সিনিয়র রিপোর্টার : সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের হদিস মিলছে না। সে দেশের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত বিপুল পরিমাণ টাকা ফিরিয়ে আনতে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তির জন্য পাঠানো চিঠির জবাব এক মাসেও পায়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রাহকদের যাবতীয় তথ্যের ব্যাপারে সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করে সুইস ব্যাংকগুলো। তাই তাদের কাছ থেকে তথ্য নেয়া বা টাকা ফেরত আনা বাংলাদেশের জন্য সহজ নয়। প্রতিবেশী দেশ ভারত গত চার বছর ধরে সে চেষ্টা করেও কোনো কিনারা করতে পারেনি। তাই বাংলাদেশের জন্য সুইস ব্যাংকের তালা খোলা সহজ হবে না বলে মনে করেন তারা। তবে এক্ষেত্রে হাল ছাড়তে রাজি নয় সরকার। টাকা ফেরত আনার চেষ্টা অব্যাহত রাখাতে দৃঢ় প্রত্যয়ী বাংলাদেশ ব্যাংক।

জানা গেছে, সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (এসএনবি) 'ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড-২০১৩' শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সাল শেষে সুইস ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশিদের অন্তত ৩৭ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফঁ্রা গচ্ছিত রয়েছে যা প্রায় ৪১ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা ৩ হাজার ১৬২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এই অর্থ নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে সরকার যে পরিমাণ প্রকৃত ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে তার প্রায় ৬ ভাগের ১ ভাগ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সরকার নিট বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ১৮ হাজার ৬৯ কোটি টাকা। এর আগে ২০১২ সাল শেষে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের অন্তত ২২ কোটি ৮৯ লাখ সুইস ইউরো গচ্ছিত ছিল যা প্রায় ২৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার বা ১ হাজার ৯০৮ কোটি টাকার সমান।

এর পরই এ নিয়ে দেশে রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তোলে। গত ২৮ জুন জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের টাকা উদ্ধারের বিষয়ে বক্তব্য দেন। এর তিন দিন পর অর্থাৎ ১ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সুইজারল্যান্ডের এফআইইউর কাছে সুইস ব্যাংকগুলোতে গচ্ছিত বাংলাদেশিদের অর্থের বিস্তারিত তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠান। কিন্তু একমাস পেরিয়ে গেলেও চিঠির জবাব আসেনি। কবে জবাব মেলবে বা আদৌ উত্তর পাওয়া যাবে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত নয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউর একটি সূত্র জানিয়েছে, ভারত অন্তত চার বছর ধরে চেষ্টা করছে তাদের দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের যে অর্থ সুইস ব্যাংকগুলোতে রয়েছে তার বিস্তারিত তথ্য জানতে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেসব তথ্য পায়নি।

সংবাদপত্রে বিভিন্ন সময় কিছু ব্যক্তির অর্থ পাচারের তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশ থেকে বিএফআইএফইউ ইতিপূর্বে সুইজারল্যান্ডের এফআইইউর কাছে তাদের নাম উল্লেখ করে তথ্য চেয়েছিল। সেই তথ্যও পাওয়া যায়নি। এরও আগে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সুইস ব্যাংকে টাকা রেখেছিলেন এমন প্রচারণা ছিল বহুদিন ধরে। তার কিছু তথ্য-উপাত্ত বিভিন্ন সময় সংবাদ মাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত এ বিষয়েও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা দেখা যায়নি।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে সুইস সরকার ও ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। অন্যথায় এসব ব্যাংকের লকারেই থেকে যাবে এদেশ থেকে পাচার হওয়া হাজার কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে বিএফআইইউর দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ম. মাহফুজুর রহমান বলেন, তারা এক মাস আগে সুইস ব্যাংকে সমঝোতা চুক্তির জন্য চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু এখনো উত্তর মেলেনি। তাই বলে তারা হতাশ নন। চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। টাকা ফেরত পেতে ভারতীয়রাও চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু তারা এখনো সফল হয়নি। তবে অনেকটাই সফল হচ্ছে প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সংশ্লিষ্ট মহলের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক কোনো অনুষ্ঠানে সুইসদের সঙ্গে দেখা হলে এ নিয়ে কথা বলা যেতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সুইস ব্যাংক থেকে অর্থ ফেরত পাওয়া সহজ কাজ নয়। সেখান থেকে তথ্য উদ্ধারে বাংলাদেশ ব্যাংককে চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। প্রয়োজনে দেশটিতে গিয়ে সরাসরি কথা বলতে হবে। রাজনৈতিক পর্যায়ে বিষয়টি আলোচনা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। অর্থ ফেরত পাওয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও উপস্থাপন করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সুইস ব্যাংকগুলোতে গচ্ছিত টাকার তথ্য-উপাত্ত পেতে তাদের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তির জন্য আবেদন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটা ভালো কিন্তু তারা এখনো উত্তর দেয়নি বলে বসে থাকলে হবে না। চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, গচ্ছিত অর্থের হিসাবের বিষয়ে সুইস সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ায় তারা প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করে থাকে। আমাদের সরকারকে সেটা করতে হবে।

তিনি বলেন, শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংক চিঠি পাঠালে বা যোগাযোগ করলে সুইস ব্যাংক থেকে অর্থ ফেরত পাওয়া খুবই কঠিন হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি সরকারকেও সুইস সরকার এবং তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে হবে। অন্যথায় তথ্য পাওয়া ও অর্থ ফেরত আনা অসম্ভব বলে মনে করেন সাবেক এ গভর্নর।

(ওএস/এটিআর/আগস্ট ১১, ২০১৪)