এম. সোলায়মান


বিশ্বের মানুষের মনে এখন এক আতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস। অদৃশ্য এই জীবানুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে পুরো বিশ্বের মানুষ। বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রের পরিস্থিতির দিকে তাকালে আমাদের খুব অসহায় মনে হয়, ভয় হয়! তবুও বাংলাদেশ সরকার আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছেন এ যুদ্ধে জয়ী হবার জন্য। কিন্তু; দু:খের বিষয় করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সরকার যে পূর্ব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা অনেকটাই ভেস্তে গেছে বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়হীনতার কারণে। আজ মহা বিপদের পথে বাংলাদেশ...!

বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের যে প্রস্তুতি রয়েছে তা প্রশংসনীয় তবে এগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু; কথা হচ্ছে এগুলো সঠিক ভাবে প্রয়োগ করবেন কে? দেশের অনেক বড় দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যা করে যাচ্ছেন তা নিছক করোনা নিয়ে ছেলে খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সরকারি কয়েকজন দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে লেখা হচ্ছে! ফেসবুকে ট্রল করা হচ্ছে! এটা সত্যিই দু:খের বিষয়, বৈশ্বিক দুর্যোগের সময় দেশের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা যদি তাদের কাজে ব্যর্থতার পরিচয় দেন। এর থেকে লজ্জার আর কিই বা হতে পারে?

কোভিট-১৯ (করোনাভাইরাস) এর সঙ্গে অপরিচিত আমরা সবাই। এখন পর্যন্ত এই রোগের কোনো প্রতিষেধক আবিস্কার না হওয়াতে মানুষের মাঝে আতঙ্ক বেড়েই চলছে। এই লেখার আগ পর্যন্ত করোনায় বিশ্বব্যাপী নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৫৪ হাজার ২৫৬ জনে এবং আক্রান্তের সংখ্যা ২২ লাখ ৫০ হাজার ৭০৯ জন। অপরদিকে ৫ লাখ ৭২ হাজার ১০৫ জন চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।

কিন্তু লক্ষ্য করলাম বাংলাদেশের মানুষের মাঝে চরম সচেতনহীনতা রয়েছে। আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে মারাত্মক বিপদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাঙালি জাতি! ঢাকাসহ পুরো দেশ অঘোষিত লকডাউন চলছে। গণপরিবহন, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাসহ সব ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প কারখানা বন্ধ করা হয়েছে সবাইকে বাসায় থাকার অনুরোধে। কিন্তু আমরা কি আদৌ বাসায় থাকছি?

অত্যান্ত দু:খের সঙ্গে বলতে হয়। মানুষকে বার বার করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতন করা হলেও তারা যেনো এটা পাত্তাই দিচ্ছে না। তার প্রমাণ ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় আনসারী হুজুরের জানাজায় লাখ লাখ মানুষের সমাগম হওয়া। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে সুযোগ পেলেই দলে দলে যে কোনো উপায়ে ছোটাছুটি করছে মানুষ, বাজারে অহেতুক উপচে পড়া ভিড় জমাচ্ছে, পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে বিকেলে ঘুরতে বের হচ্ছে অনেকে! যে ভুলটা করেছিল ইতালি, সেই একই ভুলের পথে আমরা বাঙালিরাও। আজ ইতালি মৃত্যুপুরীতে তৈরী হয়েছে। জানিনা বাংলাদেশের জন্য সামনে আরও কতটা ভয়ানক পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।

গত বছরের ডিসেম্বরে চীন থেকে এই মহামারি শুরু হলেও এখন ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে আরও ভয়াবহ আকার নিয়েছে। আক্রান্ত ও নিহতের সংখ্যায় সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৭ লাখ ১০ হাজার ২১ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৩৭ হাজার ১৫৮ জনের।

আক্রান্তের দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে স্পেন। সেখানে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৯০ হাজার ৮৩৯ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ২০ হাজার ২ জনের।

মৃত্যুর দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইতালি। দেশটিতে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৭২ হাজার ৪৩৪ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ২২ হাজার ৭৪৫ জনের।

