শিতাংশু গুহ


যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপলিসে কৃষাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের পর মে মাসের ২৬ তারিখ থেকে আন্দোলন শুরু হয়, এখনো তা চলছে। শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ডেরেক চৌভিন কনেল্ট আট মিনিট ছিচল্লিশ সেকেন্ড হাটু দিয়ে জর্জ ফ্লয়েড’র গলা চেপে ধরেছিলেন। এ সময় জর্জ ফ্লয়েড ক’বার বলেছেন, ‘আই কান্ট ব্রিথ’। আরো তিনজন পুলিশ অফিসার তাঁর সাথে ছিলেন, তাঁরা সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে এতে জড়িত হয়ে পড়েছেন, বা তাঁদের কর্মকান্ড এই অপরাধ সংঘটনে সহায়ক হয়েছে অথবা তাঁরা এটি ঠেকাতে চেষ্টা করেননি। ডেরেক চৌভিন কনেল্ট গ্রেফতার হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে সেকেন্ড ডিগ্রী হত্যার চার্জ গঠিত হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁর যাবৎজীবন কারাদন্ড হতে পারে। অন্য তিনজন অফিসারের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন চার্জ আনা হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সম্ভবত: সবারই বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি হবে, এড়ানোর সুযোগ নেই?

বাংলাদেশে দৈনিক প্রথম আলো বৃহস্পতিবার ৪ঠা জুন ‘গোপালগঞ্জে এএসআইয়ের পিটুনিতে যুবকের মৃত্যুর অভিযোগ’ শীর্ষক একটি খবর ছেপেছে। এতে বলা হয়েছে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া উপজেলার রামশীল ইউনিয়নের রামশীল গ্রামের নীলকান্ত তালুকদারে ছেলে নিখিল তালুকদার, ৩২ মঙ্গলবার ২রা জুন ২০২০ অন্য তিনজনের সাথে বসে তাস খেলছিলেন। পুলিশ অফিসার শামীম উদ্দিন একজনকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হ’ন। তাঁরা গোপনে তাস খেলা ভিডিও করেন। এ সময় খেলোয়াড়রা টের পেয়ে দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করেন। তিনজন পালতে সক্ষম হ’ন, নিখিল ধরা পড়েন পুলিশ অফিসার শামীমের হাতে। নিখিল তালুকদারের কাকাতো ভাই মিলন তালুকদার প্রথম আলোকে জানান, ‘আমার ভাই তাস খেলেছিলো। এ জন্য পুলিশের এএসআই হাঁটু দিয়ে আঘাত করে তার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে ফেলেন’।

ঢাকার অপর একটি দৈনিক সমকাল ৫ই জুন একই সংবাদ প্রকাশ করেছে। সেখানে নিখিলের স্ত্রী ইতি তালুকদার বলেছেন, 'জমির ধান কেঁটে গোলায় তোলা হয়েছে। কাজ নেই। স্বামী অবসর সময়ে তাস খেলছিলো। এ সময় কোটালীপাড়া থানার এএসআই শামীম উদ্দিন একজন ভ্যানচালক ও এক যুবককে নিয়ে সেখানে যান। গোপনে মোবাইল ফোনে তাস খেলার দৃশ্য ধারণ করেন। তারা বিষয়টি টের পেয়ে খেলা রেখে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। অন্য তিনজন পালিয়ে গেলেও আমার স্বামীকে এএসআই শামীম ধরে মারধর শুরু করে। একপর্যায়ে হাঁটু দিয়ে তার পিঠে আঘাত করা হয়। এতে আমার স্বামীর মেরুদণ্ডে তিনটি হাড় ভেঙ্গে যায়। তাকে প্রথমে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে বুধবার তিনি মারা যান।' তিনি বলেন, আমার স্বামী অপরাধ করে থাকলে তাকে ধরে নিয়ে যেত। বিচার হতো। এভাবে কেন তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো! এখন আমার দুই শিশুসন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে। আমি এ হত্যার বিচার চাই।

রামশীল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খোকন বালা প্রথম আলোকে বলেছেন, ঘটনা শুনে তিনি এলাকায় গিয়ে মানুষের কাছ থেকে জেনেছেন যে, কোটালিপাড়া থানার এএসআই শামিম উদ্দিন হাঁটু দিয়ে নিখিল তালুকদারের পিঠে আঘাত করার ফলে মেরুদণ্ড তিন খণ্ড হয় যায়। পরে এক্স-রে-তে তা নিশ্চিত হয়? এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, নিখিলকে মারপিট করতে থাকেন পুলিশ কর্মকর্তা। দৈনিক সমকালকে তিনি বলেছেন, নিখিল এলাকায় ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিত ছিল। এভাবে পিটিয়ে মারাটা দুঃখজনক। পুলিশ আইনের লোক হয়ে এমন বেআইনি কাজ করলে জনগণ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? অভিযুক্ত এএসআই শামীম উদ্দিন প্রথম আলোকে কোন কথা না বললেও সমকালকে বলেছেন, 'আমি কিছুই বলব না। ওসি স্যারের সঙ্গে কথা বলেন।' ওসি শেখ লুৎফর রহমান বলেন, নিখিলকে পুলিশ মারধর করেনি। সে দৌড়ে পালানোর সময় গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে পড়ে গিয়ে কোমরে ব্যথা পেয়েছে।

