রণেশ মৈত্র


চারিদিকে নিঝুম, নিস্তব্ধ, হিমশীতল। সর্বত্র গতিহীনতা। করোনার করুণায় দেশই নয় শুধু পৃথিবীটাই যেন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারও সাথে কারও দেখা নেই। ঘর থেকে বাইরে বেরুনো নেই। কী এক দুঃসহ পরিবেশ গ্রাস করেছে গতিময় প্রাণচঞ্চল আমাদের ভালবাসার এই পৃথিবীটাকে। 

এই হিমশীতল পরিবেশের অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছি, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২৬ মার্চ থেকে। ঐদিন থেকে সারা দেশে লক ডাউন ঘোষণা করা হয়। তা আজও অব্যাহত। তাই সেদিন থেকে গাড়ী-ঘোড়া গণপরিবহন বন্ধ। স্থবির জীবনযাত্রা।

মাস খানেক আগে, দিন তারিখ স্মরণে আনতে পারছি না, আনিস ভাইকে ফোন করেছিলাম সকাল এগারটার দিকে। কেমন আছেন আনিস ভাই বলতেই তিনি বলে উঠলেন, আমি ভাল নেই রণেশ বাবু। আঁতকে উঠেছিলাম সেদিন। “ভালো নেই” এমন কথা তো তাঁর নিজের সম্পর্কে তাঁর মুখে বলতে কোন দিন শুনি নি। মুহুর্তেই তিনি বলে উঠলেন, “কিছুক্ষণ পরে কথা বলি দাদা?” এবার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়, শংকা বোধে আচ্ছন্ন হয়ে “ঠিক আছে আনিস ভাই” বলে ফোনটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ওই তাঁর সাথে শেষ ফোনালাপ।

সেদিন শংকিত বোধ করলেও তার এক মাস যেতে না যেতেই যে ১৪ মে সন্ধ্যায় হঠাৎই টেলিভিশন চ্যানেলগুলি তাঁর চিরবিদায়ের বেদনার্ত খবরটি জানাবে তা আদৌ ভাবতে পারি নি। তবে তিনি যতদিন যাবত যত বেশী অসুস্থ ছিলেন তাতে আনিস ভাইকে যে কোন মুহুর্তে হারাতে হতে পারে এমন ভাবনা প্রায়শই মনোজগতে ভেসে উঠতো। কিন্তু দুর্ঘটনাটি যে এত সত্বরই ঘটবে তা কল্পনাতেও আনতে পারি নি।

২৭ এপ্রিল আনিস ভাইকে ভর্তি করা হয়েছিল ঢাকার ইউনিভার্সাল মেডিক্যাল হাসাপাতাল নামক বিতর্কিত বেসরকারি হাসপাতালে। দীর্ঘ ১২ দিন চিকিৎসার পরেও উন্নতি ঘটছে না জানতে পেরে তাঁর ছাত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করলেন। ৯ মে তাঁকে সেখানে ভর্তি করা হলো। মাত্র পাঁচদিন পর তিনি পরপারে পাড়ি জমালেন। তিনি করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন বলে জানা গেল।

প্রশ্নটির জবাব চাই

ইউনিভার্সাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালে তাঁর দেহে করোনা সংক্রমণ হয়েছিল কি? জানলাম সেখানে ভতির পর পরই টেষ্ট করা হয়েছিল কিনা এবং ফলাফল কি ছিল? কিন্তু টেষ্ট না করা হয়ে থাকলে বলাই যায় ইউনিভার্সালে থাকাকালেই তিনি করোনা সংক্রমিত হয়েছিলেন। এমন সন্দেহ এড়াতে পারছি না। কারণ খোদ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তির পর সেখান থেকে সংক্রমণ হওয়া অসম্ভব ছিল। তবু হয়েছিল কি না তার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করি। কিন্তু সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের চিকিৎসকেরা যখন তাঁর করোনা সংক্রমণ ঘটেছে কিনা জানার জন্য ১৪ মে সকালে টেষ্ট করে ঐ দিন সন্ধ্যার পরে নিশ্চিত হলেন আনিস ভাই করোনা সংক্রমিত। ঐদিন সন্ধ্যায় রিপোর্ট পাওয়ার আগেই তিনি মারা গেলেন। মৃত্যুর পর তাঁরা আবার টেষ্ট করে আবারও পজিটিভ পেলেন। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে থাকা কালেই কি তবে তিনি সংক্রমিত হয়েছিলেন?

