রণেশ মৈত্র


১৪২৭ সালের পহেলা বৈশাখ পেরিয়ে এলাম-কিন্তু এ বৈশাখ, এই নতুন বছরের প্রথম দিনটি কেমন যেন অচেনা বলেই মনে হলো। আসলেই, এমন একটি পহেলা বৈশাখ, জীবন সায়াহ্নে এসে বলছি, কদাপি দেখি নি আমার সুদীর্ঘ জীবনে।

আমার প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদেরকে যদি প্রশ্ন করি, যাঁরা বয়সে আমার চাইতে বড়, তাঁরা অথবা যাঁরা বয়সে আমার চাইতে অন্তত: ৫০ বছরের ছোট তাঁরাও কি কেউ কোনদিন এমন একটি পহেলা বৈশাখ দেখেছেন? জানি, সবাই উত্তর দেবেন, “না-দেখিনি”। যদি পুনরায় প্রশ্ন করি, কেউ কি কদাপি এমন একটি পহেলা বৈশাখ দেখতে চেয়েছেন? তারও উত্তর সবাই নিশ্চয় মিলিত কণ্ঠে দেবেন “না”

কিন্তু বাঙালির জীবনের প্রতিটি স্তরে পহেলা বৈশাখ তো এক অনন্য দিন অসাধারণ দিন। মিলনের দিন। ভালবাসার দিন। আলিঙ্গনের দিন। গানের দিন, নাচের দিন। আবৃত্তির দিন। আলপনা আঁকার দিন। মিষ্টি খাওয়ার দিন-মিষ্টান্ন বিতরনের দিন। নতুন ধুতি, পায়জামা, পাঞ্জাবী, শাড়ী, ব্লাউজ বা থ্রি পিস পরার দিন। হালখাতার দিন। বাড়ী বাড়ী গিয়ে প্রবীনদেরকে প্রণাম করার দিন। ছায়ানটের দিন। সনজীদা খাতুনের দিন। পল্টনের বটমূলের দিন। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ মাঠে বিশাল নৃত্য, গীতি অনুষ্ঠানের দিন। ভোর বেলায় সবুজ ঘাসের পিড়িতে বসে গান শুনার দিন।
আবার অনেকের মধ্যে একটা রেওয়াজ দীর্ঘদিন ধরে গড়ে উঠেছিল যা এখনও বজায় আছে পশ্চিম বাংলা জুড়ে।

রেওয়াজটি হলো পহেলা বৈশাখের ভোরে ইলিশ পান্তা খেয়ে গান শুনতে দল ধরে বসা। কিন্তু কয়েক বছর হলো রেওয়াজটি অনেকটা সরকারি নির্দেশে প্রকাশ্যে খাওয়া না হলেও অপ্রকাশ্যে অনেকেই নিজ বাড়ীতে ইলিশ-পান্তার আয়োজন করে থাকেন রেওয়াজটি বজায় রাখার জন্যে। যে কারণে পহেলা বৈশাখের এক সপ্তাহ আগে থেকেই সারা বাংলাদেশের বাজারগুলিতে ইলিশের দাম বেড়ে যায়। প্রকাশ্যে বা সরকারি নির্দেশে ইলিশ পান্তা নিষিদ্ধ এ কারণে যে এই সময়ে মা-ইলিশেরা সমুদ্রতীরে গিয়ে ডিম ছাড়ে। তাই এ সময়ে ইলিশ খেলে ইলিশ উৎপাদন হ্রাস পাবে।

সে যাই হোক, বাঙালির সেই মিলন মেলা এবার আর ঘটলো না। ঘটলো না কোথাও মিষ্টি বিতরনের অনুষ্ঠান। প্রণাম, আশীর্বাদ আদান-প্রদান, গান বাজনা, নাচের আসর।

