গোপাল অধিকারী


কেটে গেল মুসলমান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল ফিতর। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এমন কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে কেটে গেল একটি উৎসব। কথায় বলে, “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার”। অর্থাৎ ঈদ এলে শুধুমাত্র মুসলমান সম্প্রদায় ধর্মীয় দিকটি তাদের মত পালন করে কিন্তু উৎসবটি যেন সবার মাঝেই বিরাজ করে। অন্য সম্প্রদায়ের মানুষও এই উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করে ছুটি কাটায়, বিভিন্নস্থানে আনন্দভ্রমন করছে, রন্ধনশালায় যুক্ত করে বিভিন্ন প্রকারের খাবার। সবমিলিয়ে উৎসবটি সবার হয়ে দাড়ায়। সনাতন ধর্মের বড় উৎসবেও যেন একই ঘটনা ঘটে। তবে মুসলমান সম্প্রদায় বেশি সংখ্যক থাকায় ঈদটি বেশি উৎসবে পরিণত হয়। মুসলমান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান ঈদ-উল-ফিতর এবং ঈদ-উল-আযহা। এই দুইটি বড় উৎসব ধর্মীয় ভাব-গাম্ভির্য ও ত্যাগের মহিমার মাধ্যমে পালন করে। যেকোন উৎসব অর্থই খুশি, আনন্দ, অনুষ্ঠানের আয়োজন। দুঃখ-বেদনাকে ভুলে যাওয়া।

তবে ধর্মীয় উৎসব অর্থ খুশি বা আনন্দের সাথে ত্যাগের মহিমা। তেমনি আনন্দ ও ত্যাগের মহিমা নিয়ে আসে ঈদ। প্রতিবছরের মতই নতুন সূর্য উঠেছিল, ঈদ এসেছিল, নামাজ হয়েছিল, ঈদ কেটে গেল এমনই প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতির এই নিয়মের সাথে আমাদেরও নিয়ম মেনে চলতে হয়েছে নিরাপদে, থাকতে হয়েছে সামাজিক দূরত্বে। আমার দেখা ঈদগুলোর মধ্যে এই বছরের ঈদটি ছিল ব্যতিক্রম। তাইতো শিরোনামে দিলাম এই ঈদটি কেমন গেল! ধর্মীয় দিক থেকে ভাবলে আমার মনে হয় প্রত্যেকেই প্রতিবছরই ধর্মীয় গাম্ভির্যে পালন করে তবে এবছর ধর্মীয় অনুভূতি বেশি কাজ করার কথা। কারণ ধনী-গরিব, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলে মাঝে একটি আতঙ্ক কাজ করছে আর তা হলো করোনা কবে বিদায় নিবে? অনেকের মনেই ধারণা হয়ত মানবজাতির কোন পাপের কারণে এই করোনা। তাই দেশ-জাতি ও আত্বীয়-স্বজনের সাথে সকলে মনে হয় করোনা থেকে মুক্তি কামনা করে দোয়া করেছেন। আর করবেই না কেন, সৃষ্টিকর্তাই পারে সকল বাধা-বিপত্তি, জরা-ব্যাধি থেকে রক্ষা করতে।

যারা সুশীল সমাজের মানুষ বা অর্থ-বিত্তেসম্দ্ধৃ তারা সকলেই প্রতি বছর দান করেন কিন্তু এই বছর অনেকেই পরিমাণের বেশি দান বা সহযোগীতা করেছেন যা এই বছরই ব্যতিক্রম। ঈদ অর্থই ধনী-গরিবের ভেদাভেদ ভুলে সকলে এক কাতারে অবস্থান করা। অর্থ্যাৎ গরিবের কষ্টটাকে উপলব্ধি করা এই বছর এই বিষয়টি কিন্তু আমরা অনেকেই অনুভব করতে পেরেছি। করোনার প্রকপের কারণে সকলেরই ব্যবসা-বানিজ্য বা কর্মজীবন স্থগিত ছিল ফলে অভাব নামক কষ্টটির সাথে অনেকেই সন্ধি করেছি। এবারের ঈদে ভাল দিক ছিল চারপাশের পরিবেশের। প্রতিবছর ঈদে রাস্তাপথে অনেক ভোগান্তি থাকে, থাকে বাড়তি ঝামেলা। ঈদে বাড়ি যাওয়া ও আসা নিয়ে প্রত্যেকের কাজ করে বিড়ম্বনা। কিন্তু এবারের ঈদে ছিল না তেমন কোন সম্ভাবনা। কারণ নিজের সচেতনতা বা বাড়ির বিড়ম্বনা অন্যদিকে সরকারের নির্দেশাবলীর সীমানা সবমিলিয়ে প্রবণতা তেমন কাজ করে নাই। এরপরও যারা কাজ করেছে সারা আর বাড়ির উদ্দেশ্যে দিয়েছে রওনা আমার বিশ্বাস আসতে- যেতে পরতে হয়েছে নানান বিড়ম্বনা।