তা হলে বুঝা যায়, ড. আনিসুজ্জামান হাসপাতালে থাকা কালেই করোনায় আক্রান্ত হন। ফলে অন্য রোগীদের সহ করোনা আক্রান্ত রোগীদের নিরাপত্তা ও চিকিৎসা প্রশ্নবিদ্ধ ও বিপদজনকও।

তাই দাবি করি উচ্চ পর্য্যায়ের তদন্ত করে দেখা হোক ঘটনা তেমন কিনা। সংক্রমণ যদি তাঁর বাড়ী থেকে হতো, তা হলে তো হাসপাতালে ভর্তি করে টেষ্ট করে তা ইউনিভার্সালের হাসপাতালেই ধরা পড়তো।

তাই যদি আমরা ও দেশবাসী কোন হাসপাতালের বিন্দুমাত্র অবহেলায় দেশের এই খ্যাতিমান মানুষটাকে হারিয়ে থাকি তবে তা কেউই সহ্য করতে পারবো না। সুতরাং উচ্চপর্য্যায়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে অবিলম্বে তদন্ত করা হোক কবে এবং কিভাবে তিনি করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হলেন। আশা করি সরকার ও স্বস্থ্য মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র গাফিলতি দেখাবেন না।

মনে পড়ে, অতীতের কথা

দেশ-বিদেশে লক্ষাধিক ছাত্র-ছাত্রীর স্যার তিনি। কিন্তু আমার শুধুই আনিস ভাই। কদাপি আমি কোন বিশ্ববিদ্যালয় পড়িনি-তাই তাঁর ছাত্র হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তদুপরি আমি বয়সে আনিস ভাই এর প্রায় চার বছরের বড়।
তাই কোন শিক্ষাঙ্গনে তাঁর সাথে আমার পরিচয় ঘটেনি-ঘটেছে আরও অনেক বৃহৎ এক অঙ্গনে এবং ইতিহাস সৃষ্টির কারিগর হিসেবে উভয়ে উভয়ের সাথে পরিচিত হই। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন ও তারও আগে ১৯৪৮ সালে গঠিত গণতান্ত্রিক যুব লীগের সদস্য হিসেবে। আনিস ভাই ছিলেন ঐ যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দফতর সম্পাদক। আমি পাবনা জেলা কমিটির একজন সদস্য। সাংগঠনিক কাজে ঢাকা গেলেই দেখা এবং আলোচনা হতো। এটা ১৯৫২ সালের কথা। কয়েক বছর আগেও আনিস ভাই আক্ষেপ করে বলেছেন, “ভাষা আন্দোলনে এত গৌরবজনক ভূমিকা পালন করা সত্বেও তাতে যুবলীগের ভূমিকার সঠিক মূল্যায়ন আজও হলো না।”

আমাদের পরিচয়ের স্মৃতিকথা আনিস ভাই আমার ৭৭ তম জন্ম উপলক্ষে প্রকাশিত গ্রন্থে লিখতে নিয়ে বলেছেনঃ
রণেশ মৈত্রের সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ হয় ১৯৫২ সালে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্বে। তিনি পাবনায় যুবগলীগের ধ্বজা ধরে রেখেছিলেন, আমি ছিলাম ঢাকায় যুবলীগের দফতর সম্পাদক। শাখা সংগঠনগুলির সঙ্গে সমন্বয়ের দায়িত্ব ছিল আমার কাজের অন্তর্গত। সেই সূত্রে যোগাযোগ, পরে বন্ধুত্ব। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ১৯৫২ সালে যুবলীগের বড় ভূমিকা ছিল, সে ভূমিকার যথাযথ স্বীকৃতি বোধ হয় আজও মেলে নি। সারা পূর্ববাংলায় এই আন্দোলনে ১৯৫২ সালে যুবলীগের বড় ভূমিকা ছিল, সে ভূমিকার যথাযথ স্বীকৃতি বোধ হয় আজও মেলে নি। সারা পূর্ববাংলায় এই আন্দোলনে যাঁরা নেতৃস্থানীয় ছিলেন, তাঁদের মধ্যে যুবলীগের নেতা-কর্মীরাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই আন্দোলনের প্রত্যক্ষদর্শীরা এখনও তা স্বীকার করেন।

“অর্ধ শতাব্দীরও বেীশ কাল ধরে আমাদের বন্ধুত্ব,” লিখেছিলেন আনিস ভাই।

এই বন্ধুটিকে হারিয়ে তাঁকে নিয়ে লিখতে বসে যেন ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। কি লিখবো তাও যেন বুঝে উঠতে পারছি না। তবু বন্ধুটির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ এবং শেষ স্যালিউট জানাতেই এই নিবন্ধটি লেখার ক্ষুদ্র অথচ আন্তরিক প্রচেষ্টা।

আমি আজীবন পাবনায় থাকলাম। পাবনাতে থেকেই যাবতীয় কর্মকা- পরিচালনা করলাম। আর আনিস ভাই তাঁর জীবনের বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করলেন ঢাকাতে। তাই দেখা সাক্ষাতের সুযোগটা তেমন বেশী একটা জুটে ওঠে নি। তখনকার দিনে পাবনা-ঢাকা যাতায়াতে প্রায় ৪০ ঘন্টা সময় লেগে যেতো।

