গোপাল অধিকারী


সকাল হলে কর্মে যেতে হবে, আয় করতে হবে, সংসারে খরচ করতে হবে। করতে হবে বাড়ি কিনতে হবে গাড়ি। রাতে ঘুমাবো সকালে আবারও আগের কথার পুণরাবৃত্তি। এর বাইরে আমরা কমই মনে হয় ভাবি। আমাদের পরিবেশটা কেমন যাচ্ছে বাড়ি করে, গাড়ি নিয়ে কদিন চলব তা যেন হিসেব-নিকেশ নেই। ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস। ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের মানবিক পরিবেশ সংক্রান্ত আর্ন্তজাতিক সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) উদ্যোগে প্রতিবছর সারা বিশ্বের শতাধিক দেশে ৫ জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে সরকারী-বেসরকারীভাবে পালিত হয় দিবসটি। পরিবেশ দিবস উপলক্ষে পরিবেশ মেলা, বৃক্ষমেলা, জাতীয় পত্রিকাসমূহে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ, প্রচারপত্র প্রকাশ, স্মরণিকা প্রকাশ, বেতার-টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠান নির্মাণ ও সম্প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সারা দেশে জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে নিজ নিজ জেলার নির্ধারিত সময়সূচী অনুযায়ী জাতীয় কর্মসূচীর আদলে কর্মসূচী পালন করা হয়। কিন্তু এই বছর কর্মসূচী সীমিত হবে করোনার কারণে আশংকা করছি। প্রতিবছরই কোন না কোন প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখেই দিবসটি পালিত হয়। পূর্বের কয়েকটি প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘আসুন প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করি’ এবং স্লোগান ‘প্লাস্টিক পুনঃব্যবহার করি, না পারলে বর্জন করি’। ‘বণ্যপ্রাণী ও পরিবেশ বাঁচায়, প্রকৃতি বাঁচায় দেশ।

প্রত্যেকটি দিবস পালনের একটি তাৎপর্য রয়েছে। দিবস কিন্তু সাধারণ বিষয় না। একটি বিষয়বস্তু বা সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে সর্তকতা বা করনীয় জানতে বা জানাতে দিবস স্বীকৃতি দেওয়া হয় ও পালন করা হয়। ঠিক পরিবেশ দিবসটিও তেমনি। পরিবেশের প্রতি মানুষের সচেতনতা বাড়াতে, পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখতে এই আয়োজন। কিন্তু প্রতিবছর দিবস পালন করার পরও আমরা কতটা সচেতন হচ্ছি? পরিবেশ নিয়ে আমরা কতটা ভাবছি? বাংলাদেশের পরিবেশ কি হুমকির মুখে নয়? কতটা পরিবেশ রক্ষায় আমরা কাজ করছি সেই পরিসংখ্যানটাও ভেবে দেখা দরকার। দিবসটি পালন করছি এবং করতে হবে এই বিষয়ে আমি দ্বিমত পোষণ করছি না। কারণ নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে, জানতে হবে পরিবেশ কি? কত প্রকার? পরিবেশ দূষণ কি? কিভাবে পরিবেশ দূষিত হয় এবং কিভাবে পরিবেশকে সংরক্ষণ করা যায়। তাছাড়া পরিবেশ আমাদের জন্য কি করে, কিভাবে থাকলে ভাল থাকব বা কেন পরিবেশ সংরক্ষণ করা প্রয়োজন সেটাও জানতে হবে। কিন্তু আমরা যদি দিবসটি পালন যথাযথ মর্যাদায় করার পাশাপাশি যথাযথ ব্যবস্থা প্রতিনিয়ত না নেই তাহলে মনে হয় দিবসটি পালন সার্থক হবেনা।

দিন দিন আমাদের পরিবেশের পরিসংখ্যান হুমকির দিকে এগিয়ে যাবে। পরিবেশটা আমার কাছে ফেসবুকের মত। একটির সাথে অন্যটি জড়িত। যেমন মাটি, পানি, বায়ু একে অপরের সাথে জড়িত। আর এইগুলোর উপর নির্ভর করে মানুষকূল ও প্রাণীকূল। বায়ু দূষণের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। পৃথিবীর ৯১ শতাংশ মানুষ এমন জায়গায় বসবাস করে যেখানে বায়ু দূষণের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি।

