রহিম আব্দুর রহিম


বাঙালি জাতীয়তাবাদের পুরোধা, পাশ্চাত্য ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব, রুশবিপ্লব এবং ফরাসিবিপ্লবের অগ্রনায়ক, বাঙালির স্বাধীকার তথা আত্মনিয়ন্ত্রন অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রাণ পুরুষ , বুদ্ধিজীবি ড. আনিসুজ্জামান। যাঁর নির্ভুল পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে দিক নির্দেশিত হয়েছে ’৬৯ এর গনঅভ্যূথান, স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। বর্তমান বাঙালি জাতিসত্তা, তার পরিচয় ও মানবধারায়, বাঙালির ভাষাজ্ঞান ও ভাষা পরিস্থিতির করুন পরিনতির সরণি তুলে এনেছেন আলোর রেখায়।

সর্বদায় তিনি সমসাময়িক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের একটি বাস্তবভিত্তিক বিশ্লেষণ জাতির সামনে তুলে ধরেছেন। যেখানে দেশের সাধারণ মানুষ, তাঁদের জাতিসত্তার মৌলিক সূত্র খুঁজে পেয়েছেন। ড. আনিসুজ্জামান স্বাধীন বাংলাদেশের, ন্যায়বিচার, সুশাসন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে যখন আঘাত এসেছে, তখন তিনি একজন কলম সৈনিক হিসেবে জাতিকে সুপথ দেখিয়েছেন। যিনি জাতিকে বুঝাতে চেয়েছেন, বাঙালি জাতি যখন, ঐক্যচেতনা, জাতীয়তাবাদ এবং স্বাধীন ও সার্বভৌমত্বের মজবুত ভিত্তি স্থাপন করতে পারবে, তখনই সেই ইতিহাস-ঐতিহ্য বাঙালি জাতিসত্তার হৃদপি- হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। পান্ডিত্য, ভাষাজ্ঞান, সংযমী, তথ্যবিচারে পক্ষপাতহীনতা, অসীম অভিজ্ঞতা, বহুমুখি জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত আনিসুজ্জামান, গোটা বাঙালির কাছে ছিলেন পরিশীলিত মনীষী। তাঁর চিন্তা-চেতনা, অভিজ্ঞতা, তত্ব ও তথ্যের ভান্ডার, জ্ঞানপিপাসুদের চিন্তার প্রেরণাশক্তি হিসেবে কাজ করে। যাঁর কর্ম, লেখনি ছায়া ফেলেছে আমাদের বৃহৎ সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে। নিবেদিত প্রাণ এই শিক্ষক, জাতীয় সংকটকালে প্রচন্ড সাহস ও গর্বের লড়াই যুক্ত হয়েছেন। যার কারণেই ড. আনিসুজ্জামান নামটি আজ জাতির বাতিঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

পঞ্চাশের দশকের শুরুতে ছাত্রাবস্থায়, তিনি যুক্ত হন অসাম্প্রদায়িক সংগঠন ও আন্দোলনের সঙ্গে। গবেষক মামুন মুস্তাফা, ‘আনিসুজ্জামান নির্ভরতার প্রতিক’ শিরোনামের এক প্রসঙ্গে বলেছেন, “সাহিত্য-সংস্কৃতির হাত ধরে, ভাষা আন্দোলন ও ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে জড়িত হওয়া, এ যেনো ইতিহাসের পথ বেয়ে এগিয়ে চলা।” আনিসুজ্জামানের ভাষায়, ‘ইতিহাস আমাকে আনুকুল্য করেছে।’ হ্যাঁ, আনুকুল্যই বটে। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি জাতিসত্তার সংকটকালে তিনি রাজনৈতিক কর্মীর মতই লেখেছেন সব ইশতেহার, শিক্ষক হয়ে দেখিয়েছেন স্বাধীকার আন্দোলনের উজ্জ্বল পথ। আবার ২৪ বছরের পাকিস্তানের যাঁতাকল থেকে মুক্ত এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানেও রয়েছে তাঁর স্পর্শ।