পুলিশের বক্তব্য হাস্যকর। এই মৃত্যু’র দায় কে নেবে? পুলিশ দায় নেবে না? প্রশাসন, সরকার? জানা যায়, পুলিশ ভিকটিমের পরিবারকে চিকিৎসার জন্যে পাঁচ হাজার টাকা দিতে চেয়েছে, কিন্তু নিখিলের পরিবার তা গ্রহণকরেনি। আরো জানা যায়, ভিকটিম পরিবারকে আপোষের জন্যে চাপ দেয়া হচ্ছে। এলাকাটি প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা। প্রধানমন্ত্রী কি বিষয়টি দেখবেন? মিনিয়াপলিস পুলিশ প্রধান জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের জন্যে ক্ষমা চেয়েছেন। অনেক শহরে পুলিশ হাঁটু গেড়ে আন্দোলনকারীদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। বিভিন্ন শহরে মার্কিন পুলিশ স্পষ্টত: প্রমান করেছেন, একজন ডেরেক চৌভিন কনেল্ট’র অপকর্মের দায় তাঁরা নেবেন না? বাংলাদেশের পুলিশ কেন একজন অফিসার শামীম উদ্দিনের অপকর্মের দায় নেবে? একজন অফিসারের জন্যে পুরো পুলিশবাহিনী’র ভাবমুর্ক্তি ক্ষুন্ন হতে পারেনা? অপরাধী তিনি যেই হোন, তাঁকে ধরা পুলিশের কাজ, পুলিশ স্পষ্টত: তা করছে না?

যুক্তরাষ্ট্রে কৃষাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ড এবং বাংলাদেশে নিখিল তালুকদার হত্যাকাণ্ডে একটি আশ্চর্য মিল রয়েছে? দু’টি ভিন্ন রাষ্ট্রে দু’জন পুলিশ অফিসার হাঁটু দিয়ে দু’জনকে হত্যা করলেন। অফিসার শামীম কি মিনিয়াপলিসের ডেরেক চৌভিন কনেল্ট এর অপকর্মে উদ্বুদ্ধ হয়ে এমন একটি অপকর্ম করতে পারলেন? নিখিল একজন সাধারণ কৃষক। তাঁর অপরাধ তাস খেলা। জর্জ ফ্লয়েডের অপরাধ ছিলো তিনি একটি জাল কুঁড়ি ডলারের নোট দোকানীকে দিয়েছিলেন। বিনা অপরাধ বা সামান্য অপরাধে দু’জন প্রাণ হারালো। উভয় দেশে দু’জন সংখ্যালঘু? কৃষাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ড’র ভিডিও দেখে পুরো আমেরিকা তাঁর সমর্থনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাংলাদেশে কি এমনটা আশা করা যায়? নিখিল হত্যাকাণ্ডের ভিডিও এখনো আসেনি, কেউ ভিডিও করেছেন কিনা তাও জানা যায়নি। ভিডিও থাকলে হয়তো বোঝা যেতো ঘটনার নৃশংসতা! ভিডিও থাকুক বা না থাকুক, একটি হত্যাকান্ড ঘটেছে, এটিকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই? অথচ পুলিশ এড়িয়ে যাচ্ছে, একজন শামীম উদ্দিনকে বাঁচাতে পুরো পুলিশ প্রশাসনের ওপর কলংক লেপন করছে।

আমেরিকাতে বর্ণবাদ বিরোধী বিক্ষোভ চলছে। পুলিশ প্রশাসন দায়িত্ব নিচ্ছে। বাংলাদেশে ঠিক উল্টো। আমেরিকাতে বলা হচ্ছে, ‘ব্ল্যাক লাইভ মেটারস’। বাংলাদেশেও ‘হিন্দু লাইফ মেটারস’ একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হতে পারে, বা হওয়া উচিত। এটি কারো বিরুদ্ধে নয়, সচেতনতা সৃষ্টির জন্যেই এর প্রয়োজন আছে। সংখ্যালঘুরা এই আন্দোলনটি শুরু করতে পারেন, সংখ্যাগুরুরা তাতে যোগ দেবেন। বাংলাদেশে বর্ণবাদ নাই, সাম্প্রদায়িকতা আছে। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে শুভ শক্তি’র উত্থানের এটি একটি সুযোগ এবং এর প্রয়োজন আছে। হোক শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। তবে স্মরণ রাখতে হবে, করোনা’র প্রাদুর্ভাব চলছে। সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক বাধ্যতামূলক থাকা উচিত। আন্দোলন করে করোনায় আক্রান্ত হওয়া যাবেনা। করোনা দূর হোক, আন্দোলন চলুক। শুধু পুলিশ নয়, সমাজ থেকে সকল ধরণের নৃশংসতা দূরীকরণে বাংলাদেশে একটি সুস্থ আন্দোলন দরকার আছে। ‘হিন্দু লাইফ ম্যাটারস ইন বাংলাদেশ হোক সেই আন্দোলন।


লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।