চীনের উহান থেকে বিস্তার শুরু করে গত তিন মাসে বিশ্বের ২০০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)। চীনে করোনার প্রভাব কমলেও বিশ্বের অন্য কয়েকটি দেশে মহামারি রূপ নিয়েছে।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব, ডাক্তার-নার্স ও গণমাধ্যমকর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এরা কাজ করে যাচ্ছেন। অনেক পুলিশ, ডাক্তার, নার্স ও সাংবাদিকরা মানুষকে সেবা দিতে গিয়ে করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। দু:খের সঙ্গে বলতে হচ্ছে ইতিমধ্যে একজন ডাক্তার এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

বাংলাদেশে চিকিৎসাসেবা ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চরম উদাসীনতা আমরা লক্ষ্য করেছি। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ডাক্তার-নার্সদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাব নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে উদ্বেগ শোনা যাচ্ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ গণমাধ্যমে।

সরকারি হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি অন্তত বড় বড় বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা-কর্মীদের নিরাপত্তার কথাও সরকারী কর্তৃপক্ষকে ভাবা উচিৎ, কারণ বাংলাদেশে অনেক মানুষই এখন তাদের চিকিৎসার জন্য প্রথমে বেসরকারি হাসপাতালে যান।

কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালগুলোর পরিস্থিতি কি?

এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের অন্যতম বড় হাসপাতাল বারডেমের সহযোগী অধ্যাপক ড. পুরবী দেবনাথ বলেন, চিকিৎসা কর্মীদের নিরাপত্তার জন্য মাস্ক, গাউনের মত প্রয়োজনীয় উপকরণের স্বল্পতা তার হাসপাতালেও রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, "স্বাস্থ্য কর্মীরা সেবা দেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত, কিন্তু তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। সরকারি হাসপাতালগুলোতে পিপিই পাঠানো হচ্ছে বলে খবর পেয়েছি, কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালে নিজেদের উদ্যোগে এগুলো কেবল শুরু হয়েছে।"

এছাড়া জেলা-উপজেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতেও এখন পর্যন্ত করোনা মোকাবেলায় পর্যাপ্ত ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এ নিয়ে ডাক্তার, নার্স ও সাধারণ মানুষের মাঝে উদ্বেগ বাড়ছে।

চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইটালিতে বহু স্বাস্থ্য কর্মী এবং বাংলাদেশের একজন ডাক্তারের মৃত্যুর ঘটনায় হাসপাতাল কর্মচারীদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। ফলে, ঢাকার অনেক বেসরকারি হাসপাতালে ভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে কোনো রোগী হাজির হলে ডাক্তাররা কাছেই আসছেননা।

এমন সমস্যা নিয়েও আমরা খুব আশাবাদী, খুব শিঘ্রই দেশের স্বাস্থ্যখাতে যে সমস্যাগুলো রয়েছে তার পরিবর্তন আসবে। মনে রাখতে হবে করোনাভাইরাসের কারণে পুরো বিশ্ব এখন তাল-মাটাল। অদৃশ্য এক জীবানুর সঙ্গে লড়াই করছি আমরা। এ লড়াইয়ে যারা হেরে গেছে তাদের বিদায়ী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। কিন্তু; যারা বেচে আছেন তাদেরকে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। যতক্ষণ না পর্যন্ত এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব না কমবে ততক্ষণ আমাদের সচেতন থাকতে হবে, সাবধানে থাকতে হবে।

আমাদের আরও মনে রাখা উচিত শুধুমাত্র সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। এই বৈশ্বিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলোকে আন্তরিকভাবে বাস্তবায়নের জন্যে সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। নিজেকে সচেতন রাখতে হবে এবং অন্যকে সচেতন করতে হবে। অন্তত এই বৈশ্বিক সমস্যা করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সবার মধ্যে শুভবুদ্ধি জাগ্রত হোক। জয় হোক বাঙালি জাতির ! জয় হোক পুরো বিশ্বের!

লেখক : সহ-সম্পাদক, আলোকিত বাংলাদেশ।