মাদারীপুর প্রতিনিধি : লিবিয়ায় মানব পাচারকারীদের আক্রমণে হতাহত বাংলাদেশিদের মধ্যে মাদারীপুরের নিখোঁজ, মৃত ও আহতের বাড়ীতে বইছে শোকের মাতম। পরিবার আত্মীয়-স্বজনের কান্নার আহজারীতে প্রতিবেশীদের মধ্যেও শোক নেমেছে। শান্তনা দেয়ার জন্য আশপাশের মানুষ আসলেও তারাও করুণ কাহিনি শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন। তেমনি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার রাজন্দী দারাদিয়া এলাকার নিখোঁজ সিদ্দিক আকনের ছেলে আসাদুল আকন। আসাদুল আকনের বাড়ীতে গিয়ে দেখা যায়, অসুস্থ বাবা বিছানায় সন্তানের জন্য কাতরাচ্ছেন। মা শুভতারা বেগম বার বার জ্ঞান হারাচ্ছেন। বড় ভাই, বোন সবাই শোকে পাথর হয়ে আছেন। তাদের একটি দাবী আসাদুল যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় যেন দেশে আনার ব্যবস্থা করে সরকার। 

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এই ঘটনায় মাদারীপুর জেলায় নিখোঁজ ১৩ জন ও আহত হয়েছেন ৪ জন। তবে প্রশাসন বলেছেন ১১ জনের তথ্য তাদের কাছে আছে। এদিকে মাদারীপুরে নিখোজ ১৩ জন ও আহত ৪ জনের কথা শোনা গেলেও কয়েকজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

এদিকে লিবিয়ায় হতাহতের ঘটনার খবর শুনে শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে বাংলাদেশি দালাল মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের জুলহাস শেখ এর বাড়িতে হামলা করে নিখোঁজ যুবকদের অভিভাবক ও এলাকাবাসী। এ খবর পেয়ে রাজৈর থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। এসময় দালাল জুলহাস নিজেকে করোনা রোগী বলে পরিচয় দেয়। এ সময় পুলিশ জুলহাসকে নিয়ে মাদারীপুর সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করে।
এ ব্যাপারে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, দালাল জুলহাস শেখ কৌশলে যেন হাসপাতাল থেকে পালিয়ে না যায়। পুলিশ যেন তার দিকে বেশি নজর দেন। তার শাস্তি হলে অন্য দালালরা এসব থেকে বিরত থাকবেন।

স্থানীয়, নিখোঁজের পরিবারসহ একাধিক সূত্রে আরো জানা গেছে, বাংলাদেশিসহ অভিবাসীদের লিবিয়ার মিজদা শহরের একটি জায়গায় টাকার জন্য জিম্মি করে রাখে মানবপাচারকারী চক্র। এ নিয়ে এক পর্যায়ে ওই চক্রের সাথে মারামারি হয় অভিবাসী শ্রমিকদের। এতে এক মানবপাচারকারী মারা যায়। তারই প্রতিশোধ হিসেবে বৃহস্পতিবার ২৬ বাংলাদেশিসহ ৩০ অভিবাসী শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করে মানবপাচারকারী চক্রের এক সদস্যের সহযোগী ও স্বজনরা। ২৬ বাংলাদেশির মধ্যে নিখোঁজ ও মৃত রয়েছে মাদারীপুরের ১৩ জন এবং আহত হয়েছে ৪ জন।

বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া নিখোঁজ ১৩ জনের মধ্যে মাদারীপুর সদর উপজেলার জাকির হোসেন, সৈয়দুল, শামীম, জুয়েল ও ফিরুজের নাম রয়েছে। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাদের ব্যাপারে খোজ খবর নেয়া হচ্ছে।

এছাড়া নিখোজ আছেন রাজৈর উপজেলার বিদ্যানন্দী গ্রামের রাজ্জাক হাওলাদারের ছেলে জুয়েল হাওলাদার (২২) একই গ্রামের শাহ আলম হাওলাদারের ছেলে মানিক হাওলাদার (২৮), টেকেরহাট এলাকার আয়নাল মোল্লা ও মনির, ইশবপুরের আড়াই পাড়ার আনজু বেপারীর ছেলে সজীব বেপারী (২৩) ও দক্ষিণ গোয়ালদি কালাম মাতুব্বরের ছেলে শাহীন মাতুব্বর (২৪), বদরপাশার রাজন্দীর দারাদিয়ার সিদ্দিক আকনের ছেলে আসাদুল আকন (১৭), একই গ্রামের আব্দুল খালেক খালাশীর ছেলে আব্দুর রহিম খালাশী (২৮)।

