আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী


মরণব্যাধি করোনা ভাইরাস। পুরো বিশ্ব কাঁপিয়ে দিয়েছে। পুরো বিশ্বের ন্যায় আমরা বাংলাদেশী, বাঙালি করোনা থেকে বাঁচতে রাষ্ট্রিয় সিদ্ধান্তেই কোয়ারেন্টাইন, হোমকোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন এবং নিরাপদ ও সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে অবস্থান করছি।

স্যোসাল মিডিয়া, প্রিন্ট, অনলাইন ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় বারবার ঘর থেকে বের না হতে এবং নিরাপদে থাকতে বার্তা দেয়া হচ্ছে। একই সাথে সর্তক থেকে করোনা প্রতিহত করতে হাত ধোয়া, খাদ্যাভাসে পরিবর্তন, ঘরে বসে ইবাদত বন্দেগী করার পাশাপাশি সময় কাটানো জন্য বই পড়া, লেখালেখি করা, অনলাইনে খবর নেয়া, মুঠোফোনে স্বজনদের সাথে আলাপন, ভালো দেশি বিদেশী সিনেমা দেখাসহ নানা বার্তা।

শুক্রবার। জুম্মার দিন। অথচ করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় মসজিদে যাওয়াটা ঠিক নয়। বাসাতেই বসে আছি। হঠাৎ ব্যান্ড সম্রাট প্রয়াত আইয়ুব বাচ্চুর একটি গান কানে ভাসে। “সেই তুমি কেন এতো অচেনা হলে, সেই আমি কেন তোমাকে দুঃখ দিলেম। কেমন করে এত অচেনা হলে তুমি কিভাবে এত বদলে গেছি এই আমি। ও বুকেরই সব কষ্ট দু'হাতে সরিয়ে. চলো বদলে যাই.. তুমি কেন বোঝনা, তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়, আমার সবটুকু ভালবাসা তোমায় ঘিরে। আমার অপরাধ ছিল যতটুকু তোমার কাছে তুমি ক্ষমা করে দিও আমায়।

গানটা শুনছিলাম আর ভাবছিলাম এই গানের মাঝেই লুকিয়ে আছে আমাদের বাংলাদেশের নিরাপত্তাদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ পুলিশ”। গানটি শোনার পরই মুলত কাগজ আর কলম নিয়ে বসা করোনা ভাইরাসকালীন এই অবসর সময় কাটানোর জন্য।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। তবে পিতামহ ও বাবার কাছ থেকে শোনা। বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখিনি। দেখতে পাইনি ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষনের মঞ্চ, শুনতে পারিনি তার সেই জ্বালাময়ী ভাষণ।

জন্মের পর থেকেই সবকিছুর সাথে বাংলাদেশ পুলিশের নাম শুনেছি, দেখেছি। তারা কি কাজ করেন, অনেকটাই পত্রপত্রিকায় এসেছে। কিছুটা দেখেছি। কিছুটা শুনেছি। দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে সুনাম-দূর্নাম দুটোতেই বাংলাদেশ পুলিশের অনন্য ভূমিকা রয়েছে।

একাত্তরের পর বর্তমান অবধি মরণ ভাইরাস খ্যাত করোনা পূর্ববর্তী বাংলাদেশ পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তাসহ সম্পৃক্তদের ভূমিকা নিয়ে নানা শ্রেণির মধ্যে ছিল চরম বিষাদাগার। অথচ মরণ ভাইরাস করোনাকে শুধু প্রতিহত নয়, রীতিমতো জয় করতে বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিটি সদস্য যারপরনাই চেষ্টায় অবিচল। তাদের এ অব্যাহত চেষ্টায় বাঙালি আজ গর্বিত।

পুলিশ বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের এই প্রশংসনীয় উদ্যোগ, কর্মযজ্ঞ, কর্মতৎপরতা, মহানুভবতা, অন্যের বিপদে বাঁপিয়ে পড়া, প্রতিটি নাগরিককে সুরক্ষা দিতে প্রাণপনে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়াটা আজ সত্যিই বাঙালি জাতির জন্য এক অনন্য উজ্জল দৃষ্টান্ত।

কথিত আছে, পুলিশ অর্থ ছাড়া কাজ করে না। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করাই পুলিশের কাজ। যদিও পুরো পুলিশ সদস্য এই কর্মকান্ডে জড়িত নন। তবে প্রবাদ আছে ‘সব মাছ মল খায়- দোষ হয় ঘাইরা মাছের।’ পুলিশ মিথ্যা মামলা দিয়ে মানুষকে হয়রাণী করে। মিথ্যা ওয়ারেন্টে মানুষ ধরে এনে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়। আমি বলছি না পুলিশ খারাপ। আমি বলছি পুলিশ জনগণের অতন্ত প্রহরী হয়েই কাজ করে যাচ্ছেন।

পুলিশের বিরুদ্ধে যেমন অভিযোগ আছে। তেমনি সাধারণ মানুষও কম নয়। অন্যায় করে বলেইতো পুলিশের প্রয়োজন। লোকে বলে, পুলিশ মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসিয়ে হয়রাণী করে, হত্যা, খুন, জখম, ধর্ষণের মতো ঘটনা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে ভিন্নধারায় প্রবাহিত করে। আর এ সকল অন্যায়গুলো গুটি সংখ্যক পুলিশ সদস্য করে বলেই আজ পুরো পুলিশ সম্প্রদায় কলুষিত হয়েছেন। ক্ষুন্ন করেছেন পুলিশ বাহিনীর দীর্ঘদিনের কুড়িয়ে আনা সুনাম।