পরবর্তীতে আনিস ভাই বেছে নিলেন শিক্ষকতার জীবন। এটা শুধুমাত্র তাঁর পেশা বা অর্থ উপার্জনের মাধ্যম ছিল তা নয়। শিক্ষকতার মধ্যেই তিনি দেশ গড়ার শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম খুঁজে পেয়েছিলেন যেন।

দেশের ভবিষ্যত সম্পর্কেও ড. আনিসুজ্জামান ছিলেন প্রচ- আশাবাদী। ঐ নিবন্ধটিতেই শেষ দিকে তিনি লিখেছিলেনঃ
“জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা। তাঁর (অর্থাৎ আমার) মতো জীবন সাধকেরা যে ভিত্তি রচনা করেছন, তার ওপর সৌধ একদিন গড়ে উঠবেই। তিনি বা আমি হয়তো তা দেখে যেতে পারব না, কিন্তু আমাদের মনোবাঞ্ছা আদৌ অপূর্ণ থাকবে না।” এহেন আশাবাদী মানুষটি সত্যই তাঁর জীবনের সকল আশার পূর্ণতা দেখে যেতে পারলেন না। বস্তুত: তাঁর এই মৃত্যু যদিও তাঁর ৮৩ বছর বয়সে ঘটলো তবুও বলবো এটা অবশ্যইpremature death অগ্রিম মৃত্যু। কারণ মানুষের গড় আয়ু অনেক বেড়েছে এবং এখন বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর অনেক দেশেই (আফ্রিকার দেশগুলি ছাড়া) বেশ ভাল সংখ্যক শতবর্ষী পুরুষ ও নারীর সন্ধান পাওয়া যায়।

আনিস ভাইকে কেমন দেখেছি আমি? রাজনৈতিক ও সাংবাদিকতার জগতেই আমার আজীবন বিচরণ। রাজনীতির গভীর পর্য্যবেক্ষক এবং বাম ধারার প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতি আজীবন আকর্ষণ থাকা সত্বেও সরাসরি কোন দলীয় রাজনীতির ছাপ তিনি গায়ে লাগান নি বরং নীতি আদর্শের প্রতি অবিচল নিষ্ঠ থেকে উদার দৃষ্টিভঙ্গীকেই সর্বদা লালন করছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। সে কারণে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল সর্বজনীন। তিনি অসাম্প্রদায়িক যে কোন দলের সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেলে অবাধে তা গ্রহণ করতে, তাতে সম্মতি দিতেন এবং শরীর স্বাস্থ্যের প্রতিকূলতা উপেক্ষা করেই তিনি সেই সম্মেলন-সমাবেশে যোগ দিতেন-ভাষণ দিতেন। কোন সংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠনের আহ্বান পেলেও তাই।
এর অর্থ এই নয়, তাঁর অখ- অবসর ছিল। আদৌ তা নয়। শিক্ষকতা, লেখালেখি তাঁকে অত্যাধিক ব্যস্ত করে রাখতো। তা সত্বেও তাঁর বিচরণ ছিল অবাধ ও বহুমুখী।

অনেকেই লিখেছেন, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে তাবৎ গণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ঈর্ষণীয় অংশগ্রহণ ছিল। অবশ্যই ছিল তবে কোন দলীয় পরিচয়ের ছাপ লাগিয়ে নয়। একাত্তরে ভারতে গিয়ে তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের অন্যতম সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তদুপরি ঐ সময়ে পশ্চিম বাংলায় চলে যাওয়া শত শত শিক্ষককে সংগঠিত করে তাঁদেরকেও মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে যোগদান করাতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন আনিস ভাই।

প্রায় ৭০ টিরও বেশী উচ্চমান সম্পন্ন গ্রন্থের রচয়িতা অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। কিন্তু এতগুলি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া সত্বেও তিনি ছিলেন লক্ষ্যনীয়ভাবে আত্মপ্রচার বিমুখ। পারিবারিক জীবনের দায়িত্ব কতটুকু পালন করেছেন তা জানা না গেলেও দেশ ও জনগণের জন্য যথাযথ দায়িত্ব পালনে তিনি কদাপি পিছপা হন নি।

কৈশোর-যৌবনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালনের মধ্যে দিয়ে তিনি জানান দিয়েছিলেন, তিনি সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ ও সকল প্রকার শোষণ বিরোধী। সেই চেতনা জীবনের শেষ দিন পর্য্যন্ত লালন করে গেলেন।

