মৌলভীবাজার প্রতিনিধি : মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় আব্দুল মুস্তাফিজ সুয়েব (১৬) নামে এক কিশোরকে হাত বেঁধে নির্যাতনের অভিযোগের খবরে সমগ্র জেলা জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। জানা যায়, দুই যুবকের নারীঘটিত জটিলতা ও টাকা পয়সা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে কিশোর মুস্তাফিজকে কথিত বাইসাইকেল চুরির অভিযোগ দিয়ে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়। 

অমানবিক এই ঘটনাটি ঘটেছে উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নের চান্দপুর গ্রামের বাসিন্দা ব্যবসায়ী আব্দুল জলিলের ছেলে কিশোর আব্দুল মুস্তাফিজ সুয়েবের সাথে। নির্মম ঘটনার ১৯ দিন পেরিয়ে গেলেও অন্যায়ভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়ার বিচার পায়নি বলে অভিযোগ কিশোর মুস্তাফিজের পরিবারের। বরং সোস্যাল মিডিয়ায় নির্যাতনের ছবি ভাইরাল এবং গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের কারনে উল্টো নির্যাতিত কিশোরের পরিবারকে ভয়ভীতি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে এক ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে। নির্যাতনের শিকার ওই কিশোরের বাবা জানান, ঘটনার পর থেকে থানায় যাতে কোন অভিযোগ না করি সেব্যাপারে অভিযুক্ত ইউপি সদস্যে কর্তৃক পরোক্ষ হুমকি-ধমকির কারনে তাদের পরিবার চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভৃুগছেন।

জানা যায়, গত ২ মে টিলাগাঁও ইউনিয়নের আশ্রয় গ্রামের বাসিন্দা হোটেল ব্যবসায়ী কাইয়ূম মিয়ার ব্যবহৃত বাইসাইকেলটি মনু নদীর আশ্রয় গ্রাম বাঁধ এলাকা থেকে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। হারিয়ে যাওয়ার ঘটনার ১২ দিন পর গত মাসের ১৪ মে কাইয়ুমের হারিয়ে যাওয়া বাইসাইকেলটি পার্শ্ববর্তী পৃথিমপাশা ইউনিয়নের ছৈদলবাজারে শাহ আলমের নিকট পাওয়া যায়। খবর পেয়ে ওইদিন রাতে টিলাগাঁও ইউনিয়নের ৬নং ওয়াডের্র সদস্য মো. বাদশা মিয়া ও ১ নং ওয়ার্ডের সদস্য মখলিছুর রহমান, সাইকেলের মালিক কাইয়ুম, গ্রাম পুলিশ শাহাব উদ্দিন ও ফরিদকে নিয়ে ছৈদলবাজার এলাকায় গিয়ে সাইকেলটি উদ্ধার করেন এবং এসময় সেখানে আটকে রাখা কিশোর মুস্তাফিজকে হাত বেঁধে টিলাগাঁওয়ের আশ্রয়গ্রামে নিয়ে আসেন। এসময় তাঁরা মুস্তাফিজকে একটি দোকানের বেড়ার সাথে হাত বেঁধে রেখে রাতভর অমানবিক নির্যাতন করেন বলে জানা যায়।

এদিকে রাতে ছেলের কোন খবর না পেয়ে মুস্তাফিজের পিতা আব্দুল জলিল ও চাচা স্কুল শিক্ষক আব্দুল হান্নান বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুজি করতে থাকেন। সকালে খবর পান মুস্তাফিজকে আশ্রয় গ্রামে চুরির অভিযোগে বেঁধে রাখা হয়েছে। এরপর আব্দুল জলিল বিষয়টি স্থানীয়দের অবগত করেন এবং তাঁদের সাথে নিয়ে ঘটনাস্থলে যান। সেখানে গিয়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ইউপি সদস্য বাদশা মিয়াকে অনুরোধ করেন। তখন বাদশা মিয়া তাঁদের জানান মুস্তাফিজকে ছাড়িয়ে নিতে হলে ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মালিককে জানাতে হবে। তিনি নির্দেশ দিলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে।

পরে আব্দুল জলিলসহ স্থানীয় মুরব্বী তছবির আলীকে নিয়ে যান ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মালিকের বাড়িতে গিয়ে ঘটনাটি অবগত করেন। চেয়ারম্যান আব্দুল মালিক বিষয়টি পরবর্তীতে সালিশী বৈঠকের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে দিবেন বলে তছবির আলীর জিম্মায় মুস্তাফিজকে তার অভিভাবকের নিকট হস্তান্তর করেন।