তাছাড়া প্রতিবছর অফিস থেকে ছুটিসহ নানা দিক নিয়ে চলে চুলছেড়া বিবেচনা এবছর কিন্তু কোনটারই ছিল না বিশ্লেষণা। আর স্থানীয়ভাবে বলতে গেলে প্রতি স্থানেই ঈদের নামাজকে কেন্দ্র করে যে জায়গা সংঙ্কুলতা বা সজ্জিত বা অনুষাঙ্গিক কাজ ছিল না। ঈদের দিন রাস্তায় যে জনকোলাহল সেটাও তেমন ছিল না। ঈদের পরে আর্বজনা নিষ্কাশনের যে বাড়তি চাপ সেট্ওা লক্ষ্য করা যায় নাই। আর্থিক ও আতঙ্ক সবমিলিয়ে মানুষের বাড়তি খাবার বা অনুষ্ঠানগুলো ছিল না। আমার কাছে এই বছরের ঈদে সবচেয়ে ভাল দিকটি বিবেচনা করলে মনে হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা। প্রতি ঈদে বিশেষ দিনে খালি হয় একটি মায়ের বুক। এই ঈদে অন্তঃত সেটা হয় নি।

তবে উপরোক্ত ভালদিক থাকার পরও বলতে হয় এবছরের ঈদটি ছিল নিরানন্দময়। ছিল আন্তরিকতাহীন, বেদনাদায়ক ও একঘেয়েমি। ঈদ অর্থ খুশি বা আনন্দ তা কিন্তু মুঠোফোনেই সীমাবদ্ধ ছিল। ছিল না কারো বাড়িতে বেড়ানোর সুযোগ, ছিল না কোন বিনোদনকেন্দ্রে বেড়ানোর সময়। ফলে ঘড়বন্দী একঘেয়েমি ঈদ বলা যায়। আমরা জানি এবং মানি আলিঙ্গন একটি সম্পর্ককে আরও বেশি ভালবাসাপূর্ণ করে তোলে। কিন্তু এই ঈদে সেই সম্পর্কটা কিন্তু কেউ করতে পারি নাই। বিশেষ করে যারা এলাকার বাইরে থাকে এই ঈদেই কিন্তু তাদের সাথে বসে গল্প-গুজব, সমস্যা-সম্ভাবনা, ভাল-মন্দ দিক নিয়ে চায়ের কাপে আড্ডা জমে ওঠে। কিন্তু এই করোনা কিন্তু সেই সুযোগকে বঞ্চিত করছে। একটি উৎসব অনেক মন্দ সম্পর্ককে মিলনে বন্দি করে এই ঈদে কিন্তু তা সম্ভব হয় নাই।