সরল, নিরহংকারী, উঁচু মনের বিশাল এই মনীষির বাক্যশৈলী একজন শিশুর কাছেও সহজবোধ্য। নেই কোন চতুরতা, না আছে পক্ষপাত। ১৯৯৭ সালে তাঁর লেখা প্রবন্ধ, ‘সাম্প্রদায়িকতার ভাবাদর্শ’ এ উল্লেখ করেছেন, “ধর্মকেও একটা ভাবাদর্শ বলে দেখা যায়। কিন্তু ধার্মিকতা ও সাম্প্রদায়িকতার পার্থক্যটা সুস্পষ্ট। যিনি ধার্মিক, তিনি ধর্মে বিশ্বাস করেন, তার শ্রেষ্ঠত্বেও আস্থা পোষণ করেন, আপন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করেন, কিন্তু অন্যের ধর্ম পালনে বাঁধা দেন না।

যিনি সাম্প্রদায়িক, তিনি ধর্মপালনের চেয়ে নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণায় বেশি উৎসাহী হন, অন্য ধর্মের বিশ্বাস আচার-অনুষ্ঠানের অসারতা প্রমাণে ব্যস্ত থাকেন এবং সেসব আচার পালনে পারলে বাঁধা দেন। মন্দির বা মসজিদে ধার্মিক যান প্রার্থনা বা ইবাদত করতে। সাম্প্রদায়িক তৎপর হন মন্দিরকে, মসজিদকে রূপান্তরিত করতে বা ভাঙতে।” সর্বজন শ্রদ্ধেয় ড. আনিসুজ্জামান শিক্ষক হিসাবে ছিলেন শিক্ষার্থীদের ভরসাস্থল।

ছাত্রদের প্রতি তাঁর মমতাবোধ অনুকরণীয়। যাঁরা এই মহান শিক্ষকের আদর্শ লালন করেছেন, অনুকরণ করতে পেরেছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই আজ স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আদর্শের প্রতিকৃতি ড. আনিসুজ্জামান কোন কৃতিত্বের অধিকারি হয়ে আত্মপ্রকাশ করতে চান নি। ২২ বছর বয়সে তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন । ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের রিডার হিসাবে যোগদান করেন । ১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন ।

ভরাট কণ্ঠের সুঠাম দেহের জ্ঞানজ্যাতি, সাদা মনের এই শিক্ষক গায়ে পড়তেন ঢিলে-ঢালা পাঞ্জাবি, পরনে পায়জামা , চলতেন মাথা নিঁচু করে; ছাত্রদের সম্বোধন করতেন বাবা বলে। বসতেন , বাংলা বিভাগের ২০১১ নম্বর কক্ষে । আমি ১৯৮৮-৮৯ শেসনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র হওয়ায় , এই মহান মানুষটিকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম। ছাত্র হিসেবে নয়, একদিন তাঁর সাথে পরিচয় হতে যাই লেখক হিসেবে। জানতে চান নাম, বললাম, মো: আব্দুর রহিম; লেখকনাম, ‘রহিম আব্দুর রহিম।’ মুখের দিকে তাঁকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ‘নামের মাঝে চালাকি রয়েছে।’ সদাহাস্য প্রফুল্ল মনের অধিকারী এই মনীষির কাছে আর কখনও লেখক নই, ছাত্র হিসেবে পরিচয় দিয়ে গর্ববোধ করেছি।

তাঁর সততা, নিষ্ঠা, কীর্তি সব কিছুই আমাদের স্বরণীয় এবং অনুকরণীয়। সেই থেকে স্যারের সাথে যোগাযোগ, ওঠাবসা। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর লেখনির নিয়মিত পাঠক। ওই সময়েই আমার অন্যান্য শিক্ষকদের মধ্যে বর্তমান কবি কাজী নজরুল ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপার্সন, জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম, রবীন্দ্র গবেষক ও ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা ড. সনজিদা খাতুন, প্রথাবিরোধী ও পাঠক প্রিয় লেখক, প্রয়াত ড হুমায়ুন আজাদ, অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক, অধ্যাপক আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ এর আমি প্রিয়ভাজন হয়ে উঠি। ’৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময়, প্রিয় লেখক হিশেবে অন্তকরণে স্থান পান, বাংলা একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক ও গবেষক শামসুজ্জামান খান। এঁদের লেখনি, আদর্শ আমাকে সর্বদায় কাছে টেনেছে, টানছে এবং টানবে।

