আবীর আহাদ


চলমান মহামারী করোনা ভাইরাসের কারণে মুক্তিযোদ্ধারা চরম দুরাবস্থার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন তা সহজেও অনুমেয় । একে তো তারা বয়সের ভারে ন্যুব্জ, তারপর তাদের অধিকাংশই নানান জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত । সিংহভাগ মুক্তিযোদ্ধা দারিদ্র্যসীমার নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন । মাথার ওপরে বলা চলে খোলা আকাশ । তাদের কোনো কাজ করে পরিবার নির্বাহ করার ক্ষমতা নেই । সন্তানদের তেমন করে গড়ে তুলতে না পারার কারণে তারাও আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে ভালো অবস্থানে নেই । তাদেরও সংসার হয়েছে । ফলে সন্তানরাও বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দিকে তেমন দৃষ্টি দিতে পারে না । অনেক ক্ষেত্রে বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাকেইতাদের সন্তান-সন্ততিদের প্রতিপালন ও দেখভাল করতে হয় । তারা মাসিক যে ১২০০০/- ভাতা পান, সেটাই তাদের একমাত্র আয়ের উৎস । এ অর্থের আবার বিরাট একটা অংশ কিন্তু চলে যায় তাদের চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে ।

এমনতর দুর্বিসহ জীবনে নিপতিত অবস্থায় এসেছে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস । রোগটা চরম ছোঁয়াছে হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদেরকেও গৃহে বন্দী থাকতে হচ্ছে । ফলে সবদিক দিয়ে তারা একটা জবুথবু অবস্থার মধ্যে পড়ে হাপিত্যেশ করে মরছেন । আর্থিক অবস্থা দিনকে দিন করুণ অবস্থা থেকে করুণতর হচ্ছে । ইতোমধ্যে সরকারি ও বিভিন্ন বেসরকারি ত্রাণ চালু হলেও তারা সেই ত্রাণের আওতায় আসছেন না । এ বিষয়ে ত্রাণ প্রদানকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে উত্তর আসে, কেন ? তারা তো প্রতি মাসে মাসে মোটা অঙ্কের ভাতা পাচ্ছে ! এ অবস্থায় জাতীয় নাম ও সামাজিক মর্যাদার কারণে তাঁরা কারো কাছে নিজেদের দৈন্যতা প্রকাশ করতেও পারছেন না । ফলে সিংহভাগ মুক্তিযোদ্ধা অবর্ণনীয় দু:খ ও দূরাবস্থার মধ্যে জীবনযাপন করছেন ।

পৃথিবীর সব দেশে জাতীয় বীরদের মর্যাদা সংরক্ষণসহ তাদের আর্থসামাজিক উন্নত জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা হয় । একমাত্র ব্যতিক্রম এ বাংলাদেশ । দেশের স্বাধীনতা আনায়নকারী বীরদের প্রতি চরম অবহেলা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক । আজ যারা জীবনে যা কল্পনাও করেননি তারা তাই হয়েছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সীমাহীন শৌর্য বীর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বের অবদানে । অথচ তাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে রাখা হয়েছে চরম দয়া-দাক্ষিণ্যের মাঝে; অনাদরে অবহেলায় ! কিন্তু করোনাকালীন চরম দুরাবস্থায় পতিত মুক্তিযোদ্ধাদের দু:খ ও কষ্টকালে সরকার বা অন্যান্য কারো নজর তাদের দিকে পড়ছে না ।

মুক্তিযোদ্ধাদের একটা মন্ত্রণালয় আছে-----তাদের দেখভাল করার জন্য একজন মন্ত্রীও আছেন, কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কর্তাবর্গ ও মন্ত্রী কোথায় ডুব দিয়ে আছেন তা কেবল তারাই জানেন । করোনায় পতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের জন্য নানান প্রণোদনা থাকলেও তা থেকে একেবারেই বঞ্চিত বীর মুক্তিযোদ্ধারা ! মুক্তিযোদ্ধারা চরম দুর্বিসহ জীবনে অবস্থান করলেও তাদের নামের মর্যাদার কারণে তারা মুখ ফুটে তাদের করুণ অবস্থার কথা কারো কাছে যেমন প্রকাশ করতে পারছেন না, তদ্রূপ কারো কাছে হাতও পাততে পারছেন না । এ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী তাদের বিষয়টি সরকারের নজরে আনতে পারতেন । কিন্তু তিনি চরম তৃপ্তির তন্দ্রায় আচ্ছন্ন ।

উপরোক্ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমি এহেন দুরাবস্থায় নিপতিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আন্তরিক সহমর্মিতা, সমবেদনা ও সহানুভূতি প্রকাশ করছি ।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।