শিতাংশু গুহ


গত বুধবার কাপাসিয়ার নিরঞ্জন মল্লিকের দাহ ও শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। পেনসিলভানিয়ার বৃস্টল অক্সফোর্ড লেভিটটাউন ক্রিমেশন সেন্টারে তাঁর দাহ হয়। এ সময় ব্রাহ্মণ সনাতন ধর্মমতে তাঁর শেষকৃত্য করেন এবং অনেকে আত্মার সদ্গতির জন্যে গীতাপাঠ ও প্রার্থনা করেন। নিউইয়র্কের কুইন্সের চপলা-মিগলোর ফিউনারেল হোমের কাছ থেকে প্রাপ্ত ডক্যুমেন্ট ও ডেথ সার্টিফিকেট অনুযায়ী নিরঞ্জন মল্লিক ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা লাইক ইলনেস বা সম্ভাব্য কোভিড-১৯’ রোগে মারা গেছেন। সনাতন ধর্ম অনুযায়ী ‘অন্তেষ্টিক্রিয়া’ করেছেন কুইন্সের ব্রাহ্মণ প্রভাস চক্রবর্তী। তিনি জানিয়েছেন, হিসাবমত ১২ই মে ২০২০ তাঁর শ্রাদ্ধাদি অনুষ্ঠিত হবে, উত্তম সাহা শ্রাদ্ধ্য করবেন, প্রভাষ চক্রবর্তী পৌরোহিত্য করবেন।

বাংলাদেশ থেকে মৃতের কনিষ্ঠ ভাই বিপ্লব মল্লিক জানিয়েছেন, তারা যথারীতি অন্তষ্টিক্রিয়া করেছেন এবং শ্রাদ্ধাদি করবেন। নিরঞ্জন মল্লিকের বাড়ি গাজীপুর জেলার, কাপাসিয়া উপজেলার, রাউৎকোনা গ্রামে। মৃত্যুকালে নিরঞ্জনের বয়স হয়েছিলো ৫৩ বছর। তাঁর পিতার নাম সুরেন্দ্র মল্লিক, মাতা, চিন্তা রানী মল্লিক। দেশে তাঁর স্ত্রী ও একটি কন্যা সন্তান আছেন। স্ত্রীর নাম অন্তরা সরকার। কন্যা অর্পা মল্লিক, বয়স মাত্র দুই বছর। গাজীপুর সমিতি, কাপাসিয়া সমিতি ও নিরঞ্জনের পরিচিতরা বাংলাদেশে তাঁর স্ত্রী-কন্যাকে সাহায্য করবেন বলে জানিয়েছেন।

পূর্বাহ্নে শনিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২০ বিকালের দিকে আমায় একজন কল দেন, ফোন ধরলে অপর প্রান্ত থেকে জানালেন, করোনা ভাইরাসে মৃত কাপাসিয়ার এক হিন্দু ভদ্রলোকের লাশ মর্গে আছে, কোন হিন্দু সংগঠন তাঁর দায়িত্ব নিলে খুব ভালো হতো। আরো জানালেন, তারা একজন মুসলিম ভদ্রলোকের দায়িত্ব নিয়েছেন, এখন যদি অন্যরা এই হিন্দু ভদ্রলোকের দায়িত্ব নিতেন, তাহলে তাঁরা চিন্তা মুক্ত হতেন। ভদ্রলোককে বললাম, আপনি মৃতের তথ্য পাঠান, দেখি আমরা কি করতে পারি। ফোন রেখে দিয়ে ভাবলাম, কে সহায়তা করতে পারবেন? এতে বেশ ভালো একটা এমাউন্ট খরচ আছে।

