নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার : করেনাকালে আমরা যে কয়েকটি শব্দের সাথে পরিচিত হয়েছি তার মধ্যে অন্যতম হলো লক ডাউন ও সোস্যাল ডিসটেন্স। এ দুটি শব্দের শাব্দিক অর্থের সাথে জানাশুনা না থাকলেও ব্যবহার বিধির সাথে অনেকটাই সম্পর্কযুক্ত হতে পারলেও পুরোটার সাথে পরিচিত হতে পারিনি। কারণ জাতি হিসেবে আমরা অনেকটাই অস্থির প্রকৃতির এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্ধ বিশ্বাসের প্রভাবও রয়েছে। আমরা কখনও বদ্ধ ঘরে থাকতে পারিনা বা অভ্যস্ত নই। আর বিশেষ করে সামাজিক বন্ধনে বসবাস করে অভ্যস্থ হয়েছি জন্মগতভাবে। এই অবস্থা থেকে ভয়ে বা সরকারের কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমেই হউক না কেন ঘরে ফিরে আসা অনেক কঠিন।

তবে সময়ের চাহিদা বিবেচনায় এ কঠিন বাস্তবতার আলোকে ভয় হউক আর আইন প্রয়োগ যাই হউক তার মাধ্যমে এ বিধিনিষেধ মেনে চলা অপরিহার্য। স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে যখন এই লকডাউন শুরু হয়েছিল তখন থেকে সাধারণ জনগণ মোটামুটিভাবে মেনে চলার চেষ্টা করেছে একথা বলা যায়। সময়ের স্রোতে জনগণের অনীহার কারণে ও আইনশৃংঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধীরগতির কারণে লকডাউন অনেকটাই মলিন হয়েছে একথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। মানুষের মাঝে এ দেয়াল ভাঙ্গার যেন প্রবনতা তৈরি হয়েছে। সবাই ফাঁকি দিয়ে ঘর হতে বের হচ্ছে প্রয়োজনে অপ্রযোজনে। আর আইনশৃংঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে দেশের সকল স্তরে এ আইন কার্যকর করতে জনগণকে বাধ্য করার মতো কোনো ম্যাজিক শক্তিও নেই।

অনেকেই রাস্তায় বের হয়ে ঘুরে বেড়ানো ক্রেডিট হিসেবেই দেখছেন যা ভাষায় প্রকাশ করতে শোনা যায়। দেশের বেশ জায়গায় ছোট ছোট রাস্তায় বা গলি ও গ্রামের প্রবেশের মুখে বাঁশ দিয়ে বেঁধে দিতেও দেখা গেছে। আবার অনেক এলাকায় বেঁধে দেয়া বাঁশের নিচ দিয়ে অবাধে যাতায়াত করতেও দেখা গেছে। কিছু কিছু জায়গায় সেলুনে বাহির থেকে নক করলে ভিতর থেকে শব্দ আসছে দুজন আছে চল্লিশ মিনিট পর। আবার চায়ের দোকানে শব্দ করলে দেখা যায় ভিতর থেকে বলে উঠছে লাল না দুধ। এতকিছুর পরও কিন্তু জনবহুল এ ঘনবসতিপূর্ণ দেশে যেটুকু লকডাউন হয়েছিল তা কিন্তু আশার বাণী হয়ে উঠেছিল।

বিদেশ থেকে লোক আসার পর হোম কোয়ারেন্টিনের ব্যাপারেও তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে যথেষ্ট। কিছু দিন যাবার পরই যখন নারায়ণগঞ্জ হয়ে উঠল চীনের উহান নগরীর মতো সেটা সামাল দেয়ার ক্ষমতা আমরা হারিয়ে ফেললাম। যার প্রেক্ষিতেই ঢাকা আজ পরিণত হয়েছে নিউইয়র্ক সিটির মতো। বিদেশ থেকে লোক আসার খবরের মতো আজ আমাদের দিনগুণতে হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা ফেরত লোকদের নিয়ে। সবজি ও মাছ পরিবহনের ট্রাকে করে ছড়িয়ে পড়েছে মানুষ। তৈরি হয়েছে অদৃশ্য শত্রুর কারণে আতংক। প্রতিদিনের বাজার, ত্রাণ সহায়তা এমনকি টিসিবির পণ্য নিতে এসেও জটলা পাঁকিয়ে সোস্যাল ডিসটেন্স নামে যে শব্দটা রয়েছে সেটাকেও জালে আবদ্ধ করে ফেলেছি।

