নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার


করোনার থাবায় পৃথিবী আজ স্তব্দ। প্রতিদিনই ভাঙ্গছে মৃত্যুর রেকর্ড। শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি সবক্ষেত্রেই অশনি সংকেত। দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে লকডাউন থাকায় বিঘিœত হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। তবে ইতোমধ্যে অর্থনীতি ব্যবস্থা সচল রাখার স্বার্থে লকডাউন অনেকটাই শিথিল করেছে সরকার খুলে দিয়েছে অফিস আদালত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বন্ধ রাখা হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মানুষ জীবিকার তাগিদে বের হচ্ছে ঘর থেকে। তথাপি উৎকন্ঠা বিরাজ করছে সাধারণ জনগণের মাঝে। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়তই যুদ্ধ করতে হচ্ছে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জনগণকে।

মৌলিক চাহিদার অন্যতম দিক হচ্ছে শিক্ষা। যদিও এক্ষেত্রে বিপর্যয় ঘটলে মানুষ সরাসরি মারা যায় না কিন্তু এর ফলে যে আঘাত আসে তা থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। করোনায় যেসব বিষয় সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে তার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে স্বাস্থ্য দ্বিতীয়ত অর্থনীতি ও তৃতীয়তে রয়েছে শিক্ষা। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে। ইতোমধ্যে ১৫জুন পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হবে না। অনেক দেশ আবার ২০২১সালের আগে শিক্ষায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে না বলে ইঙ্গিত দিচ্ছে। করোনার প্রভাবে শেষ হওয়া এসএসসির ফলাফল প্রকাশেও হয়েছে বিলম্ব। ফল প্রকাশ বিলম্ব হওয়ার কারণে ভর্তিও পিছিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে পিছিয়ে গেছে এইচএসসি পরীক্ষা। নভেম্বরে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা নিয়েও তৈরি হয়েছে অশ্চিয়তা। মোট কথা হলো শিক্ষাসূচীর হেরফের হয়েছে চরমভাবে।

এসব কারনে চরম উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীরা। কোন দিন থেকে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে এবিষয়েও কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে বন্ধ হয়েছে প্রথম সাময়িক বা বিভিন্ন পর্বের পরীক্ষা। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শিক্ষার্থীরা টিভি ও মোবাইলের সঙ্গ লাভ করে হয়ে উঠছে অসহিষ্ণু সরে যাচ্ছে বই থেকে। ভবিষৎতে যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হবে সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমে মনোযোগ ফেরাতেও সময় নিতে হবে বেশ। প্রতিষ্ঠানের রোজ পড়া ও পরীক্ষার চাপেই কিন্তু শিক্ষার্থীরা বই নিয়ে সময়মতো বসতো পড়ার টেবিলে কিন্তু এদুটো ক্ষেত্রে চাপ না থাকায় বইয়ের প্রতি অনাগ্রাহী হয়ে পড়ছে তারা।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি ডিজিটাল পদ্ধতিতে পাঠদানের নির্দেশনা প্রদান করেছে। তবে সেইসব পাঠদান ফলপ্রসূ হবে বা আমাদের কতটুকু সামর্থ্য রয়েছে এ ব্যবস্থা পরিচালনায় তা নিয়ে তৈরি হয়েছে সন্দেহ। ব্যানবেইসের জরিপ অনুযায়ী দেশে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। ১ কোটি ৭০ লক্ষের মতো শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে প্রাথমিক পর্যায়ে। যার বেশির ভাগই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শতভাগ শিক্ষার্থীদের দেয়া হচ্ছে উপবৃত্তি রয়েছে বিস্কুটের ব্যবস্থাও।

আবার এখন বছরের শুরুতে ব্যাগ জামা কাপড় কেনার জন্য দেয়া হবে টাকা। এতসব আয়োজন কেবলমাত্র বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আসা নিশ্চিত করা। যাচাই করলে দেখা যাবে এসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দরিদ্র অভিভাবকের সন্তানরাই লেখাপড়া করছে বেশি। এখন প্রশ্ন হলো স্মার্ট ফোন বা টিভির মাধ্যমে কতটুকু ক্লাসের আওয়াজ তাদের বাড়িতে পৌঁছাবে ? হয়তো কিন্ডারগার্টেনে অধ্যয়নরত সচেতন শিক্ষার্থীরা এর কিছুটা সুযোগ পেতে পারে। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে পদ্ধতিতে পাঠদান করান কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীরা এতে অভ্যস্ত নয়।

সারা বছরই শিক্ষকদের দেয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ কিন্তু এসব প্রশিক্ষণ কতটুকু মাঠ পর্যায়ে প্রযোগ হচ্ছে তাও কিন্তু ভেবে দেখার বিষয়। অন্যদিকে মাধ্যমিকে ৭৫ লক্ষ, উচ্চ মাধ্যমিকে ২৯ লক্ষ ও মাদ্রাসায় প্রায় ২২ লক্ষ শিক্ষার্থীরা অধ্যয়ন করছে। এর বেশির ভাগই আবার বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে। শহরের কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের পক্ষে অনলাইন ব্যবস্থায় ক্লাস নেয়া সম্ভব হলেও বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই এর বাইরে থেকে যাবে।

প্রশিক্ষিত জনবল, অবকাঠামো স্বল্পতা, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এসব ক্লাস নেয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম বাঁধা। তবে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রায় ৬ লক্ষ শিক্ষার্থী এবিষয়টির মাধ্যমে অনেকটাই ফলপ্রসূ হতে পারে। কারণ শিক্ষার উচ্চ স্তরে পৌঁছে শিক্ষার্থীরা পড়ার বেশির ভাগই তাদের নিজ উদ্যোগে শেষ করে থাকে। যে স্তরের কথাই বলি না কেন প্রত্যেক স্তরেই নেমে এসছে বিপর্যয়। এ অবস্থা থেকে শিক্ষা ব্যবস্থা কে উত্তরণ ঘটাতে অনেক বেগ পেতে হবে এ বলার অপেক্ষা রাখে না। তথাপি মানুষের জীবন বাঁচিয়েই শিক্ষাকে সচল করতে হবে। কারণ মনে রাখতে হবে আগে জীবন পরে শিক্ষা। কারণ জীবন না থাকলে শিক্ষার প্রয়োজন নেই।

লেখক : শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।