৩ জুন বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য সালিশি বৈঠকের তারিখ ছিলো। কিন্তু এর আগের দিন মঙ্গলবার ২ জুন মুস্তাফিজকে হাত বেধে রাখার একটি ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হলে চেয়ারম্যান আব্দুল মালিক পূর্বনির্ধারিত সালিশী বৈঠক স্থগিত করেন।

নির্যাতনের শিকার কিশোর মুস্তাফিজের পিতা আব্দুল জলিল এবং চাচা আব্দুল হান্নানের সাথে কথা বলে জানা যায়, মুস্তাফিজ স্থানীয় আশ্রয় গ্রামের বাসিন্দা মৃত হুরমত আলীর ছেলে মো. শামীম ওরফে কুদরতের সাথে মনু বাঁধ এলাকায় বালু উত্তোলনের শ্যালো মেশিন পাহারা ও সেখানে দৈনিক মজুরীতে কাজ করতো। সেই সুবাদে গত ২ মে ব্যবসায়ী কাইয়ুমের সাথে কুদরতের টাকা পয়সার লেনদেন সংক্রান্ত ও নারীঘটিত পূর্ব বিরোধের জেরে কাইয়ুমের বাই সাইকেলটি পাশ্ববর্তী পৃথিমপাশা ইউনিয়নের ছৈদল বাজারে শাহ আলমের নিকট পাঠাতে কিশোর মুস্তাফিজকে বলে কুদরত। তার কথামতো কিশোর মুস্তাফিজ সাইকেলটি শাহ আলমের নিকট পৌঁছে দেয়। এরপর ওই সাইকেলটি চুরি হয়েছে বলে অভিযোগ এনে অন্যায় ভাবে তাকে বেঁধে মারধর করা হয়। এখনো তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।তারা আরও বলেন, চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্য আমাদের বিষয়টি বৈঠকের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে দিবেন বলে আশ্বাস প্রদান করলে আমরা প্রশাসন কিংবা সাংবাদিকদের বিষয়টি জানাইনি।

তিনি বলেন, কাইয়ুম ও কুদরতের বিরোধের কারণে আমার ছেলেকে অন্যায়ভাবে ফাঁসিয়ে চুরির অপবাদ দিয়ে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। এতে সামাজিকভাবে আমার পরিবারের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়েছে। এ ঘটনার আমরা ন্যায় বিচার চাই প্রশাসনের কাছে।

এ-বিষয়ে ব্যবসায়ী কাইয়ুম জানান, ‘আমার ব্যক্তিগত পুরাতন বাই সাইকেলটি টিলাগাঁওয়ের চড়ক বাঁধ এলাকায় রেখে আমার বোনের বাড়িতে যাই। সেখান থেকে ফিরে সাইকেলটি পাইনি। বিষয়টি মেম্বার বাদশা মিয়াকে জানাই। পরে জানতে পারি সাইকেলটি ছৈদলবাজারে আছে এবং সেখানকার লোকজন মুস্তাফিজকে আটকে রেখে খবর দিলে মেম্বারসহ আমরা সেখানে যাই। এসময় তাঁকে হাতে বেঁধে আশ্রয়গ্রামে আনা হয়। এসময় কিশোরকে কি করেছেন মেম্বার সেটা মেম্বারই ভালো বলতে পারবেন।

অভিযুক্ত ইউপি সদস্য বাদশা মিয়া জানান, ‘আমার ওয়ার্ডের ব্যবসায়ী কাইয়ুমের চুরি যাওয়া সাইকেলটি পৃথিমপাশার ছৈদল বাজারে পাওয়া গেছে বলে জানতে পেরে সেখানে গ্রাম পুলিশসহ যাই। কিশোরকে রাতভর বেঁধে নির্যতনের বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে প্রথমে নির্যাতনের বিষয় অস্বীকার করলেও বেঁধে নিয়ে আসার সত্যতা স্বীকার করে নেন তিনি। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের কারনে বিভিন্ন ভাবে ওই কিশোরের পরিবারকে হুমকি-ধমকির বিষয়ে জানতে চাইলে ইউপি সদস্য বাদশা মিয়া বিষয়টি অস্বীকার করেন।

এ দিকে ঘটনার বিষয়ে বক্তব্য জানতে টিলাগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মালিক এর ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

তবে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে কুলাউড়া থানার অফিসার ইনচার্জ মো. ইয়ারদৌস হাসান জানান, আমরা এবিষয়ে কোন অভিযোগ এখনো পাইনি তবে বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে, অভিযোগ পেলে তদন্তক্রমে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

(একে/এসপি/জুন ০৭, ২০২০)