আবীর আহাদ


মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাকে সমুন্নত রাখা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে যথাযথ পরামর্শ দেয়ার লক্ষ্যে তাঁর একজন উপদেষ্টা থাকা প্রয়োজন বলে মনে হয় । কারণ এ পর্যন্ত যাদেরকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী করা হয়েছে তারা প্রতি পদে পদে নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছেন । ঐসব মন্ত্রীরা জানেন না কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনা ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হয় ।

অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, মন্ত্রীদের অযোগ্যতার সুযোগ নিয়ে বা তাদের অগোচরে বা তাদের অন্ধকারে রেখে মুক্তিযুদ্ধ-চেতনাবিরোধী আমলা-কর্মচারীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুন্ঠিত করার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের শুধু অবজ্ঞাই নয়, তাদের সাথে চরম দুর্ব্যবহারসহ তাদের সনদ ও গেজেট নামের বানান ভুল লিখে ভাতা ও অন্যান্য বিষয়ে জটিলতা সৃষ্টি করে এবং সেটি আবার সংশোধনের নামে তাদের কাছ থেকে বিরাট অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়; কায়দা-কৌশলে নিজেদের বাবা দাদা শ্বশুরসহ অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয় ! এ ব্যতীত গত ক'বছর পূর্বে মুক্তিযুদ্ধে অবদান-রাখা বিদেশি বন্ধুদের জন্য নির্মিত সোনার ক্রেস্টে সোনা না-দেয়ার মতো জঘন্য ঘটনা ঘটলেও এ-জালিয়াতির সাথে জড়িত আমলা-কেরানি-ঠিকাদারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি । এনিয়ে বিদেশের কাছে আমাদের দেশের মর্যাদা দারুণ ক্ষুন্ন হয়েছে । এছাড়া বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে হরিলুটের কারবার চলে আসছে ফ্রি-স্টাইলে ।

আর একটি বিষয় লক্ষণীয়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালযটির নামের সাথে জাতীয় চেতনা জড়িত থাকলেও দু:খজনক সত্য এই যে, এ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ৯০% ক্ষেত্রে অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অমুক্তিযোদ্ধাসহ স্বাধীনতাবিরোধী পরিবার থেকে এসেছে ! মনে হয়, কেউ যেন কোথায় বসে বেছে বেছে এমন অপকর্মটি নির্দ্বিধায় করে আসছে ! এমনও প্রমাণ রয়েছে যে, যুদ্ধাপরাধে ফাঁসিতে-ঝোলা আলবদর নেতা ও চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর এককালীন একান্ত সচিবকে পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব করা হয়েছিল !

বিগত যুগ যুগ ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি নিদারুণ অবিচার অবহেলা অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়েছে । ফলশ্রুতিতে তাদেরই ত্যাগ তিতিক্ষা শৌর্য্য ও বীরত্বে অর্জিত বাংলাদেশে তাদের অধিকাংশই চরম মানবেতর জীবন যাপন করতে করতে বর্তমানে মরণসাগর পাড়ে এসে পৌঁছেছে । অপর দিকে সরকারের মধ্যে অবস্থানকারী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটি পাষন্ড আমলাশক্তি মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের প্রতিও নানাভাবে বিরূপ আচরণ করেছে, শেষ পর্যন্ত নানান ছলেকলেকৌশলে জাতির পিতা প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটাটি পর্যন্ত তারা খেয়ে ফেলেছে ! ১৯৭২ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করা পর্যন্ত মাঝখানের কয়েক যুগে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কতোজনকে চাকরি দেয়া হয়েছে, সেটি খতিয়ে দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, মুক্তিযোদ্ধা কোটা তথা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কী জঘন্যতম প্রতারণা সংঘটিত করা হয়েছে ।

অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের মেধা নেই বলে অনেক আমলা ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা সীমাহীন নির্দয় কথাবার্তা বলে প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অসম্মান দেখানোর ধৃষ্টতাও প্রদর্শন করেছে, যা সহ্যসীমার বাইরে । আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন কতিপয় সচিবকে জানি যারা মাতৃভাষা বাংলায় একটি সঠিক বাক্য লিখতে জানেন না ! আর বানান তো মাশাল্লাহ------! নিচের কেরানি সাহেবরা যে নোট লিখে দেন, সেটিই তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চালিয়ে দেন । প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তথাকথিত মেধার কী মূল্য আছে তা আমরা কমবেশি জানি । মূলত: তথাকথিত মেধার কথা বলে পূর্বে ও পরে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের বঞ্চিত করা হয়েছে । এর অর্থ হলো, প্রশাসনে যেনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা না থাকে । আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা না থাকলে মনোজগতে একধরনের রাজাকারি ও শয়তানি জন্ম নেয়, যার ফলশ্রুতিতে আমরা দেখতে পাই, একশো কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় এক হাজার কোটি, এক কোটি টাকার মালামাল ক্রয় দেখানো হয় দশ কোটি ! তাই তো একটা পাঁচশত টাকার বালিশের ক্রয়মূল্য হয়ে যায় ছয় হাজার টাকা, একটা নারকেল গাছের ক্রয়মূল্য দাঁড়ায় নয় লক্ষ টাকা, একটা তিন হাজার টাকার পর্দার ক্রয়মূল্য দাঁড়ায় পঁয়ত্রিশ লক্ষ টাকা ইত্যাদি ইত্যাদি ! প্রশাসনে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পরশ থাকলে অবশ্যই এধরনের জালিয়াতি সংঘটিত হতো না ।

অন্যদিকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে একটি বাণিজ্যনির্ভর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা আবিষ্কার করে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কার্যক্রমে এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-জামুকা ও আমলারা যে কী নিদারুণ দুর্নীতি, ব্যর্থতা অযোগ্যতা ও অপদার্থতার পরিচয় দিয়ে আসছেন তা দেখলে হতাশায় মন ভরে ওঠে । নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে ! অপরদিকে মন্ত্রণালয় ও জামুকার অপরিণামদর্শিতায় গত কয়েক বছর পূর্বে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কার্যক্রমে সর্বকালের সেরা নপুংসক সংগঠন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তথাকথিত নির্বাচিত কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে যে কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে, তাদের বিরাট অংশ সব সভ্যতা ভব্যতা ও নৈতিকতার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে বিভিন্ন স্হানে ভূয়াদের রক্ষা ও হবুদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়ার অনৈতিক আর্থিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়ার কারণে পুরো কার্যক্রমটি ভন্ডুল হয়ে গিয়েছিলো, যার ফলে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে ।

সুপ্রিম কোর্টের আদেশে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই পুনরায় শুরু হলেও দেখা গেছে, জামুকা নামক আরেকটি মুক্তিযোদ্ধা সংস্থার নেতৃত্বে অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় এখন যাকে-তাকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর অপকর্মটি হচ্ছে । মূলত: বঙ্গবন্ধু সরকারের বাহাত্তর সালের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে ত্রুটিমুক্ত স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নের লক্ষ্যে বিচারবিভাগ, সামরিক বাহিনী ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে যাচাই বাছাই কার্যক্রমটি পরিচালনা করা উচিত ছিলো । অন্তত: আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নানা-বিষয় নিয়ে গবেষণাকর্মে নিয়োজিত রয়েছি, তাদেরকে ডেকে এসব ব্যাপারে পরামর্শ নিতে পারতেন । কিন্তু সকলই গরল ভেল !

মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে রাষ্ট্রীয় সকল কাঠামোয় প্রবাহিতকরণ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা রক্ষাসহ তাদের অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে জ্ঞাত করানোর জন্য তাঁরই কার্যালয়ের অধীনে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একটি সেল গঠন করে, তাঁকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়ার লক্ষ্যে একজন উপদেষ্টা নিয়োগ করা যেতে পারে বলে আমার ধারণা । কারণ চলমান দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতান্ত্রিকতার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনোপ্রকার ভালো-মন্দের খবরাখবর অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হয় না । মুক্তিযোদ্ধারা এ মন্ত্রণালয় ও জামুকার দ্বারা যে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চরমতম হতাশা ও বেদনার মধ্যে রয়েছেন, এ-বিষয়টিসহ মুক্তিযুদ্ধের নানান প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে যথাযথ অবহিতকরণ ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করার বিষয়টি গভীরভাবে মূল্যায়ন করার জন্য সরকারসহ বুদ্ধিজীবী ও দেশপ্রেমিক দেশবাসীর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।