পত্র-পত্রিকা, সামাজিক মাধ্যমে আমরা অনেক সংগঠনের সাহায্যের বিজ্ঞপ্তি দেখছি। ব্যক্তিগতভাবে অনেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। অনেকের সাথে আমার আগেভাগে কথা হয়েছে। এক হিন্দু ভদ্রলোক আমায় ফোন করে জানিয়েছিলেন যে, তিনি যদি কোন সাহায্যে আসেন, তবে কৃতার্থ হবেন। তাই, প্রথমে এই ভদ্রলোককে কল দিলাম। বললাম, দাদা, আপনি সাহায্য করতে চেয়েছেন, তাই কল দিলাম। নি:স্বার্থ সাহায্য প্রয়োজন। এতে অর্থ খরচ আছে। ভদ্রলোক আমায় বললেন, ‘দাদা, আপনি চিন্তা করবেন না, কি করতে হবে বলুন। বললাম, আপনাকে একটি লাশের দায়িত্ব নিতে হবে, নইলে লাশটি ‘বেওয়ারিশ’ হয়ে যাবে। এক কথায় তিনি রাজি হয়ে গেলেন। আশ্বস্থ হলাম।

মুসলিম ভদ্রলোক ইতিমধ্যে টেক্সট করে বাদবাকি তথ্য পাঠিয়েছেন। সেইসব হিন্দু ভদ্রলোকের কাছে পাঠিয়ে দিই। মুসলিম ভদ্রলোকের নাম আবুল বাশার। গাজীপুর সমিতির ভাইস-প্রেসিডেন্ট। পরে আরো কথা হয়েছে, জানালেন, গাজীপুর সমিতি ছোট্ট একটি সংগঠন, সবার দায়িত্ব নেয়া সম্ভব হবেনা, তাছাড়া হিন্দু ধর্মানুযায়ী কি কি করতে হবে, তাও তাদের অজানা, তাই তাঁরা চাচ্ছেন, কেউ দায়িত্ব নিলে ভালো হতো। পরে ওনার সাথে ফেইসবুকে বন্ধুত্ব হলো। তাঁর দেয়া পোস্টিং এখানে উল্লেখ করছি: “!! ওঁম গঙ্গা !!’/ !! শোকসংবাদ!!’// গাজীপুর সোসাইটি অব ইউএসএ ইনক’র ২০১৮/১৯ কার্যকারী কমিটির সদস্য নিরঞ্জন মল্লিক করোনার সাথে পরাজিত হয়ে ভগবানের নিকট চলে গেলেন। উনি আমেরিকার নিউইয়র্ক’র এস্টেরিয়ায় থাকতেন। বাংলাদেশের গাজীপুর জেলা, কাপাসিয়া থানা রাউৎকোনা গ্রাম-নিবাসী। আজ ১৮ এপ্রিল ২০২০ শনিবার। ওনার সৎকার ও অন্যান্য বিষয় পরে জানানো হবে। আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি”।

হিন্দু ভদ্রলোকের নাম সাধন দাস। অনেকে চেনেন। বাংলাদেশ হিন্দু মন্দিরের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাকে বলেছিলাম, দাদা, আপনি ও বাশার সাহেব কথা বলে যা কিছু করার করুন, প্রয়োজনে আমরা, এবং অন্য সংগঠন আপনার সাথে থাকবো। তিনি বললেন, দাদা, আগে ফিউনারেল হোম ভাড়া করি। রাতে তিনি জানালেন, হাসপাতালে ফোন কেউ ধরে না, তবে মেসেজ বলছে যে, ‘১৫দিনের মধ্যে লাশ কেউ দাবি না করলে তা ‘বেওয়ারিশ’ হয়ে যাবে। এও বলছে, আগে ফিউনারেল হোম ভাড়া করে তারপর যোগাযোগ করুন। সাধন দাস শনিবার অনেক চেষ্টা করেও ফিউনারেল হোম পাননি। রোববার আবার সাধন জানালেন, ফিউনারেল হোম মোটামুটি কথা হয়েছে, হয়তো কাল সোমবার ফাইনাল হবে। সবকিছু ফাইনাল হতে হতে সোমবার, ২৭ এপ্রিল। একদিন পর মঙ্গলবার ফিউনারেল হোম জানায়, পরদিন বুধবার ২৯ এপ্রিল দাহ। দেহ ক্রিমেটরিতে পৌঁছলে তাঁরা আবার কনফার্ম করে। ৩০ এপ্রিল ফিউনারেল হোম সাধন দাসকে জানায়, সবকিছু সুন্দরভাবে সুসম্পন্ন হয়েছে। দেহভস্ম পেতে ৩/৪ মাস সময় লাগবে।