১৯৯২ সালে ড. আনিসুজ্জামান তাঁর একটি লেখায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আজ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প দেখি, তখন মনে হয়, আমার জীবন সাধনা ব্যর্থ। তেত্রিশ বছর ধরে শিক্ষকতা করেও আমি কিছু শেখাতে পারি নি।’ ড. আনিসুজ্জামান স্যারের আত্মকথার প্রথম পর্ব ‘কালনিরবধি’ প্রকাশ হয় ২০০৩-এ। তার আগে প্রকাশ পায় পাঠক চিত্তজয়ী মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথন ‘আমার একাত্তর’-১৯৯৭। তাঁর ‘বিপুলাপৃথিবী’ প্রকাশ হয় ২০১৫-তে। যা সাহিত্য ভান্ডারের অমুল্য রতন। ড. আনিসুজ্জামান তাঁর কর্মের মধ্য দিয়েই প্রমাণ করেছেন, তিনি মুক্তবুদ্ধি চেতনার বাঙালি, ধর্ম নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক মহীরূহ। যিনি কখনও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির সঙ্গে আপোস করেননি; যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে গণ আদালতে, একই কায়দায় বিশেষ ট্রাইব্যুনালেও একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন অকুতভয়ে।

শিক্ষক আনিসুজ্জামান বাঙালির মণীষার এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। তাঁর জীবন, কর্ম আমাদের জন্য এক মহান আদর্শ। ১/১১ এর পর আর্মি শাসিত সরকার আমলে স্যারের সাথে একত্রিত হয়েছিলাম, ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ঢাকার এক সেমিনারে। এই সেমিনারে তিনি অগণতান্ত্রিক মিলিটারি শাসিত সরকারের বিদায় চেয়ে, তৎকালীন রাজবন্দি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সকল বন্দির মুক্তি চেয়েছেন অকপটে। এই মহান শিক্ষককে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ২০০৫ সালে ডি’লিট উপধি সম্মানে ভূষিত করেন। তিনি প্রথম বাংলাদেশী, যিনি ভারতের পদ্মভূষণ উপাধি পেয়েছেন।

মহাপান্ডিত্যের অধিকারী, সুবিনয়ী আনিসুজ্জামান স্যারকে, ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমীর সাধারণ সভায় শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ পেয়েছি। ওই দিন তিনি ষাটোর্ধ্ব এক সদস্যের বক্তব্যের সংশোধনী আনতে গিয়ে শিক্ষকসুলভ ভাষায় বলেছিলেন, “বাংলা একাডেমীতে মহাসচিব থাকেন না, থাকেন মহাপরিচালক বা সভাপতি।” মানুষের কাতারে থাকা এই তারুণ্যের প্রতীক, জ্ঞানদ্রষ্টা ১৯৫৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তাঁর শিক্ষকতা পেশায় ব্রত ছিলেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম এর বাহিরেও তিনি কলকাতার মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারোলাইন স্টেট ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং ফেলো হিসেবেও যুক্ত ছিলেন।

তিনি দেশ ও বিদেশের শাশ্বত সমাজ থেকে পেয়েছেন যোগ্যতার স্বীকৃতি। যিনি মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত বাংলা একাডেমীর সভাপতি পদে থেকে এই প্রতিষ্ঠানের গৌরবদীপ্ত মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। কর্মদীপ্ত মহান ব্যক্তি ড. আনিসুজ্জামান স্যারের সর্বশেষ সাণিধ্য পেয়েছি, এ বছর (২০২০) ২ ফেব্রুয়ারি, রবিবার, ২১শে বইমেলায়। তাঁর সভাপতিত্বে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বই মেলার উদ্বোধন করেন। উদ্বোধন শেষে ৮৩ বছর বয়স্ক চিরতারুণ্যের প্রতীক ড. আনিসুজ্জামান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বিভিন্ন স্টল পরিদর্শন করেন।