শুধু একটিমাত্র কারণে কেমন যেন সব তছনছ হয়ে গেল। করোনা ভাইরাস আক্রমণ-তার আতংক-তার প্রতিরোধের নীতি নির্দেশনা বাধ্য করলো সমগ্র জাতিকে গৃহবন্দী হয়ে থাকতে, বারংবার সাবান দিয়ে হাত ধুতে, কদাপি বাইরে না যেতে, কোন মিছিল-সমাবেশের আয়োজন না করতে, কোন কাউকে বাড়ীতে ঢুকতে না দিতে, অতি প্রয়োজনে বাইরে যেতে হলে অবশ্যই মাস্ক পরে যাওয়া, বাইরে কারও ছোঁয়া যাতে না লাগে সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখা, সামাজিক দূরত্ব অতি অবশ্য বজায় রাখা এবং বাসায় ফিরে এসে ভাল করে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ও পোষাক-পরিচ্ছদ বদলে ফেলে ঐ পোষাক গরমজলে সাবান-স্যাভলন দিয়ে কেচে রোদে শুকানো। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি দু’তিনবার স্যাভলন দিয়ে প্রতিটি ঘর, বারান্দা, ব্যালকনি মুছে ফেলা, আবর্জনা নিয়মিত পরিস্কার করা সাধ্যমত পুষ্টিকর খাবার খাওয়া...ইত্যাদি।

এগুলি মানতেই হচ্ছে-যতই কষ্ট হোক না কেন। কারণ একটাই। বাঁচতে হবে, নিজে বাঁচা, পরিবারের সকলের বাঁচা, প্রতিবেশীদের বাঁচা সবই বহুলাংশে এমন সতর্কতা মূলক নীতি নির্দেশনা মেনে চলার উপর নির্ভরশীল।অল্প কিছু সংখ্যক তরুণ, আমার মতে তাদের বয়সের কারণেই মূলত, ঘরে থাকার আদেশ না মেনে সময় সময় কিছু সংখ্যক বন্ধু-বান্ধব নিয়ে কিছু সময়ের জন্য বাইরে বের হচ্ছেন এবং সার্বিক হিসাবে তাদের মোট সংখ্যা এখনও উদ্বেগজনক। এই তরুণেরা যেমন নিজেরা নিজেদের জীবনকে বিপদাপন্ন করে তুলছেন, তেমনই আবার তাঁদের পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশী ও সমগ্র সমাজকে করোনা আক্রণের শিকারে পরিণত করে তুলতে পারেন।

পহেলা বৈশাখে, স্বাভাবিকভাবে দিবসটি পালিত হওয়ার সুযোগ থাকলে, অপরাপর দিনগুলিতে স্বাভাবিক চলাচলের সুযোগ থাকলে , বাড়ীতে একঘেঁয়েমি কাটানোর জন্য নানা বিনোদন মূলক কর্মসূচী টেলিভিশন চ্যানেলগুলি থেকে নিয়মিত প্রচারিত হলে সম্ভবত: তরুণদেরকে ঘরে থাকবার অনুকূল পরিবেশ ও আকর্ষণ রচিত হতে পারতো। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানমালা কোনরকমেই আয়োজন করা সম্ভব ছিল না। সম্ভব নয় বাইরে, রাস্তাঘাটে, হাটে বাজারে, স্কুল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ও আবাসিক হলগুলিতে স্বাভাবিক বিচরণ। তাই তাদের জন্য নিজ নিজ গৃহে সময় কাটানোর আগ্রহ তৈরীর সর্বাপেক্ষা কার্য্যকর অস্ত্র হতে পারে টেলিভিশন চ্যানলগুলি। এ্যাটকো (টিভি মালিকদের প্রতিষ্ঠান) এ ব্যাপারটি গুরুত্ব সহকারে ভাবতে পারেন। খবরের মাঝে মাঝে নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক ও নানাবিধ শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে যুব সমাজকে আকৃষ্ট করার মাধ্যমে তাঁরা করোনা প্রতিরোধে একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন।