বিশ্বজুড়ে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন দূষিত বায়ু সেবন করে বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০১৭ নামক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের ক্রমমাত্রায় আমাদের ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। এ প্রতিবেদন বলছে, গত ২৫ বছরে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভারত ও বাংলাদেশে। যদিও চীন এ তালিকায় আগে প্রথম অবস্থানে ছিল। আমাদের দেশ বায়ু দূষণের বড় কারণ হচ্ছে, যাচ্ছেতাই ভাবে উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা করা। কলকারখানার কালো ধোঁয়া, নগরায়নের কাজ সময়মতো শেষ না হওয়া এবং যথেষ্ট সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে এমন উন্নয়ন কাজ পরিচালনার কারণে বাতাস ভয়াবহভাবে দূষিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ তার একটি বাংলাদেশ।

বাংলাদেশে প্রতিবছর যত মানুষের মৃত্যু হয় তার ২৮ শতাংশই মারা যায় পরিবেশ দূষণজনিত অসুখ-বিসুখে। সারাবিশ্বে এ ধরনের মৃত্যুর হার ১৬ শতাংশ। ২০১৫ সালের এক পরিসংখ্যান তুলে ধরে বিশ্বব্যাংক বলেছে, শহরাঞ্চলে এই দূষণের মাত্রা উদ্বেগজনক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। দূষণের কারণে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পরিবেশ দূষিত হওয়ার এই মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। বায়ু, পানি ও শব্দ দূষণ যেন আজ স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে যার প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্রের ওপর। জলবায়ুর প্রতিকূল প্রভাবও পরিবেশের ওপর পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে বিভিন্ন প্রাণীর জটিল ও কঠিন রোগ দেখা দিচ্ছে।

পরিবেশের ওপর জলবায়ুর প্রভাবের জন্য ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত, খাদ্যাভাবজনিত রোগসহ নানা জটিল ও অপরিচিত রোগ হয়ে থাকে। বেড়ে গেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। পরিবেশ ও জীবন একে অপরের পরিপূরক। পরিবেশ অনুকূলে থাকলে অব্যাহত থাকে জীবনচক্র। তবে মানুষের জীবনচক্রে গৃহপালিত প্রাণীর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। আবার প্রাণীদেরও বেঁচে থাকতে নির্ভর করতে হয় পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর। পরিবেশের বিপর্যয় মানে জীবনের বিপর্যয়। প্রাণিস্বাস্থ্য, প্রাণী উৎপাদন ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তন একটি আন্তঃসম্পর্কিত জটিল প্রক্রিয়া, যার ওপর অনেকাংশেই নির্ভর করে রোগের প্রাদুর্ভাব, উৎপাদন ব্যবস্থাসহ আরও অনেক কিছু।

বৈরী জলবায়ুর করাল গ্রাস থেকে রেহাই পাচ্ছে না বাংলাদেশও। এর পাশাপাশি যোগ হয়েছে পরিবেশ দূষণ। দূষণের দোষে দূষিত হয়ে উঠছে চারপাশ। অতিবৃষ্টি, উচ্চতাপমাত্রা এবং খরার ফলে মানুষের অজান্তেই সৃষ্টি হচ্ছে একের পর এক শক্তিশালী ভাইরাস। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন পরিবেশ, যা অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের জন্য বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না। গত এক যুগে দূষণ ও পরিবেশের বিচারে বাংলাদেশ পিছিয়েছে। খাবার, পানি আর বায়ু ছাড়া জীবজগতের অসিস্ত কল্পনা করা যায় না। যদিও খাবার বা পানি ছাড়া আমরা বেশ কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারি। কিন্তু বায়ু ছাড়া দিন, ঘণ্টা দূরে থাক; আমরা সর্বোচ্চ তিন মিনিট পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারি। ফলে নির্মল বায়ুসেবন প্রতিমুহূর্তের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অথচ আমাদের চারপাশের পরিবেশের এই বিপর্যয়ের একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে বায়ু দূষণ। যার ভয়াবহতা দিন দিন বেড়েই চলেছে বাংলাদেশে ১৯৯৫ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন পাস হয়েছে। কিন্তু জনবিস্ফোরণ, বনাঞ্চলের অভাব ও ঘাটতি এবং শিল্প ও পরিবহন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অভাবের দরুন দেশের পরিবেশ এক জটিল অবস্থার দিকে পৌঁছতে যাচ্ছে।

মৌলিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের দর্শন ছড়ানো ব্রত সংগঠন ডিসকাশন প্রজেক্টের অন্যতম জ্যেষ্ঠ এই বিজ্ঞানকর্মী বলেন, আগে ভাগে বন্যা, অতিক্ষরা জলবায়ূ পরিবর্তনের খড়গ তো আছেই, তবে বাংলাদেশে মানুষ সৃষ্ট দূষণই বন্যপ্রাণী বিপন্ন হওয়ার প্রধান কারণ। বিশ্লেষকরা বলছেন বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে যে বহু বন্য প্রাণীর প্রজাতি হুমকির মুখে পড়েছে সেটি এখন অনেকটাই দৃশ্যমান। বাংলাদেশে ১৬০০ প্রাণীর কথা বলি, তাহলে তার অর্ধেকের মতো বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। উপরোক্ত পরিসংখ্যান ও চিত্র আমাদের জন্য নির্মল ও স্বস্তিদায়ক পৃথিবীর ইঙিগত দেয় বলে আপনার মনে হয় কি? উপরোক্ত ভয়াবহ পরিসংখ্যানের জন্য আপনি বা আমি দায়ী নয় বলতে পারি কি? হয়ত আমি আমার মত পরিবেশ দূষণ রোধে ব্যবস্থা নিচ্ছি কিন্তু পাশের কেউ পরিবেশ দূষণ করলে আমার দায়িত্ব নেই কি? অবশ্যই আছে। নিজেকে ও পরিবেশকে বাঁচাতে আমাদের সকলকেই পরিবেশ রক্ষা করে চলতে হবে এবং জেনে বুঝে কেউ পরিবেশের ক্ষতি করলে আইনের আশ্রয় নেওয়া প্রয়োজন। কেউ না জানলে তাকে জানাতে হবে পরিবেশ কি এবং কেন পরিবেশ সংরক্ষণ প্রয়োজন।

বিজ্ঞানে পড়েছি ৎ, আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে সকল কিছু নিয়েই আমাদের পরিবেশ। অথ্যাৎ গাছপালা, নদী-সাগর, মাটি, পানি, বায়ু সকল কিছুই পরিবেশের অর্ন্তভুক্ত। আর পরিবেশের স্বাভাবিক অবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ হলে তাকে পরিবেশদূষণ বলে। পরিবেশ দূষণের ফলে আমাদের জীবন-যাত্রা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যেমন কারখানার কালো ধোয়া বায়ু দূষণ করে। বায়ুদূষণের ফলে দূষিতবায়ু প্রবেশ করে শ্বাসনালীকে বিষাক্ত করছে। ফলে শ্বাসকষ্টহ বিভিন্ন রোগ-ব্যাধী তৈরি হচ্ছে। এইবার আসি পরিবেশ সংরক্ষণে। পরিবেশ সংরক্ষণ করতে হলে কলকারাখানার কালো ধোয়া নির্গত বন্ধ করতে হবে। শুধু কালো ধোয়া নয় উদাহরন দিতে একটি বললাম। এই যে এমন পরিবেশ দূষনের বিষয়গুলো আছে আমরা যদি সচেতন হয়ে সেগুলো দূষণ রোধ করি ও পরিবেশ সংরক্ষণ করি তাহলে বাঁচবে জীবন, বাঁচবে পরিবেশ। পাবো নির্মল বাতাস। কথায় বলে, দাঁত থাকতে আমরা দাঁতের মর্ম বুঝি না ।

আসলেই তাই কেউ কি ভেবেছি করোনা আমাদের ঘরবন্দী করে ফেলবে?? কেউ কি ভেবেছি করোনার কারণে এতটা ক্ষতি হবে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গতির? আমিও ভাবিনি করোনার কারণে পড়ালেখার লম্বা ক্ষতি হবে ছাত্র-ছাত্রীর। আমাদের করোনার থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। করোনা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ঠিক একইভাবে পরিবেশকে যদি আমরা রক্ষা না করে দিনের পর দিন ব্যবহার করে ধ্বংস করি তাহলে এমন বা এ থেকে ভয়াবহ দুর্যোগ কড়া নাড়বে আমাদের সন্নিকটে। তখন হয়ত রক্ষা করার নিয়মনীতি থাকবে না।

সম্প্রতি আম্পানের কথা সকলেরই মনে থাকার কথা। এই ভয়াবহ ঝড়টি রক্ষা করেছে সুন্দরবন। সুন্দরবনের এমন রক্ষা করার ইতিহাস আরও আছে। কয়জন মানুষ আছে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে আমাদের বাঁচাতে পারে?? তাই আসুন পরিবেশ দিবস থেকেই আমরা পরিবেশ রক্ষায় উদ্যোগ নেই। পরিবেশ রক্ষায় সচেতন হই। সরকারকেও বলব পরিবেশ রক্ষায় আরও সতর্ক হোন। পরিবেশ রক্ষায় পরিবেশ সংরক্ষণ আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করুন। কারণ পরিবেশ বাঁচলে, বাঁচবে বাংলাদেশ।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।