এ ঘটনায় আহত হয়েছেন মাদারীপুরের ৪ জন। এরা হলেন মাদারীপুর রাজৈরের কদমবাড়ির মহিষমারী গ্রামের মোক্তার আলী শিকদারের ছেলে মোহাম্মদ আলী শিকদার (২২), রাজৈরের ইশবপুরের আড়াইপাড়া গ্রামের খলিল খালাসীর ছেলে মো. সম্রাট খালাসী (২৯), বদরপাশার পাঠানকান্দি গ্রামের নারায়ন চন্দ্র কায়েস্ত এর ছেলে সিতু কায়েস্ত বাপ্পী (২৫) ও সদর উপজেলার তীর বাগদি গ্রামের ফিরোজ বেপারী (২৫)। আহতরা লিবিয়ার ত্রিপোলি মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসাধীন রয়েছে।

রাজৈর উপজেলার বদরপাশা ইউনিয়নের পাঠানকান্দি গ্রামের ছমেদ শেখের ছেলে দালাল নূর হোসেন শেখের ভাই আমীর হোসেন শেখ লিবিয়ার ত্রিপোলিতে থাকেন। রাজৈরের বদরপাশার যারা লিবিয়াতে আছেন তাদের সবাইকে তিনিই লিবিয়ায় নিয়েছেন বলে নিখোজদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে।

এছাড়া সদর উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের আদমপুর গ্রামের আলী হোসেন নামের এক দালালের মাধ্যমে কিছু লোক লিবিয়ায় গেছেন বলেও জানা যায়।

তবে এইসব দালালদের ব্যাপারে খোজ নিলে তাদের পাওয়া যায়নি। এই ঘটনার পর থেকে তারা পলাতক আছে।
নিখোঁজ আসাদুলের বাড়ীতে গিয়ে দেখা যায়, অসুস্থ বাবা সিদ্দিক আকন বিছানায় সন্তানের জন্য কাদরাচ্ছে, মা শুভতারা বেগম কান্না করে বলছেন, আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দাও আমি আর কিছুই চাই না।

আসাদুলের বোন কান্না করতে করতে বলেন, আমার ভাইয়ের সাথে কথা হয় নাই। তবে আমাকে একটি ভয়েস পাঠিয়েছিল ১৬ মে, ইমোতে। এর পর থেকে আর তার সাথে কোন যোগাযোগ হয় নাই। সে ভয়েস রেকর্ডে আমার ভাইয়ের করুণ আর্তনাত ছিলো। আমার ভাই বার বার বলতে ছিলো, আরো টাকা পাঠাও, তা না হলে মেরে ফেলবে। আমাকে বাচাও। ওরা (ঐদেশের দালাল) প্রতিদিন কারেন্ট দিয়ে শর্ট দেয়। অনেক অত্যাচার করে। আমাকে বাচাও।

রাজৈরের বিদ্যানন্দী গ্রামের নিখোঁজ মানিক হাওলাদারের বাবা শাহ আলম হাওলাদার বলেন, আমার ছেলে মানিককে লিবিয়া নেওয়ার কথা বলে দালাল জুলহাস শেখ আমার কাছ থেকে প্রথমে ৪ লাখ টাকা নিয়েছে। পরে ছেলেকে বেনগাজী আটকে রেখে ভয়েজ রেকর্ডের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা দাবী করে। আমি আমার ছেলেকে আনতে জুলহাসের বাড়ি গিয়ে টাকা দিয়ে আসি। এখনো আমার ছেলের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না।

রাজৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শওকত জাহান বলেন, লিবিয়ায় লোক নেয়া দালাল রাজৈরের জুলহাস শেখের বাড়িতে এলাকাবাসী হামলা করে, এমন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা ওই বাড়িতে গেলে জুলহাস বলে আমার করোনা হয়েছে। করোনার কথা শুনে আমরা জুলহাস শেখকে মাদারীপুর সদর হসাপাতালের আইসোলেশনে ভর্তি করি। তবে কেউ যদি অভিযোগ করে আমরা তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশীদের হত্যার কথা শুনেছি। যার মধ্যে মাদারীপুরের নিখোঁজ ১১ জনের তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের কাছে পাঠিয়েছে। যারা মারা গেছে তাদের লাশ সরকারিভাবে দেশে আনার ব্যবস্থা করা হবে।

(এএস/এসপি/মে ৩০, ২০২০)