সাধন জানায়, নিরঞ্জনের কিছু বন্ধু তাঁকে সহায়তা করতে চাচ্ছেন। বাশার সাহেব, এদের সাথে সাধনের যোগাযোগ করে দিয়েছেন। ব্রঙ্কস কমিউনিটি বোর্ডের শাহজাহান শেখ’র সাথে আমার একাধিকবার কথা হয়েছে। তিনি খুশি যে নিরঞ্জনের সবকিছু সুসম্পন্ন হয়েছে। কাপাসিয়ার রঞ্জন রক্ষিত সাহায্যের হাত বাড়াতে চেয়েছেন। এদের বলেছি, সাধন দাস কারো সাহায্য নিতে রাজি নন; তিনি নীরবে একা কাজ করতে পছন্দ করেন। তাঁর নাম প্রকাশ না করার জন্যেও তিনি বারবার আমায় অনুরোধ করেছেন। দুখিত সাধন, আপনার অনুরোধ রাখতে পারলাম না। ‘তোমার কর্মের চেয়ে তুমি যে মহান’-এ বাক্য হয়তো আপনাদের মত মানুষের জন্যেই।

সজীব মজুমদার ছিলেন নিরঞ্জনের রুম মেট। তার সন্দেহ কোভিড-১৯-এ নয়, নিরঞ্জন হার্ট এট্যাকে মারা গেছেন। তিনি জানালেন, ক’দিন আগে নিরঞ্জনের জ্বর হয়েছিলো। ডাক্তার এন্টিবায়োটিক দিলে তিনি ভালো হয়ে যান। তবে তিনি কি নিয়ে যেন ভীষণ চিন্তা করতেন। একদিন সকালে নিরঞ্জন জানান যে, সারারাত তিনি জ্বরে ঘেমেছেন এবং তাঁর পুরো বিছানা ভিজে গেছে। এরপর মৃত্যু। ১৮ এপ্রিল। ফিউনারেল হোমের কাগজপত্রে জানলাম, তিনি বাড়িতে মারা গেছেন। সজীবকে জিজ্জাসা করলাম, আপনি এক রুমে থাকতেন, আপনার করোনা ভাইরাস হয়েছে? তিনি জানালেন, না, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ।

কাপাসিয়া সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক উত্তম সাহা’র সাথে হয়েছে। তিনি নিরঞ্জন সাহা’র বাংলাদেশে থাকা সবচেয়ে ছোটভাই বিপ্লব মল্লিকের সাথে থ্রিওয়ে লাইনে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। বিপ্লব মল্লিককে সবকিছু খুলে জানালাম। তিনি সাধন দাস ও অন্যান্য সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানালেন। পরে উত্তমের কাছে একটি লিখিত ধন্যবাদ পাঠিয়েছেন, যাতে লিখেছেন, “দাদা, আপনাদের মত ভালো মানুষ আছে বলেই আমার দাদা’র সৎকার্য সম্পন্ন হচ্ছে। আর আপনারা আমাদের পরিবারের পূজনীয় মানুষ হয়ে থাকবেন সারাজীবন। আর আপনাদের পরিবারের সবাই সুখে শান্তিতে থাকুক, সৃষ্টিকর্তার কাছে এই আশীর্ব্বাদ করি।”

আমরা খুশি যে, নিরঞ্জনের লাশ বেওয়ারিশ হয়নি, কমিউনিটিতে তার অনেক সুহৃদ আছেন। কাপাসিয়ার যারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাদের বলেছি, আপনার তার জন্যে কিছু টাকা তুলে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেন, তারা তাই করবেন বলেছেন। গাজীপুর-কাপাসিয়া এখন একত্রে নিরঞ্জন মল্লিকের পরিবারকে সাহায্য করবেন বলে আমায় আশ্বাস দিয়েছেন। আসলে সবাই হেল্প করতে চাচ্ছেন, এটাই মানবিকতা। যারা হেল্প করতে চাচ্ছেন, তারা এখন গাজীপুর সমিতির বা কাপাসিয়া সমিতির সাথে কথা বলতে পারেন। আবুল বাশার জানিয়েছেন, তাঁরা পরিবারটিকে সহায়তা করবেন।

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।