প্রবীর সিকদার


ঐতিহ্যবাহী হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের গোড়াপত্তন ১৯৭৪ সালে। হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে এডভোকেট মনসুর উদ্দিন ইকবাল ও এডভোকেট আমির হোসেন। এডভোকেট মনসুর উদ্দিন ইকবালের সাংবাদিকতা শুরু দৈনিক ইত্তেফাক দিয়ে, তিনি এখনো দৈনিক ইত্তেফাকের হবিগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি। এডভোকেট আমির হোসেন কাজ করেছেন দৈনিক বাংলা, দৈনিক বাংলার বাণী ও দৈনিক মানবজমিনে। এদের দুইজনের সততা ও সাংবাদিকতাকে সামাজিক কল্যাণে ব্যবহারের দক্ষতা হবিগঞ্জবাসী চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবেন। এরা সাংবাদিকতাকে কখনোই সংকীর্ণ ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার করেননি। তাঁরা নেতৃত্বে থাকাকালে হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের দ্বিবার্ষিক কিংবা বার্ষিক কমিটি গঠন করা হতো গোপন ভোট কিংবা সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকের সোনালি সময়ে হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের কমিটি গঠন প্রক্রিয়া কখনো প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি।

হটাত করেই ২০১৬ সালে মারা যান হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আমির হোসেন। আমির হোসেনের আকস্মিক মৃত্যুতে সঙ্গীহারা হয়ে পড়েন প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এডভোকেট মনসুর উদ্দিন ইকবাল। আমির হোসেনের মৃত্যুর পর প্রেসক্লাবে উপদলীয় কোন্দল মাথাচাড়া দেওয়ায় প্রেসক্লাবের নেতৃত্ব থেকে স্বেচ্ছায় বিদায় নেন এডভোকেট মনসুর উদ্দিন ইকবাল।

হবিগঞ্জ প্রেসক্লাব বিভিন্ন সময় নানামুখি অবদানের কথা বিবেচনা করে বিশিষ্ট জনদের সম্মান জানাতে আজীবন সদস্যপদ দিয়েছে। তাঁদের নামের তালিকা সম্বলিত একটি সম্মান সূচক বোর্ড প্রেসক্লাবে সব সময় শোভা পায়। আজীবন সদস্যবৃন্দের ভোটাধিকার প্রয়োগের বিধান না থাকায় তারা কেউই প্রেসক্লাবের কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় কখনোই কোনও ভূমিকা রাখেননি। কিন্তু ২০১৬ সালে প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আমির হোসেনের মৃত্যুর পর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এডভোকেট মনসুর উদ্দিন ইকবাল নিজেকে খানিকটা গুঁটিয়ে নেওয়ায় পাল্টে যায় হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের দৃশ্যপট। একজন আজীবন সদস্য, যিনি একটি রাজনৈতিক দলের জেলা কমিটির সভাপতি ও এমপি, তিনি হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের বার্ষিক কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে সফলও হয়ে যান। তারপর অর্থাৎ ২০১৬ সাল থেকেই হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের কমিটি গঠনে ভোটগ্রহণের দরকার পড়েনি। তিনিই প্রতি বছর নিজের ইচ্ছেয় যে কমিটি কমিটি তৈরি করে দেন, সেটাই হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের কমিটি। বাস্তব পরিস্থিতিটাই হবিগঞ্জে এমন, ওই এমপির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রেসক্লাবের কেউই টু শব্দটি করেন না। আর একারনেই হয়তো হবিগঞ্জের কেউ কেউ আড়ালে-আবডালে হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের কমিটিকে বলে থাকেন, পকেট কমিটি কিংবা গৃহপালিত কমিটি!

হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের পকেট কমিটি কিংবা গৃহপালিত কমিটির সুফল দারুণভাবে উপভোগ করছিলেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা। সরকারি টেন্ডার কাজে ঘাপলা, হাট বাজার ঘাট ইজারায় প্রভাব, কাবিখা কিংবা কাবিটায় পুকুর চুরি, ত্রাণসামগ্রী বিতরণে জালিয়াতি ইত্যাদি কোনও কিছু নিয়েই খবর করেন না হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের পকেট কমিটি কিংবা গৃহপালিত কমিটির নেতৃবৃন্দ ও তাদের অনুসারীরা। এমনই যখন ভাগবাটোয়ারার অপরাজনীতি ও অপসাংবাদিকতা চলছিল, সেই সময়ে সবার পথের কাঁটা হয়ে হাজির হন সুশান্ত দাশগুপ্ত নামের লন্ডনে উচ্চ শিক্ষা নেওয়া এক মেধাবী তরুণ! বঙ্গবন্ধু অন্তপ্রাণ এই তরুণ সিলেটের শাহ জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন তুখোড় ছাত্রলীগ নেতা! লন্ডনেও তিনি আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে যোগ করেছেন ভিন্নমাত্রা। তিনি লন্ডনে স্ত্রী সন্তান ফেলে চলে আসেন দেশে! সুশান্ত দাশগুপ্তের আল্টিমেট গোল রাজনীতি হলেও রাজনীতি ও সাংবাদিকতায় নতুন মাত্রা যোগ করতে তিনি দৈনিক আমার হবিগঞ্জ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় গড়ে তোলেন নতুন ধারার সংগঠন আমার এমপি ডট কম। পত্রিকায় তিনি তরুণ ও সৎ মেধাবীদের নিয়ে একটি চৌকশ টিম গঠন করেন। দৈনিক আমার হবিগঞ্জে প্রকাশ পেতে থাকে রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের অনিয়ম দুর্নীতি ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে নানা খবর। আর আমার এমপি ডট কমের প্লাটফর্মে শুরু করা হয় নাগরিকের কাছে জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতার চর্চা। আর এতেই ক্ষেপে যান কোনও কোনও জনপ্রতিনিধি ও হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের নেতৃত্ব। অপরাজনীতি ও অপসাংবাদিকতার অভূতপূর্ব মেলবন্ধনে তৈরি করা হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি বিতর্কিত মামলা। ওই মামলায় উল্লেখ করা হয় এক কিংবা একাধিক জনপ্রতিনিধির সম্মানহানির বিষয়টি। কোনও জনপ্রতিনিধি ওই মামলার বাদি হননি, বাদি হয়েছেন হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সায়েদুজ্জামান জাহির। সাক্ষী হয়েছেন প্রেসক্লাবের সভাপতি ইসমাইল হোসেন ও কয়েকজন জনপ্রতিনিধি। এ যেন দালাল সাংবাদিকতার এক নিকৃষ্ট নজির! মামলার প্রধান আসামী করা হয় হবিগঞ্জের রাজনীতি ও সাংবাদিকতায় আশাজাগানিয়া দৈনিক আমার হবিগঞ্জের সম্পাদক প্রকাশক এবং আমার এমপি ডট কমের প্রতিষ্ঠাতা সুশান্ত দাশগুপ্তকে। সেই সাথে আসামী করা হয় তার কয়েক মেধাবী সাংবাদিক সহযোগীকে। দ্রুত গতিতেই ওই মামলায় গ্রেফতার করে হবিগঞ্জ জেলা কারাগারে পাঠানো হয় সুশান্ত দাশগুপ্তকে। চেষ্টা চলছে অন্যদের গ্রেফতারের। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সাংবাদিক নেতৃত্বের অভিন্ন টার্গেট, সুশান্ত দাশগুপ্তকে দেশ থেকে বিতাড়ন করা।

আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, সুশান্ত দাশগুপ্তকে জেলে আটকে দেওয়ায় ওয়াক ওভার পেয়ে যাবেন হবিগঞ্জের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও গৃহপালিত সাংবাদিক নেতৃত্ব! না সেটা বোধকরি আর হচ্ছে না! জেলখানা থেকেই সহকর্মীদের কাছে বাঘের হুংকার দিয়েই বার্তা পাঠিয়েছেন সুশান্ত দাশগুপ্ত, হবিগঞ্জের রাজনীতি ও সাংবাদিকতায় শুদ্ধতা ফেরাতে তিনি লড়েই যাবেন। তার এই বার্তায় উজ্জীবিত সুশান্তের কর্মী বাহিনী। তারা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও দৈনিক আমার হবিগঞ্জের প্রিন্ট ভার্সন ও অনলাইন ভার্সনের প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছেন। এরই মধ্যে জাগতে শুরু করেছেন হবিগঞ্জের সাধারণ মানুষ। তাঁরাও ন্যায় অন্যায় বিচার করে বলতে শুরু করেছেন, সুশান্ত ও তার সহযোগীদের অপরাধ কী! চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে অনিয়ম দুর্নীতি অসঙ্গতির বিরুদ্ধে কথা বলা ও লেখালেখি করা যদি অপরাধ হয়, তাহলে তাঁরাও ওই অপরাধকেই সমর্থন করবেন, করেই যাবেন। হবিগঞ্জের মানুষের অভিন্ন উচ্চারণ অস্ফুট থেকে তীব্র ও প্রকট হচ্ছে, তারা কোনও রক্ত চক্ষুর সামনেই আশাজাগানিয়া তুখোড় তরুণ সুশান্ত দাশগুপ্ত ও তার সহযোগীদের হেরে যেতে দিবেন না, হেরে যেতে দিতে পারেন না!