স্টাফ রিপোর্টার, ঢাকা : রাজনৈতিক দর্শন জামায়াতে ইসলামী। পাবনা শহরে ফুটপাতে ছিল গেঞ্জির দোকান। ওই দোকানের তার বাবার সাথে সহযোগিতা করতে জিন্নাহ। এটা ২০ বছর আগের ইতিহাস। বিগত বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে দেশের স্বীকৃত রাজাকার আলবদর আলশামস বাহিনীর প্রধান, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত মতিউর রহমান নিজামী আর রাজাকারদের আরেক শিরোমনি ফাঁসির আসামী আব্দুস সুবহানের আস্থাভাজন হয়ে অল্প সময়ের মধ্যে কোটিপতি বনে জিন্নাত আলী জিন্নাহ। 

ফুটপাতের গেঞ্জিওয়াল থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়ার পেছনের গল্প রয়েছেন সরকারের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ও গণপূর্ত বিভাগের অসুাধু কিছু কর্মকর্তা। সময়ের প্রয়োজনে জিন্নাত আলী জিন্নাহ ব্যবহার করতেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মিদের। তার কাজ হলেই ছুঁড়ে ফেলে দিতেন এই নেতাদের।

রাজাকার শিরোমনি নিজামী-সুবহানকে পুঁজি করে সরকারি দপ্তরের কাজ ক্ষমতার দাপটে বাগিয়ে নিয়ে ইচ্ছেমতো নয়ছয় করে, অনেক সময়ে কাজ না করেই বিল উত্তোলন করেছেন জিন্নাত আলী জিন্নাহ। প্রায় ৬ লাখ টাকার কাজ দিয়ে ঠিকাদারী লাইনে প্রবেশ করেন এই ঠিকাদার জিন্নাহ। অসাধু প্রকৌশলীদের আর্থিক ভাবে ম্যানেজ, কখনো ক্ষমতা প্রয়োগ করে আজকে কোটিপতি বনে গেছেন তিনি।

বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানায়, ওই সময়ে জনৈক আলমগীর হোসেন নামের এক প্রকৌশলীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইন্ধনে এবং সার্বিক সহযোগিতায় অল্প সময়ের মধ্যেই জিন্নাহ ঠিকাদারদের শীর্ষ কাতারে চলে আসেন। তার এই শীর্ষে আসার পেছনে রয়েছে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি। সরকারী এ সকল কাজে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হলেও তিনি অধরা থেকে গেছেন জামায়াতে ইসলামীর শক্তিশালী নেতাদের সুপারিশ আর দুর্নীতিবাজ অসৎ প্রকৌশলীদের কারণে।

তথ্যমতে, জিন্নাত ঠিকাদারের অর্থবিত্তের পেছনের কারিগরদের অন্যতম সহযোগী প্রকৌশলী আলমগরি হোসেনের চাকুরির মেয়ার শেষ হলে তিনি পিআরএল ভোগ করছেন। নিয়ম অনুযায়ী পিআরএল ভোগরত অবস্থায় তিনি কোন চাকুরি করতে পারবেন না। অথচ প্রতিদানস্বরূপ ঠিকাদার জিন্নাত আলী জিন্নাহ প্রকৌশলী আলমগীর হোসেনকে তার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজার পদে চাকুরি দিয়েছেন।

খোঁন নিয়ে জানা যায়, পাবনা শহরের প্রভাবশালী কয়েকজন ঠিকাদারের মাধ্যমেই ঠিকাদার লাইনে চেনাজানা শুরু হয় জিন্নাত আলী জিন্নাহ’র। পাবনা শহরের ওই সকল প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদারদের ব্যবহার করেই তিনি কোটিপতি বনে চলে যান। অথচ এখন ওই সকল ঠিকাদারের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে দাঁড়িয়েছেন জিন্নাত। আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি যাতে অব্যাহত ভাবে ঠিকাদারী কাজ চালিয়ে যেতে পারেন এবং দূর্নীতির আশ্রয় নিয়ে নির্মাণ কাজ করলেও তার অপকর্মে কেউ বাঁধা না হয়ে দাঁড়ায় সে জন্য শহরের এক প্রভাবশালী নেতার ভাইয়ের সাথে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন।

জানা যায়, ঠিকাদার জিন্নাত আলী জিন্নাহ’র ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান থেকে এলজিইডি ও গণপূর্ত বিভাগের প্রায় ১২০ কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে। চলমান এ সকল নির্মাণ কাজের জন্য পাবনার কমপক্ষে ৩০ টি ইটভাটায় নি¤œমানের ব্যাটস ও রাবিস কিনে গাদা করে রেখেছেন ব্যবহারের জন্য। যে ব্যাটস ও রাবিস সর্বনিম্ন ২৫-৩০ টাকা ঘনফুট।

পাবনা প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার হাজী ফারুক বলেন, অনেক নির্বাহী প্রকৌশলী এসেছেন। কিন্তু বর্তমান প্রকৌশলীর মতো এতো সৎ ব্যক্তি পাইনি। তার সাথে যত গভীর সর্ম্পকই থাক, কাজের ক্ষেত্রে শতভাগ তিনি আদায় করে নেন। শতভাগ কাজ সমাপ্ত ও কোয়ালিটি চাহিদা অনুযায়ী না পেলে তিনি কোন বিলে স্বাক্ষর করেন না। তিনি বলেন, সৎ মানুষের উপরে চাপ ও নানা কটু কথা রটনাটাই স্বাভাবিক।

