রঞ্জন কৃষ্ণ পন্ডিত, টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ে করোনার প্রভাবে কোটি-কোটি টাকার উৎপদিত কলা নিয়ে লোকসানে পড়েছে কৃষকরা। গড়াঞ্চলের সহস্রাধিক চাষি উৎপাদিত কলা নিয়ে বিপাকে পড়েছে। কলার আড়ৎ ও মোকাম বন্ধ থাকায় বেচা-কেনা বন্ধ হওয়ায় স্থানীয় পর্যায়েও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।

জানা গেছে, মধুপুর গড়াঞ্চলের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি কৃষি। কলা ও আনরস মূলত এ অঞ্চলের মানুষের অর্থনীতি সচল রাখে। প্রতি বছর কলা থেকে কোটি-কোটি টাকা লেনদেন হয়ে থাকে। সারা বছর কলা উৎপাদিত হয়। এখানে কলাকে কেন্দ্র করে চাষী, শ্রমিক, কুলি, পরিবহণ ও পরিবহণ শ্রমিকসহ নানা মানুষের রুটি-রুজি হয়।
স্থানীয় কলা চাষী, বেপারী ও আড়ৎদারদের সাথে কখা বলে জানা যায়, কলার রাজধানী লাল মাটির মধুপুর গড়াঞ্চল। লালমাটি কলা চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী হওয়ায় এতদাঞ্চলের উৎপাদিত কলা ঢাকা, রাজশাহী, কক্সবাজার, টেকনাফ, সিলেট, নাটোর, ভৈরবসহ দেশের নানা জেলায় কলা রপ্তানী হয়ে থাকে।

চাষিরা জানায়, কলা চাষে অন্য ফসলের চেয়ে বেশি খরচ হয়। প্রতিটি গাছে রোপণ থেকে শুরু করে কলা বিক্রি পর্যন্ত গাছ প্রতি ১০০-১৫০ টাকা খরচ হয়। এক বিঘা জমিতে ৩০০ থেকে ৩৫০টি কলা গাছ লাগনো যায়। এতে পরিচর্যা করতে প্রতিবিঘায় ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। এ জন্য এতদাঞ্চলের কৃষকরা ব্যয়বহুল কলা চাষের অর্থের যোগানের জন্য বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, এনজিও এবং গ্রাম্য মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে কলা চাষে বিনিয়োগ করে থাকেন।

এ বছর করোনার প্রভাব পড়ায় কলা কেনা-বেচা থমকে গেছে। এজন্য কলার ক্রেতা অনেকটাই কমে গেছে। ফলে ব্যয় বহুল অর্থে উৎপাদিত কলা নিয়ে মহাবিপাকে পড়েছে চাষিরা।

সরেজমিনে মধুপুর উপজেলার কুড়াগাছা ইউনিয়নের পীরগাছা, ভবানীটিকি ও মমিনপুর গ্রামে গিয়ে কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এ তিন গ্রামের কৃষকদের প্রধান ফসল কলা। কলা চাষকে কেন্দ্র করে আবর্তিত তাদের জীবনাচার।

এ এলাকর প্রান্তিক কৃষকরা ৫ বিঘা থেকে ২০০-৩০০ বিঘা পর্যন্ত জমিতে কলা বাগান করেছে। কলা চাষে বিনিযোগ করতে এলাকার কৃষকদের দুই লাখ থেকে ২০-৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে গ্রাম্য মহাজনের ঋণ নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা সবেচেয়ে বেশি। প্রতি মাসে এ ঋণের মাসিক কিস্তি দিতে হচ্ছে। এখন কলা বিক্রির উপযুক্ত সময়। আর এ মৌসুমেই কলা বিক্রি থমকে যাওয়ায় বসে পড়েছে তারা।

পীরগাছা গ্রামের চাষী রুকনুজ্জামান খান ২৬ বিঘা জমি লিজ নিয়ে ৯ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে কলা চাষ করেছেন। শামছুল আলম ২০০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে কলা চাষ করেছেন। তার ঋণ ৩০ লাখ টাকা। এভাবে জমি লিজ নিয়ে সাজু ২০০ বিঘা, সাখওয়াত ৭৫ বিঘা, দেলোয়ার ১৩ বিঘা, ফজলু শেখ ১৫ বিঘা, হানিফ ৮ বিঘা, লিচু খান ২০০ বিঘা, হালিম সরকার ৫০ বিঘা, আজিজ ৩০ বিঘা, ইদ্রিস খান ৪০ বিঘা, শেখ আলহাজ ৩০ বিঘা, বাদশা ২৫ বিঘা, আনোয়ার ১২০ বিঘা, ফরহাদ ১২০ বিঘাসহ গড়াঞ্চলের শ’ শ’ কৃষক জমি লিজ ও ঋণ নিয়ে কলার বাগান করেছেন।

এসব কলা চাষিরা জানান, ছোট কৃষকদের ২ লাখ টাকা থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে ৩০-৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ রয়েছে। এবার কলার বাজার ও বিক্রি থমকে পড়ায় প্রত্যেক কৃষকেরই ব্যাপক লোকসান গুনতে হবে। সার, চারা, কীটনাশক, ভিটামিনসহ নানা কৃষি পণ্যের দোকানে বাকি, শ্রমিকের মজুরি, বড় সুদের ঋণের বোঝা মাথার উপর রয়েছে। এ নিয়ে কৃষকের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।

কলা বেপারী আব্দুল জলিল জানান, এ এলাকা থেকে কলা কিনে তিনি চট্টগ্রাম, ঢাকা, সাতকানিয়া, কক্সবাজার, সিলেট, টেকনাফ, ভৈরবসহ নানা জেলায় বিক্রি করতেন। এখন সব মোকাম বন্ধ। এ বছর কৃষক, পাইকার, চাষী প্রত্যেকেরই লোকসান গুনতে হচ্ছে।

কলা চাষি সাজু মিয়া জানান, প্রতি বছর তিনি কোটি টাকার কলা বিক্রি করেন। এ বছর কলা চাষের খরচ তোলাই কঠিন হযে পড়েছে। কলা চাষী লিচু খান, সাখাওয়াত ও শামছুল আলম জানান, করোনার প্রভাবে কলার আড়ৎ বন্ধ থাকায় পাইকাররা কলা কেনা বন্ধ করে দিয়েছেন। দুই একজন কিনলেও অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তাতে আবাদের খরচও উঠবে না। তাদের লাখ লাখ টাকা ঋণ কী করে পরিশোধ করবেন? এ চিন্তায় তারা হতাশ হয়ে পড়েছেন। তাদের দাবি কৃষি প্রণোদনায় বা ভর্তুকির খাতে তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হলে কলা চাষীরা ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে।

টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক জানান, জেলার কৃষকদেরকে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। মধুপুর গড়াঞ্চলের কলা চাষীরা করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মধুপুর গড়াঞ্চল বলতে সাধারণত মধুপুর, ঘাটাইল, ধনবাড়ী, সখীপুর ও গাজীপুরের কিয়দংশকে বুঝায়। অধিদপ্তর থেকে উপজেলা ওয়ারী খোঁজখবর নিয়ে কলা চাষীদেরকেও কৃষি প্রণোদনার আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।

(আরকেপি/এসপি/মে ২৮, ২০২০)