আমি আমার শ্রদ্ধেয় সকল শিক্ষক শুভাকাঙ্খীদের সাথে মাঝে মাঝে কথা বলি, তাদের খোঁজ-খবর রাখি। এবার ড. আনিসুজ্জামান স্যারের সাথে মুঠোফোনে কথা বলি ১১ মার্চ বেলা পৌনে বারোটার দিকে। সালাম দিতেই বলেছিলেন, ‘বলো রহিম, কি বলবে।’ তাঁর প্রখর স্মৃতিশক্তি গৌরব করার মত। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারি ড. আনিসুজ্জামান। তাঁর পিতা এ টি এম মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন নামকরা হোমিও প্যাথিক চিকিৎসক মাতা সৈয়দা খাতুন । পিতামহ শেখ আব্দুর রহিম লেখালেখি করতেন। ১৫ বছর বয়সেই আনিসুজ্জামান লেখেন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের উপর এক পুস্তক। প্রাতিষ্ঠানিক কৃতিত্ব তাঁর অসাধারণ। অনার্স-মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং সর্বোচ্চ নম্বর অর্জনকারী।

যশস্বী মনীষী আনিসুজ্জামান বাংলা ভাষাভাষী মানুষের শুদ্ধ সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও ঐতিহ্যের পথিকৃৎ। সৃজনকৃতির স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি পেয়েছেন, বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭০), অলক্ত পুরস্কার (১৯৮৩), একুশে পদক (১৯৮৫), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, দাউদ পুরস্কার (১৯৬৫), নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক পদক (১৯৫৬)। কীর্তিমান এই সাহিত্য সাধককে ২০১৫ সালে স্বাধীনতা পদক দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে। সম্মানসূচক উপাধি, ‘জাতীয় অধ্যাপক’ হিসাবে নিয়োগ পান, ২০১৮ সালের ১৯ জুন । বোধের গবেষক, স্বভাবের লেখক, ড. আনিসুজ্জামান এঁর মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৬৪), মুসলিম বাংলা সাম্প্রদায়িকপত্র (১৯৬৯), মুনীর চৌধুরী (১৯৭৫), স্বরূপ সন্ধানে (১৯৭৬), আঠারো শতকের বাংলা চিঠি (১৯৮৩), মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ (১৯৮৩), পুরানো বাংলা গদ্য (১৯৮৪), মোতাহার চৌধুরী (১৯৮৮), আমার একাত্তর (১৯৯৭), আমার চোখে (১৯৯৯) ও কালনিরবধি (২০০৩) বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের আকরগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। দায় ও দায়িত্বশীল সমাজ অভিভাবক, রাষ্ট্রচিন্তক ড. আনিসুজ্জামান এঁর শিক্ষক ছিলেন মুনীর চৌধুরী ও মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর সহপাঠী ছিলেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল।

ড. আনিসুজ্জামান এঁর এক সাক্ষাৎকারে ওঠে আসে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মানব্রতীর এক অজানা চরিত্র। যেখানে বিশ্রামের জন্য সাধারণের সাথে দেখা না করার অনুরোধের প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “লোককে খেতে দিতে পারি না, পরতে দিতে পারি না, দেখাও যদি দিতে না পারি, তাহলে আমার আর থাকলো কি?” ড. আনিসুজ্জামান স্যারের একটি সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন গবেষণা সাহিত্যপত্র ‘লেখমালা’র সম্পাদক। মোট ২১ টি প্রশ্ন উত্তর নিয়ে গ্রন্থিত সাক্ষাৎকার পর্বের তিনটির উত্তর উপস্থাপিত।

১৯৭২ সালের ড. কুদরত ই-খুদা জাতীয় শিক্ষা কমিশনের এই সদস্য বলেন, “বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের আগের দফায় যে শিক্ষানীতি গৃহীত হয়েছিল, তার প্রয়োগ তেমন হয়নি। আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে যা পেয়েছি, সেটাই অনেকখানি ঘষামাজা করে আসছি। পাঠ্যপুস্তক নিয়ে সম্প্রতি যা ঘটলো, তাতে মনে হয়, গৃহিত নীতি বাস্তবায়নে আমরা উৎসাহী নই। আমার মনে হয় না, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা একজন শিক্ষার্থীর সকল সম্ভাবনার বিকাশে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখতে পারছে।