ঠিকাদার জিন্নাত আলী জিন্নার ব্যাপারে হাজী ফারুক বলেন, ঠিকাদারী লাইনে তিনি আমাদের সিনিয়র। কিন্তু নির্মাণ কাজে তিনি নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারে বাঁধা দেন নির্বাহী প্রকৌশলী। এতে তাদের মধ্যে কিছুটা দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। আমরা ঠিকাদাররা আমাদের প্রয়োজনেই একাধিক বার বিষয়টি মিমাংসার উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক ঠিকাদার বলেন, একজনের জন্য সবার সমস্যা এটা মেনে নেয়া যায় না। আমরা সুষ্ঠু পরিবেশে কাজ করতে চাই। ঠিকাদার অনিয়ম করবে, সেটা তাকেই সমাধান করতে হবে। ঝুলিয়ে রেখে আরেক জনের ক্ষতি করার কোন মানেই হয় না। তিনি আরও বলেন, আমরা ব্যবসায়ী। সরকার যাবে আরেক সরকার আসবে। কে বিএনপি, কে আওয়ামীলীগ কে জামাত করে সেটা দেখার বিষয় নয়। সবাইকে সন্তোষ্ট করেই আমাদের লাইন ক্লিয়ার রাখতে হয়।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত ঠিকাদার জিন্নাত আলী জিন্নাহ বলেন, তেমন কিছুই হয়নি। সামান্য ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। সময়েই ঠিক হয়ে যাবে। নানা মিথ্যা রটানো, নির্বাহী প্রকৌশলীকে ভয়ভীতি, হুমকি ও প্রাণনাশের হুমকি দেয়ার বিষয়ে জিন্নাত আলী জিন্নাহ বলেন, এ কথাগুলো সঠিক নয়। ঠিকাদারী করতে গেলে কিছু ত্রুুটি হতেই পারে। ওটা আমি ম্যানেজ করে নিতে পারবো।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলাপকালে পাবনা এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী একেএম বাদশা মিয়া বলেন, পাবনাতে যোগদানের পর ঠিকাদার জিন্নাত আলী জিন্নাহের কাজকর্মগুলোই ছিল নিম্নমানের ও অনিময় আর দুর্নীতিতে ভরপুর। আর এ সকল কাজে আমি বাঁধা প্রদান করি। এতে সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে আমার উপর। ইতোমধ্যে পাবনার ফরিদপুর, ঈশ্বরদী ও আতাইকুলায় সড়ক নির্মাণে নিম্নমানের ইটের খোয়া ব্যবহার করছিলেন। সেটা আমি বন্ধ করে দিয়েছি উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায়।

নির্বাহী প্রকৌশলী বাদশা মিয়া বলেন, এ সকল অনিয়মে বাঁধা দেওয়ায় জিন্নাত আলী জিন্নাহ ও তার সহযোগীরা আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও প্রাণনাশের হুমকি দেন। এ ঘটনায় আমি পাবনা সদর থানাতে জিডিও করেছি। তারপরও তিনি থেমে নেই। একের পর এক মিথ্যা রটনা আর ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন। তিনি আমাকে ওপেন চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন, আমি না পারবো তার কাজ বন্ধ করতে, আর আমি পাবনাতে কিভাবে থাকি সেটাও তিনি দেখে নেবেন। তিনি বলেন, নিম্নমান হওয়ায় ঠিকাদারের ১০৮ ট্রাক খোয়া ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছি। যা ফরিদপুর উপজেলার ধানুয়াঘাটা কলেজ মাঠ অবৈধ ভাবে দখল করে সেখানে রেখে দিয়েছেন।

বাদশা মিয়া বলেন, রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বালিশ কেলেঙ্কারীতে জড়িত দুদকের একজন আসামী এই জিন্নাত আলী জিন্নাহ। অদৃশ্য শক্তি বলে ওই মামলায় অনেকেই জেলে থাকলেও তিনি এখনও বীরদর্পে বাইরে অবস্থান করছেন। ঠিকাদার জিন্নাত আলী জিন্নাহ ইতোমধ্যে পাবনা শহরের বনমালী শিল্পকলা কেন্দ্রের পেছনে ১০ তলা বিল্ডিং নির্মাণ করছেন। শহরের মধ্যে ৬ তলার নিজস্ব ভবনে জনি গার্মেন্টস চালাচ্ছেন। বাদশা মিয়ার অভিযোগ, স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের জিন্নাত আলী জিন্নাহ কিভাবে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ম্যানেজ করে বড় বড় কাজ বাগিয়ে নিচ্ছেন এটা আমার বোধগম্য নয়।

বাদশা মিয়া আরও বলেন, ঠিকাদার জিন্নাত আলী জিন্নাহ তার অনৈতিক, দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া অনিয়মের কাজ আমাকে দিয়ে করিয়ে নিতে না পারায় আমার বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি করছেন। কয়েকদিন আগে তিনি ২৬ লক্ষ টাকা ত্রাণ সহায়তা তহবিল গঠনের মিথ্যা নাটক সাজিয়ে আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন।

(পিএস/এসপি/এপ্রিল ১৫, ২০২০)