মহামারী করোনা ভাইরাসে আজকে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে কেউ কি কোন প্রশ্ন তুলতে পারছেন, অথচ দেখেন, সরকারি হাসপাতাল, বেসরকারি ক্লিনিকে, হাসপাতালে এমনকি প্রাইভেট চেম্বারে চিকিৎসকরা ঠিক মতো চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন না এমন অভিযোগ শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা। চোখে ছানি ধরার মতো অবস্থা।

চিকিৎসকদের এই খবরের সাথে ফ্রি খবর হয়েছে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের প্রকৃত চরিত্র ও তাদের অনৈতিক কর্মকান্ড দেখে। যেখানে পুরো দেশ আজ অসহায়। সেখানে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সরকারি ত্রাণের চাল চুরির মহোৎসবে পরিণত হয়েছে। হায়রে বাঙালি। কোথায় বিপদ আর কোথায় আমাদের জনদরদি নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা। চাল চুরির সাথে সম্পৃক্তদের বলছি, বেঁচে থাকলে অনেক সময় পাবেন। অসহায়, বিপদগ্রস্ত মানুষের মুখে ভাত চুষে নেবেন না। সামনে ভালো দিন আসলে আবার চুরি করার সুযোগ পাবেন। এখন অন্তত একটু থামেন।

চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন না, দলীয় লোকজন ত্রাণের চাল চুরি করছেন, আর জনপ্রতিনিধিরা সুষ্ঠু ভাবে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ তো করছেনই না। আবার খাদ্য সামগ্রী দিয়ে ছবি তোলার পর ছিনিয়ে নিচ্ছেন অসহায়, দুস্থ, দরিদ্র, হতদরিদ্র আর কর্মহীন মানুষের কাছ থেকে। হায়রে বাঙালি। বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি। তবে তার কর্মকান্ডের চিত্রগুলো সম্পর্কে জেনেছি। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে ৭ কোটি বাঙালির জন্য সাড়ে ৭ কোটি শীতবস্ত্র আসলেও অবশেষে তিনি নিজেরটাই পাননি। আমরা বাঙালি- আমরা গর্বিত বাঙালি।

আজকের পুলিশ এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। সবাই হাত গুটিয়ে নিলেও পুলিশ সদস্যরা কিন্তু বসে নেই। তারা অবিশ্রান্ত, ক্লান্তি দুরে ঝেড়ে ফেলে অন্যের বিপদে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ভুলে গেছেন তার পরিবার, স্বজনদের কথা। খাবার নেই, ছুঁটছেন পুলিশ খাবার দেওয়ার জন্য। করোনা সন্দেহে বা উপসর্গ নিয়ে হয়তো অসুস্থ, নতুবা মারা গেছেন। এই পুলিশ সদস্যরাই ছুঁটে যাচ্ছেন। শহর, গ্রামগঞ্জ, পাড়া মহল্লা, হাট বাজার, দোকানপার্ট সবস্থানেই আর কেউ না থাকলেও পুলিশ কিন্তু আছে। তাদের সেবা, তাদের ভালোবাসায় আজ পুরো বাঙালি জাতি অভিভূত হবেন এটা আমার ব্যক্তিগত উপলব্দি।

এক সময়ে পুলিশের মান্ধাতামলের বন্দুকের লন ছিল ঝং ধরা। ফোটেনি গুলি। অথচ সেই পুলিশে আজ এসেছে আমূল পরির্বতন। পেয়েছে সেবার মান বৃদ্ধি। দক্ষ সৈনিকে আজ পরিচালিত হচ্ছে দেশ। তাদের উপর আজ আইনশৃংথলা রাষ্ট্রের রক্ষাকবজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সাথে করোনা ভাইরাস আবার নতুন করে নতুন উদ্যোমে বাঙালির সামনে পরিচয় করে দিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের।

জনগণের প্রত্যাশা, মানুষ দিয়ে কখনো পুরোপুরি মানুষের মধ্যে বিবেকের পরির্বতন আনা সম্ভব হয় না। প্রয়োজন সৃস্টিকর্তার হস্তক্ষেপ, প্রাকৃতিক হস্তক্ষেপ। তাহলে হয়তো মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, রাগ অনুরাগ, অভিমান সব কিছু ভুলিয়ে নতুন দেশ, নতুন জাতি, নতুন সেবা, নতুনের আহবানে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা আসতে পারে বিবেকস্থলে।

আবারও আইয়ুব বাচ্চুর গানের কলি দিয়ে শেষ করতে চাই। “সেই তুমি কেন এতো অচেনা হলে” শুধু করোনা নয়, প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা সাধারণ মানুষ পুলিশের মহতি উদ্যোগ, গুনগতমান সম্পন্ন সেবা প্রত্যাশা করি। গানের মতো আমরা নতুন করে পুলিশ সদস্যদের চিনতে চাই না। আমরা পুলিশকে পুলিশের মতো করেই দেখতে চাই। তাদের সহযোগিতা চাই। আমরাও তাদের কর্মক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেই।

একই সাথে ধন্যবাদ জানাচ্ছি মরণভাইরাস করোনার এই মহামারি সময়ে পুলিশের পাশাপাশি, সেনাবাহিনী ও র‌্যাব সদস্যরা এগিয়ে এসেছেন। ক্লান্তিহীন ভাবে কাজ করছেন জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। আর আত্ম মানবতার সেবায় রয়েছেন চিকিৎসকরা। এগিয়ে এসেছেন ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে সরকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, দলীয় সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিরা। সবক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে রেখেছেন গণপ্রজাতন্ত্রি বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধাধমন্ত্রী, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। আল্লাহ আমাদের সকলকে রক্ষা করুন এই প্রার্থণা।


লেখক : সাংবাদিক ও লেখক, পাবনা।