভারতীয় তরুণদের বৃটিশ আমলাতন্ত্রের অধীনে স্থান দেওয়া সত্বেও কোন বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা যায় নি।

ভারতবর্ষ স্বাধীন হলো কিন্তু বিশাল ঐ দেশটি সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দ্বিখন্ডিত হওয়ার মাধ্যমে। তার একটি অংশ পাকিস্তান ভূক্ত হলো। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভুলেই ভারতবর্ষ ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারলো না। আমলাদেরকে অপশন দেওয়া হলো। ভারতে থাকতে চাইলে ভারতে থাকবেন পাকিস্তানে যেতে চাইলে পাকিস্তানে যাবেন। এই সাম্প্রদায়িক অপশন উভয় দেশের আমলাদের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি দানা বাঁধতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

দুদেশে আমলা অদল বদল করলে পাকিস্তানের আদতে লাভ হয় নি। বারত থেকে কিছু সংখ্যক মুসলিম আমলা পাকিস্তানে অপশন দিয়ে এলেও পাকিস্তান থেকে অনেক বেশী সংখ্যক হিন্দু আমলা ভারতে চলে যাওয়ার ফলে। যেখানে জনগোষ্ঠিকে অপশন দেওয়া হলো না-সেখানে আমলাদেরকে অপশন দেওয়ায় পাকিস্তান প্রশাসনে ভয়াবহ শূণ্যতার সৃষ্টি হয়। এই শূণ্যতা পাকিস্তানে পূরণ করা হয় নতুন, অর্ধশিক্ষিত, অযোগ্য, অনভিজ্ঞ এবং সাসক দল (মুসলিম লীগ) সংশ্লিষ্ট তরুণদের দ্বারা। উল্লেখ্য, তৎকালে শিক্ষিত মুসলিম তরুণ-তরুণীরা সংখ্যাও ছিল হাতে গোনা। তাই পাকিস্তানের জনগণের কপালে জুটলো রীতিমত গণ-বিরোধী আমলাতন্ত্র। এরা ভাষা আন্দোলনে গুলি চালায়, কথায় কথায় জেলে পুরে, যখন তখন লঠিচার্জ করে, কথা বলা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে।

সেই আমলা তন্ত্রই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরের দায়িত্ব গ্রহণ করে। পাকিস্তানে যারা দায়িত্ব পালন করেন তারই বৃহদাংশ বাংলাদেশের প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তাই ঐতিহ্যগতভাবেই এঁরা নিজেদেরকে জনগণের সেবক বা বন্ধু মনে না করে প্রভু মনে করতে থাকে। ১৯৭৫ পরবর্তী যুগে ধীরে ধীরে ঐ আমলাতন্ত্র ক্ষমতা অর্জন করে বিপুলভাবে ক্রমান্ব^য়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুর্বল ও সংকীর্ণ চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ার ফলে। রাজনৈতক অঙ্গনে স্বৈরাচারের বিচরণ সত্তর আশির দশকে (জিয়া-এরশাদ আমলে) বস্তুত: সামরিক-বেসামরিক আমলার অশুভ আলিঙ্গণে কলংকিত ।

অত:পর মহকুমাগুলিকে জেলা এবং থানাগুলিকে উপজেলায় উন্নীতকরণ এবং বিভাগের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির মাধ্যমে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন আমলার বিপুল সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশের আমলা তন্ত্রকে ক্রমান্বয়ে শক্তিশালীকরণ প্রক্রিয়া অদ্যাবধি অব্যাহত। অপরদিকে আইন করে আমলাদের বহুবিধ রক্ষাকবচ তৈরী করে বস্তুত:ই তাদেরকে প্রভুতে পরিণত করা হয়েছে। এমন কি, দুর্নীতির ক্ষেত্রেও আমলারা কর্তৃপক্ষের পূর্ব অনুমতি ব্যতীত দুদক তাদের গায়ে হাত দিতে পারবে না-এমন বিধানও করা হয়েছে। এই দুর্নীতির ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের একাংশ দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাদের সহযোগিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু শস্তি আদৌ যদি কারউ হবে রাজনীতিকদের আমলারা দিব্যি অফিস করে উচ্চ হারে বেতন নিতে থাকবেন।

এহেন পরিস্তিতিতে জন্ম হচ্ছে সুলতানা পারভীন, সাইয়েদা হাসান, কিছু সংখ্যক পুলিশ কর্মকর্তা ও অন্যান্যের। কিন্তু তাঁরা তো স্যর, সবাই আমরা আমলাদের স্যার বলে অভিহিত করতে, তাঁদের আগমনে উঠে দাড়িয়ে সম্মান জানাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় আমরাই বস্তুত: পক্ষে আমলাদের সেবকে পরিণত হয়েছি। দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিক রাত আমলাদেরকে স্যালুট দিতে কুণ্ঠিত নন। এই সব কিছু মিলেই জনগণ তাঁদের ক্ষমতা হারাচ্ছেন-স্বাধীন বাংলাদেশের মর্য্যাদাও ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে।

একটি প্রগতিমুখী ব্যাপক গণ জাগরণই কেবল এহেন পরিস্থিতির গণ-বান্ধব পরিবর্তন ঘটাতে পারে। সেই লক্ষ্যে আমরা এগুবো কি?

লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।