মূল কথা, বাংলাদেশের শুধু নয় সমগ্র পৃথিবীতে করোনা ভাইরাস মানব জাতিকে আজ ধ্বংসের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে। এবারের পাহেলা বৈশাখ সে কারণেই বড্ড বিবর্ণ প্রাণহীন একটি দিবসে পরিণত। করোনা বিশ্ব সভ্যতার শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। রোগটি সাধারণ কোন রোগ নয়। এ রোগের বীজ সংগোপনে মানবদেহে প্রবেশ করে এবং ছোঁয়াচে রোগ হওয়ায় তা আরও মারাত্মক। বীজ মানবদেহে ঢুকবার ১৪ দিন পর তার লক্ষণ প্রকাশ হতে থাকে এবং তার আগে কিছু জানা যায় না। যখন লক্ষণ প্রকাশ পেলো তখন টেষ্ট করে নিশ্চিত হতে হয়। ফলাফল পজিটিভ হলে স্থান হবে হাসপাতালে নেগেটিভ হলে হাসপাতালে নয় তবে কোয়ারান্টাইনে কিছুকাল থাকতে হতে পারে।

অপরপক্ষে পজিটিভ ফলাফল হলে হাসপাতালে রাখাটা বাধ্যতামূলক হলেও রোগটির কোন ওষুধ আজও আবিস্কৃত না হওয়ায় লক্ষণগুলি দেখে অনুমান ভিত্তিক ওষুধ দেওয়া হয়। রোগীর দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা যথেষ্ট থাকলে তবেই রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা দেখা দেয় নতুবা মৃত্যু অবধারিত।

১৪২৭ এর পহেলা বৈশাখ তাই আমাদের দেশ ও জাতিকে পৃথিবীর অপর সকল দেশ ও জাতির সাথে হাতে হাত মিলিয়ে এক মহাযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে অনুপ্রাণিত করেছে। মানুষের জীবনের নিশ্চয়তা বিধানের জন্যে পরিচালিত হচ্ছে এই মহাযুদ্ধ। লড়তে হবে নিরস্ত্রভাবে যেমন বাঙালি জাতি লড়েছিল ১৯৭১ এর শুরুতে।

নিশ্চিত বলা যায়, সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ে ওষুধ আবিস্কৃত হবে যা দিয়ে আমরা করোনার আক্রমণ প্রতিরোধ করতে এবং আক্রান্ত হলে দ্রুততম সময়ে চিকিৎসা দিয়ে রোগীদেরকে বাঁচিয়ে তুলতে পারবো। ওই ওষুধ হবে করোনা নিধনের অমোঘ অস্ত্র। যেমন অস্ত্র পেয়েছিলাম আমরা ভারতের মাটিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর ১৯৭১ এর মুক্তিযদ্ধকালে। এখনকার করোনা বিরোধী যদ্ধের মতই তখনও সময় লেগেছিল অস্ত্র হাতে পেতে। পাওয়ার পর সশস্ত্র লড়াই ও চূড়ান্ত বিজয় অর্জন। এবারেও তেমনটি ঘটবে নি:সন্দেহে।

সেবার শত্রুরা অর্থাৎ পাকিস্তান যুদ্ধে নেমেছিল বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে। এবার অদৃশ্য রোগ নেমেছে সমগ্র মানবজাতির বিরুদ্ধে। তাই সকল মানুষ এবার আমাদের মিত্র, সকল ধর্মের, সকল বর্ণের, সকল জাতির, সকল লিঙ্গের মানুষ এবারে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নববর্ষের এই শুভ লগ্নে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হব আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীটাকে ফিরিয়ে আনতে সুন্দরতর নতুন একটা পৃথিবী গড়ে তোলার লক্ষ্যে।

১৪২৭ এর পহেলা বৈশাখের এখানেই ইতি। অপেক্ষায় ১৪২৮ এর পহেলা বৈশাখের জন্যে অধীর আগ্রহে। ১৪২৮ এর পহেলা বৈশাখেই শুধু নয়-বৈশাখের প্রতিটি দিনই আমরা আনন্দানুষ্ঠানে ভরে তুলবো-এটাই এবারের পহেলা বৈশাখের প্রত্যয়।

লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ,সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।