আবীর আহাদ


বিএনপি-জামায়াত ও জাতীয় পার্টির সাথে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনো সম্পর্ক নেই । সময়ের সদ্ব্যবহার করে কেবলমাত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারকে পদদলিত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভোগ, দুর্নীতি ও লুটপাট করাই ছিলো তাদের লক্ষ্য । বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, জনগণের আর্থসামাজিক মুক্তি, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ও বাংলাদেশের সংবিধানে চার মূলনীতিমালা প্রভৃতির প্রতি তারা কখনোই দায়বদ্ধ ছিলো না । বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী তো ছিলো মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর একটি দুর্ধর্ষ সশস্ত্র সহযোগী । তারাসহ মুসলিম লীগ, পিডিপি, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক দল রাজাকার আলবদর আলশামস আলমুজাহিদ ও শান্তি কমিটি, চৈনিক তথাকথিত বামপন্থীরা ত্রিশ লক্ষ মানুষ হত্যা, পৌনে তিন লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমহানি, আওয়ামী লীগার, মুক্তিযোদ্ধা ও হিন্দুদের বাড়িঘর লুটপাট ও পুড়িয়ে দেয়া, সারা দেশের গ্রামগঞ্জ শহরবন্দর খাদ্যশস্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি পৈশাচিক কার্যকলাপে নেতৃত্ব দিয়েছিলো । ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক তিরোধানের পর জামায়াত স্বনামে আত্মপ্রকাশ করে এবং অন্যরা বিএনপি ও জাতীয় পার্টিতে ঢুকে পড়ে । ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা তাদের কাছে কেউ আশা করে না ।

কিন্তু আওয়ামী লীগ ?

আওয়ামী লীগের গর্ভ থেকেই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার আবির্ভাব । তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকার বাস্তবায়ন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ দায়বদ্ধ । আওয়ামী লীগ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় একটি দেশ, একজন জাতির পিতা, একটি জাতীয়তা, একটি জাতীয় পতাকা, একটি জাতীয় সঙ্গীত বাঙালিকে উপহার দিয়েছে একটি সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে । এখানে মুক্তিযোদ্ধারাই মুখ্য । কারণ মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলো বলেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছে । কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ রচিত আমাদের জাতীয় সংবিধানের মূলস্তম্ভ 'প্রস্তাবনা'র কোথাও মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ শব্দদ্বয় সন্নিবেসিত হয়নি । এখানেই আমাদের আপত্তি, মনোবেদনা ও অভিমান ।

এ-কারণে আমি সব ভয়ভীতি ও প্রলোভন উপেক্ষা করে উদ্যোগি হয়ে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ব্যানারে আজ প্রায় তিন বছর হলো, আমাদের জাতীয় সংবিধানে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ শব্দদ্বয় সন্নিবেসসহ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে অমুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদের লক্ষ্যে একটি আন্দোলনের গোড়াপত্তন করেছি যা এখনো চলমান । বিষয়টি অনুধাবন করে আওয়ামী লীগ গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের দলীয় ইস্তাহারে 'মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও তাদের মর্যাদা পুন:প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছিলো । অপরদিকে আমাদের দ্বিতীয় দফা 'অমুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদ' দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সরকার ঢিমেতালে হলেও একটি ভুয়া-উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছে । আমরা ভুয়া উচ্ছেদ তথা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের বাহাত্তর সালের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে একটি উচ্চপর্যায়ের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের কথা বলেছি যাতে সত্যিকার অর্থে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি স্বচ্ছ ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য তালিকা তৈরি করা হয় ।

আমরা চাই, মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় কোনো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা থাকবে না, অপর দিকে কোনো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা বহির্ভূত থাকবে না । স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছরেও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়নের এ-ব্যর্থতা ক্ষমার অযোগ্য । বঙ্গবন্ধু সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাকে এড়িয়ে বিভিন্ন গোঁজামিলের সংজ্ঞায় অর্থ আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক প্রভাবে অমুক্তিযোদ্ধারা, এমনকি রাজাকারদেরও মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়া হবে, এমনটি তো হতে পারে না । অকারণে অমুক্তিযোদ্ধারা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বে ভাগ বসিয়ে জনগণের ট্যাক্সের অর্থ ও অন্যান্য সুবিধাদি ভোগ করবে এটাও তো হতে দেয়া যায় না ।

সর্বসাকুল্যে দেড় লক্ষ মুক্তিযোদ্ধার স্থলে আজ দু'লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজারের মতো মুক্তিযোদ্ধাকে সরকারের গেজেটভুক্ত করা হয়েছে । এ-নিরিখে আশি হাজারেরও বেশি অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বলে স্বীকৃতি দেয়া ইতিহাস বিকৃতির সামিল । অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের হাতে প্রায় পঞ্চাশ হাজার এবং বাকি আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে ত্রিশ হাজারেরও বেশি অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে ! বঙ্গবন্ধুর মর্যাদা ও মুক্তিযুদ্ধের শুদ্ধতার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় যে এই পরিমাণ ভুয়া আছে, তাদের বিতাড়ন করার দায়িত্ব আওয়ামী লীগকেই পালন করতে হবে । তবে এ কাজটি বর্তমান অযোগ্য মন্ত্রী মহোদয় ও জামুকাকে বহাল রেখে হবে না----এটা প্রমাণিত । আমরা বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের যে কথা বলেছি সেটিই সমাধানের একমাত্র পথ ।

আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে, আজ মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক বা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান ও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নির্ভুল তালিকা প্রণয়ন করা না হলে, ইতিহাসের কাছে আওয়ামী লীগ দায়ী থাকবে । আর বর্তমান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মহোদয়ের ক্ষমাহীন অযোগ্যতা ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতার যাবতীয় দায়ভার অকারণে বর্তে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর; আওয়ামী লীগের ওপর ! এটাতো কাঙ্খিত নয় ।

অপরদিকে মুখে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বলে গালভরা বুলিসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলা হচ্ছে, অথচ অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা যে মানবেতর জীবনযাপন করছে সে-বিষয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই ! মাসিক যে ভাতাটি দেয়া হচ্ছে, বর্তমান আর্থসামাজিক ও বাজার নিরিখে সেটা খুবই অপ্রতুল । অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা রোগাক্রান্ত । সরকারি খরচে চিকিত্সার কথা বলা হলেও সরকারি মেডিক্যাল হাসপাতালে চিকিত্সা নিতে গেলে তাদের চরম এক বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় । ইদানিং আরেকটি মারাত্মক ঘটনা ঘটে চলেছে । রাজাকার ও তাদের বংশধরেরা অর্থের বিনিময়ে আওয়ামী লীগে ঢুকে জামাই আদরে স্থান পাচ্ছে ।

এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাজাকাররা একাত্তরের পরাজয়সহ তাদের অপরাধের জন্য তারা যে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মার খেয়েছিলো, সেগুলোর প্রতিশোধ নেয়ার কার্যক্রম তারা আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় থেকে করে যাচ্ছে । প্রায়:শই দেখা ও শোনা যাচ্ছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজাকার ও তাদের পরিবারের সদস্যরা গায়েপড়ে গোলমাল বাঁধিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হত্যাসহ নানান অত্যাচার, বাড়ি লুট, অগ্নিসংযোগ করে চলেছে । প্রশাসনসহ আওয়ামী লীগের কোনো সহযোগিতা তারা পাচ্ছে না । আজ দু:খজনক সত্য, গ্রামে-গঞ্জে কিংবা শহরে সর্বত্র দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগই যেনো মুক্তিযোদ্ধাদের একমাত্র প্রতিপক্ষ ! এসব নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ হাইকমাণ্ডেরও অজানা নয় ।

আমরা অতি বেদনার সাথে লক্ষ্য করছি যে, মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা, তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও তাদের জীবনের নিরাপত্তার বিধান করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের মধ্যে এক ধরনের অনীহা দেখা যাচ্ছে । মুক্তিযুদ্ধের কথা বলবেন, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করবেন, তা তো হবে না । আজ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের দূরে সরিয়ে দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী বিএনপি জামায়াত হেফাজত ফ্রিডমপার্টিসহ সমাজের দুর্নীতিবাজ লুটেরা মাফিয়া অপশক্তিকে কিসের মোহে আওয়ামী লীগ বুকে টেনে নিয়ে দলে ও সরকারে ঠাঁই দিয়ে চলেছেন তা আমাদের বোধগম্য নয় । দলের বিপদে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকরা বুক পেতে দেয়, রক্ত দেয়----আর দলের সুখের সময় তাদের খোঁজ নেই । এই আত্মঘাতী নীতি থেকে আওয়ামী লীগকে সরে এসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারে আসতে হবে ।

তারা বুঝে কিনা জানিনা, ঐ সুবিধাবাদী দলছুট হাইব্রিড দুর্নীতিবাজ ও লুটেরা অপশক্তি আওয়ামী লীগকে ঘুণেপোকার মতো তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে । দলটি আজ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে যোজন মাইল দূরে সরে গেছে । আওয়ামী হাইকমান্ড ক্ষমতার রঙিন চশমা পরে সবকিছুকে রঙিন দেখছেন । কিন্তু তারা সুখের মধ্যে ডুবে থেকে হয়তো বুঝতে পারছে না যে, তাদের ক্রিয়াকর্মের বিপরীত প্রতিক্রিয়াস্বরূপ একটি ধর্মান্ধ জঙ্গি সাম্প্রদায়িক অপশক্তির নিরব উত্থান ঘটছে, যে অপশক্তির থাবায় মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে যাবে । তারা যদি এখনো বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করে আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধি করতে ব্যর্থ হয় তাহলে তাদের জন্যে করুণ পরিণতি অপেক্ষা করছে ।

পরিশেষে, আওয়ামী লীগের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিশেবে তাদের প্রতি বিনীত অনুরোধ করবো, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের মূলধারায় ফিরে আসুন । মুক্তিযোদ্ধাদের ঐতিহাসিক অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিন, মুক্তিযুদ্ধের কলঙ্ক অমুক্তিযোদ্ধাদের ঝেঁটিয়ে বিদায় দিন । দলে ও প্রশাসনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সিক্ত সৎ মেধাবী ত্যাগী ও সাহসী মানুষদের সমাবেশ ঘটান । মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটান । তাদের ও তাদের পরিবারের জীবনের নিরাপত্তা বিধান করুন ।

মুক্তিযোদ্ধারা আর ক'দিন ? তাদের মুখে একটু হাসি ফুটান । মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে চেটেপুটে লুটপুটে খেয়ে অনেকেই আজ হাসছে, কেবল হাসি নেই মুক্তিযোদ্ধাদেরমুখে ! অথচ মুক্তিযোদ্ধাদের হাসি ও মর্যাদার মধ্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার সার্থকতা নিহিত । মুক্তিযোদ্ধাদের অবমানার অর্থই হলো বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার প্রতি অবমাননা । সুতরাং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় মর্যাদা রক্ষা করা আওয়ামী লীগের আশু নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে আমি মনে করি ।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।