ঈদ আসল্ইে যাদের পিতা-মাতা মারা গিয়েছে তাদের কবর জিয়ারত করা হয় কিন্তু এই আতঙ্ক যেন সকলকে দূরে রেখেছে। অনেকের বাবা-মা বৃদ্ধ এই প্রাকৃতিক অদৃশ্য শক্তি এবছর সেই বাবা-মার সাথে ঈদ করতে দেয় নাই। হয়ত এই বছরই কারো জীবনে শেষ ঈদ ছিল। অপূর্ণই থেকে যাবে এই না পাওয়ার জায়গাটি। মানব জীবনে সুখ-দুঃখ নিয়েই তাই এটা স্বাভাবিক ঘটনা। তবে সবচেয়ে বেশি কষ্ট অনুভূত হয়েছে যাদের পরিবার-পরিজন করোনায় মৃত্যবরণ করেছেন। অথবা যাদের বাড়িতে করোনারোগী রয়েছে। তারা যেন অসহায় জীবন-যাপন করছে। পৃথিবীর কোন দুর্যোগই যেন তাদের এতা কষ্ট দেয় নাই। তবে এই ঈদ থেকে কিছু শিক্ষা আমরা পেয়েছি। জগতে যত অর্থ-বৃত্ত্ থাকুক সৃষ্টিকর্তা বা প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর যে আমাদের কারো হাত নেই তা আমরা আবারও অনুভব করতে পারলাম। বুঝতে পারলাম সৃষ্টিকর্তা নামে একজন ছিল, আছে ও থাকবে। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। আমরা যে যে ধর্মই পালন করি না কেন সকল ধর্মের মূলকথা কিন্তু এক। তাই আমরা সকলেই মনে হয় বিষয়টা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি। ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। তাই সময়ে পরিবর্তন হয় বাংলার রূপ।

বাংলার প্রকৃতি যেমন বিচিত্র ঠিক তেমনি বিচিত্র জনগোষ্ঠীর বসবাস এই বাংলাদেশে। একটি বিচিত্র দেশ বাংলাদেশ। অসাম্প্রদায়িক ও সৌজন্যপ্রীতির দেশ। অসংখ্য গোষ্ঠী-সম্প্রদায় ও ভাষার দেশ বাংলাদেশ। এখানে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করে। এক অপরের সার্থে সোহার্দ্য সম্পর্কের মাধ্যমেই বসবাস করে। একসময় এক ধর্মের রীতি-নীতি বা উৎসবে অন্য ধর্মের মানুষের আসা-যাওয়া তেমনটা ছিল না। এমনকি একই সম্প্রদায়ের বা জাতের উৎসবে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষদের আসা-যাওয়া ছিল না। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে এখন জাত-পাত উঠে যাচ্ছে। ঘুচে যাচ্ছে ধর্মীয় গোড়ামী। এখন একটি জাতিতে সকলে মিলনবদ্ধ হচ্ছে আর তা হলো মানবজাতি। এর ব্যতিক্রম কিছু ভাবছে না সৃষ্টিশীল বা উদার মনের মানুষগুলো। আর যাদের মনে গোড়ামী বা কুসংস্কারে ভরা তারা ভাবছে এই বুঝি ধর্ম গেল। কিন্তু একবার উপলব্ধি করেন তো করোনা কোনো নির্দিষ্ট জাতি-ধর্ম বা গোষ্ঠীর মধ্যে হয়েছে না কি? হয় নি।

ভাবুনতো মারা গেলে কেউ কাউকে সাথে নিয়ে গেছে না কি? কাউকে নিয়ে যায় না। মানুষ জন্মগ্রহণ করে একা মৃত্য বরণও করে একা। কোন কিছুই সাথে যায় না বা নিয়ে যেতে কেউ পারবে না। আমাদের সকলের রক্তের রংও কিন্তু একই। সে দৃষ্টিতে ভাবলে আমরা সবাই সমান ও সহযোগী মানবজাতি। কারো জীবনে যেন এমন ঈদ না হয় এই কামনা করি। কামনা করি অতিদ্রুত করোনা বিদায়ের। যেন আগামী ঈদে সকলে মিলে আলিঙ্গনে এই বিষাদময় ঈদের প্রাপ্তিটুকু তুলে নিতে পারি। এবারের এই বিষাদময় ঈদ থেকে আমরা শিক্ষা নেই জগতের কোন কিছুই আমার না। সকল কিছুই সাময়িক। সকল কিছুর মালিক সৃষ্টিকর্তা। আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকি। তার দেখানো পথ অনুসরণ করি। সকল মানুষকে ভালবাসি। হৃদয়ে মনুষ্যত্ব নিয়ে পথ চলি। আমরা আরও মানবিক হই। প্রাকৃতিক পরিবেশকে রক্ষা করি। সর্বোপরি নিজে ভাল থাকি অপরকে ভাল রাখি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।