তবে আমরা যেভাবে বড় বড় শিক্ষিত মানুষদের জানি, তাদের প্রতিভা বিকাশে শিক্ষা ব্যবস্থার কোন ভূমিকাই ছিল না, একথাও তো সত্য।’ ‘অনেক দেশেই প্রাথমিক শিক্ষার পরীক্ষা পদ্ধতির স্থান নেই। রবীন্দ্রনাথও তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে তেমনই করেছিলেন। আমাদের দেশে শিক্ষকরা এবং অভিভাবকরা পরীক্ষার প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দেন। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সনদ কাজে আসবে, এই বিশ্বাস থেকে আমরা বেশি বেশি পরীক্ষার ব্যবস্থা রেখেছি। অভিভাবকরাও চান, ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় ভাল করুক। কি শিখলো তা নিয়ে তাঁদের মাথ ব্যথা নেই।’ ‘বুদ্ধিজীবিদের বিচার বিশ্লেষণ, বক্তব্য, দিক নির্দেশনা কখনও কখনও কোনো কোনো দলের পক্ষে যেতেও পারে, তবে তাঁরা যদি রাজনৈতিক দলের কোটরে চলে যান, তাহলে মানুষ তাঁদের বক্তব্য নিরপেক্ষ বলে গ্রহণ করতে পারে না। আমি যদি কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষপাতিও হই, তবে সেই দল ভুল কিছু করলে, আমাকে তা স্পষ্ট করে ভুল বলেই ব্যাখ্যা দিতে হবে।

বুদ্ধিজীবিরা অনেক সময়, এই কাজটি করতে পারেন না, কেননা তাঁদের ভয় হয়, তাঁদের সমালোচনা সেই বিরোধী পক্ষের হাত শক্ত করবে। যাদের তিনি দেশের হিতাকাঙ্খী বলে গণ্য করেন না। দেশ ও সমাজ গঠনে ভুমিকা রাখতে হলে, এই ভয় কাটিয়ে ওঠতে হবে।” নির্ভীক, স্পষ্টভাষী, শিক্ষাবিদ, জাতির বিবেক ড. আনিসুজ্জামান স্যারের শারীরিক খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য ১৩ মে তাঁর মুঠোফোনে যোগাযোগ করে তাঁর কোন স্বজনদের পাইনি। সর্বশেষ তাঁর শারীরিক অবস্থা জানার জন্য বাংলা একাডেমীর বর্তমান সচিব, মোহম্মদ আনোয়ার হোসেনের সাথে ১৪ মে বেলা সোয়া ১১ টায় ফোনে কথা হয়েছিল।

তিনি জানিয়েছিলেন, ‘অবস্থা ততটা ভাল না।’ ওইদিনই তিনি মারা যান। ড. আনিসুজ্জামান এর আদি নিবাস পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বশিরহাট মহকুমার মোহাম্মদপুর গ্রামে। তিনি ১৯৩৭ এর ১৮ ফেব্রুয়ারি কলিকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তরুন বয়সেই তিনি যুক্ত হন প্রগতিশীল আন্দোলনে। সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন ভাষা আন্দোলনে। জগন্নাথ কলেজের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন তিনি। রবীন্দ্র উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলন এবং অসহযোগ আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। প্রবন্ধ, গবেষণায় অবদানের জন্য ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমী পদক পান; একুশে পদকে ভূষিত হন ১৯৮৫ সালে।

শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘পদ্মভূষণ’ লাভ করেন ২০১৪ সালে। অমর এই মহীরূহ শিক্ষকের দেহাবসান ঘটে ২০২০ সালের ১৪ মে, বৃহস্পতিবার বিকেল ৪.৫৫ মিনিটে, ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। অমর এর মৃত্যু নাই, আদর্শের পতন নেই। তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ১৫ মে সকালে দাফন করা হয়েছে আজিমপুর কবরস্থানে তাঁর বাবার কবরের পাশে। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় গত ২৭ এপ্রিল বরেণ্য এই শিক্ষাবিদ রাজধানীর ইউনিভার্সেল কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি হার্ট, কিডনি, ফুসফুস, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। জাতির সকল দুঃসময়ের আলোকবর্তিকা মুক্তিকামী মানুষের পাঞ্জেরী, আদর্শের উজ্জ্বল নক্ষত্র ড. আনিসুজ্জামান এঁর ছাত্র হওয়ায় আমি এবং আমরা গর্বিত।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র, বাংলা একাডেমীর সাধারণ সদস্য-৪০৩৭