সোস্যাল ডিসটেন্স এখনও আমাদের মাঝে সে ধারণাটিই তৈরি করতে পারেনি যে, এটা সামাজিক বিচ্ছিন্নতাকরণ নয় এটা হচ্ছে মূলত অর্থে শারিরিক দূরত্ব বজায় রাখা। মুখে মাস্ক পড়ে শারিরিক দূরত্ব বজায় রেখে বসার পর এক সিগারেট চারজনে খেলে দূরত্বই বলেন আর মাস্কই বলেন কাজে দেবে কি ? অন্যদিকে গ্রামের মানুষের এখনও সঠিক ধারণাটিও তৈরি হয়নি বিষয়টা কি ? টিভিতে দেখে অনেকেই এখনও এটিকে একটি পাথরের খন্ড হিসেবেই ভেবে আসছে। মুসলিম দেশে করোনা আসবে না বা গরমকালে এর প্রবণতা কমে আসবে এসব অবাস্তব চিন্তা ভাবনা আজ অনেকটাই কমে আসছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে। তথাপি কেন জানি বাড়ছে না সচেতনতার পরিধি! বরং দিন কি দিন সাধারণ মানুষ অবহেলার পাত্র করে তোলছে বিষযটিকে।

সর্বশেষ যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হলো গার্মেন্টস।এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সরকার সীমিত আকারে স্বাস্থ্য বিধি মেনে গার্মেন্টস খোলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সারা দেশে ৪ হাজার ৬২১টি গার্মেন্টেসের প্রায় ৪১ লাখেরও বেশি শ্রমিক রয়েছে। ইতোমধ্যে এর বেশির ভাগ শ্রমিকই হানা দিয়েছে শিল্পায়িত অঞ্চলে। সরকার সীমিত আকারে বললেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় বিষয়টি আর সীমিত আকারে নেই। যে যার মতো করে চাকুরি হারানোর ভয়ে কিংবা জীবন বাচাঁনোর তাগিদে যোগ দিয়েছে কাজে। সরকার যেসব ব্যবস্থার কথা বলেছে তা মেনে এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের কতটুকু কাজ করা সম্ভব তাও ভেবে দেখা দরকার। বেশিরভাগ শিল্প প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক বান্ধব পরিবেশ এখনও গড়ে উঠেনি এ কথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।

এছাড়াও শ্রমিকরা প্রতিষ্ঠানের বাইরে বাসায় যেসময়টুকু অবস্থান করে সেখানকার পরিবেশটাও স্বাস্থ্য সম্মত নয় কারন আর্থিক সুবিধার উপর ভিত্তি করেই শ্রমিকরা এসব বাসস্থানে বসবাস করে আসছে। এসবের ভিতরেও আমাদেরকে চালিয়ে যেতে হবে আমাদের কর্মযজ্ঞ। তবে তা মনে রাখতে হবে যে মানুষের জন্য অর্থনীতি। আর মানুষ কষ্ট করে টিকে থাকলে একসময় অর্থনীতি জেগে উঠবে। তাই এই লকডাউন এবং সোস্যাল ডিসটেন্স বিজ্ঞান সম্মত ভাবেই মেনে চলা উচিত।

সরকারের দায়িত্ববোধের পাশাপশি জনগণকেও হতে হবে সচেতন। কেবলমাত্র সরকারের উপর দোষ চাপিয়ে দিলেই দিন শেষে আমরা কিন্তু রক্ষা পাব না। এই প্রেক্ষাপটে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তা কতটুকু সাঠিক তা সময়ই বলে দিবে। অন্ধকার কেটে আলো আসলে বুঝতে পারবো লকডাউন বা সোস্যাল ডিসন্টেস এর উপসংহারটা কেমন হলো ?

লেখক :শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।