আমরা নিশ্চয়ই ভূলে যাই নি, শিক্ষাবিদ এবং লাখো ছোত্র-ছাত্রীর প্রিয় স্যার অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে মাত্র বছর দু’তিন আগে একটি গোপন মহল থেকে হুমকি দিয়ে জানানো হয়েছিলো তিনি তাদের হিট লিষ্টে আছেন এবং যে কোন সময় তাঁকে হত্যা করা হবে। তিনি যেন তার জন্য প্রস্তুত থাকেন। এমন হুমকি আনিস ভাইকে দেশের কল্যানকামী কোন মহল থেকে নয়, দেওয়া হয়েছিল ধর্মীয় উগ্রপস্থীদের পক্ষ থেকে। সরকারিভাবে পুলিশ প্রহরায় ব্যবস্থা করা হয়েছিল তাঁর বাসভবনের সন্নিকটে কিন্তু তিনি দমে যান নি যথারীতি নানা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ চালিয়েই গেছেন।
উল্লেখ্য, এই উগ্রপন্থীরা ধর্মের আবরণে বাংলাদেশে অনেক ব্লগারকে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে ঐ বিজ্ঞান মনস্ক উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদেরকে কখনও প্রকাশ্য দিবাভাগে আবার কখনও সন্ধ্যা বা রাতের অন্ধকারে নির্মমভাবে হত্যা করেছে ঢাকা নগরীর নানা এলাকায় এবং তার বাইরেও বহু স্থানে। কিন্তু ঐ অপরাধীরা বহু ক্ষেত্রেই শাস্তি পায় নি।

এই সময় স্পষ্ট উচ্চারণে একমাত্র বন্ধুবর অধ্যাপক আনিসুজ্জামানই প্রকাশ্য এক সমাবেশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ধর্মে “বিশ্বাস করার যেমন তেমনই বিশ্বাস না করার অধিকারও থাকতে হবে।” এমন উচ্চারণ হালের বাংলাদেশের আর কারও কণ্ঠ থেকে শুনা যায় নি।

সাহস তাঁর জন্মজাত। তাই বাল্যকালে ভারত থেকে আসার অল্প কিছুকাল প্েরই আনিস ভাই নেমে পড়েন ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সর্বপ্রথম অসাম্প্রদায়িক যুব সংগঠন, সা¤্রাজ্যবাদ ও শোষণ বিরোধী যুব সংগঠন গড়ে তুলতে ভূমিকা পালন করেন। যার পদাংক অনুসরণ করেই পুর্ব পাকিস্তানের বুকে প্রথম অসাম্প্রদায়িক ও সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন নামে জন্ম নিয়েছিল এবং ব্যাপক অবদান রেখেছিল ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সমস্ত গণতান্ত্রিক, সাংস্কৃতিক ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোনে ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে।

ছাত্র ইউনিয়নের মূল মেনিফেষ্টোটি আনিস ভাই-ই রচনা করেছিলেন যেমন বাহাত্তরের ইংরেজী ভাষায় প্রণীত সংবিধানটির সফল বঙ্গানুবাদ তিনিই করেছিলেন। একদিকে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান, তাজ উদ্দিন আহমেদ ও ড. কামাল হোসেনের ঘনিষ্ঠ অপরদিকে তিনি ছিলেন কমরেড মনি সিংহ, জ্ঞান চক্রবর্তী, অনিল মুখার্জী প্রমুখেরও বিপুল স্নেহভাজন।

তিনি নিজেই বহুবার বাংলাদেশের মানুষের কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেছেন “দেশেল মানুষ আমাকে অনেক দিয়েছে”। সত্যিই তাই এবং অধিকতর সত্য হলো বিদেশে ও তিনি যথেষ্ট নন্দিত হয়েছেন দেশ-বিদেশে অসংখ্য সম্মাননাও পেয়েছেন তাঁর সাহিত্য কর্ম-রবীন্দ্র অনুরাগের জন্য।

একটি বেদনা অবশ্য আমি অনুভব করি। সারাজীবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃতিত্বের সাথে অধ্যাপনা করলেও একাবরের জন্যও তাঁকে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পদে নিয়োগ দিয়ে আনুষ্ঠানিক সম্মান দেখানো হয় নি।

এই আমার ক্ষুদ্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আনিস ভাই অমর।
ড. আনিসুজ্জামানের মৃত্যু নেই।
অনুরাগিরা একটি সুযোগ পেলেন না

ড. আনিসুজ্জামান মারা গেলেন। কিন্তু এমন এক ছোঁয়াচে রোগে যে শহীদ মিনারে মরদেহে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে হাজার হাজার শুভার্থীরা তাঁর মরদেহে ফুল দিতে, শ্রদ্ধা ও শেষ বিদায় জানানোর সুযোগ পেলেন না।

লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।