শাহ্ আলম শাহী


“করোনার চেয়েও ভয়কর, সাংবাদিকতায় ঈর্ষা!”এই বাক্য’টি উপস্থাপনের জন্য হয়তো অনেকেই আমাকে তিরস্কার করবেন। অনেকেই গালি দিবেন, মনে মনে। যা আমি শুনবোনা বা জানবো না। আমাকে তিরস্কার করা ওই গালি থাকবে, আপনার কাছেই। যে গালি আপনাকেই দিলেন, আপনি। আমাকে নয়। কারণ, কাউকে কিছু দেয়া হলে কেউ তা গ্রহণ না করলে, দাতার কাছেই তা থেকে যায়। এখানেও ঈর্ষা।

যুগে যুগে অনেক রোগ-ব্যাধি এসেছে। মহামারী আকার ধারণ করেছে। আবার বিদায়ও নিয়েছে। কিছু রোগ-ব্যাধি স্থায়ী হলেও মানুষের নিয়ন্ত্রণে সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু, ঈর্ষা নিয়ন্ত্রণহীন। এখন অসহনীয় রূপ ধারণ করেছে। বিশেষ করে, সাংবাদিকতায় ঈর্ষা এখন এক ভয়াবহ ব্যাধি। এই ঈর্ষা’র কারণে অনেক সংবাদকর্মী চরম পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন। শুধু, লাঞ্চনা, বঞ্চনা, হয়রানী আর হামলা, মামলার শিকার নয়, জীবন দিতে হচ্ছে, অনেক সংবাদকর্মীকে। অকালে ঝরে যাচ্ছে, অসংখ্য সাংবাদিক।শিকার হচ্ছে, হত্যা-গুমের।ঈর্ষা বেশির ভাগই গোপন শক্র। গোপন ব্যাধি। করোনাভাইরাসের লক্ষণ বা উপসর্গ আছে। ঈর্ষার নেই। তাই, “করোনার চেয়েও ভয়কর, সাংবাদিকতায় ঈর্ষা!”

করোনা এখন বৈশ্বিক মহামারি। বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বেই এখন এক চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। থমকে গেছে জীবন,পাল্টে যাচ্ছে জীবনাচার। চারদিকেই শুধু মৃত্যুর মিছিল, খারাপ খবর। প্রকৃতির প্রতিশোধের আগুনে পুড়ছে দুনিয়া। অদৃশ্য করোনাভাইরাসের ভয়ংকর ছোবলে তছনছ হয়ে গেছে বিশ্ব পরিস্থিতি। মহাশক্তিধর দেশগুলোও হাবুডাবু খাচ্ছে, পরিস্থিতি সামাল দিতে। মুখ থুবড়ে পড়েছে অর্থনীতি। বাড়ছে বেকারত্ব ও ক্ষুধা। আমাদের দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে অবাধ তথ্যপ্রবাহ সচল রাখতে সাংবাদিকরা দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন।রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত সাংবাদিক সমাজ এই দুর্যোগ মোকাবেলায় তথ্য প্রচারের মাধ্যমে সরকারকে সহায়তা করছে। করোনার সর্বশেষ তথ্য পরিবেশন করে জনগণকেও সচেতন করছে গণমাধ্যমগুলো। পেশাগত এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, সংবাদকর্মীদের।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জাতীয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ইতোমধ্যেই অসংখ্য সাংবাদিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যু বরণ করেছেন বেশ কয়েকজন। যেমন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, তেমনি সাংবাদিকদের বিরাট অংশও আজ চরম সংকটের মধ্যে পড়েছে। কিন্তু, সব পেশার প্রণোদনা থাকলেও সাংবাদিকদের নেই। প্রথম দিকেই বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকের তালিকা তৈরীর উদ্যোগ নিলেও তা পরবর্তীতে বাতিল করেছে। প্রেস ইনষ্টিটিউট-বাংলাদেশ, সাংবাদিক কল্যাণ তহবিল থেকে পরিস্থিতির স্বীকার সাংবাদিদের অর্থ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলেও তা কতিপয় সাংবাদিক নেতা লুটে পুটে খাচ্ছেন।

এর আগে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ যে তালিকা তৈরী করতে বলেছিলেন, সেখানেও এই কতিপয় সাংবাদিক নেতারাই নিজের এবং পরিবারের স্বজনদের নামের তালিকা সাংবাদিকের তালিকা হিসেবে জমা দিয়েছিলেন। প্রতি বছর প্রেস ইনষ্টিটিউট-বাংলাদেশ এর সাংবাদিক কল্যাণ তহবিল থেকে যে কোটি কোটি টাকা দঃুস্থ এবং অসুস্থ্য সাংবাদিকদেও জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, সেই টাকার সিংহ ভাগ চলে গেছে, কথিত সাংবাদিক নেতাদের পেটে।

অথচ, দুঃস্থ সাংবাদিকরা না খেয়ে থাকছেন। অসুস্থ্য সাংবাদিকরা চিকিৎসার অভাবে ধুকে ধুকে মরছেন। এই যে প্রকাশ্যে লুটপাট আর কেড়ে খাওয়াটাও কতিপয় সাংবাদিক নেতাদের ঈর্ষা।

ইংরেজি ‘জার্নাল’ এবং ‘ইজম’ থেকে জার্নালিজম বা সাংবাদিকতার উৎপত্তি। ‘জার্নাল’ শব্দের অর্থ কোনো কিছু প্রকাাশ করা এবং ‘ইজম’ শব্দের অর্থ অনুশীলন বা চর্চা করা। সে হিসেবে কোনো কিছু জনসমক্ষে প্রকাশ করার জন্য যে চর্চা বা অনুশীলন তাকে সাংবাদিকতা বলা হয়।

তাই, প্রেস ইনষ্টিটিউট-বাংলাদেশ, সাংবাদিক কল্যাণ তহবিল থেকে করোনা পরিস্থিতির স্বীকার ও কর্মহীন হয়ে পড়া সাংবাদিদের জন্য যে অর্থ সহায়তার দেয়া হয়েছে, সেই অর্থ কোন কোন সাংবাদিক গ্রহণ করেছেন এবং এর আগে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ যে তালিকা তৈরী করতে বলেছিলেন, সেখানে কোন কোন সাংবাদিকের নামের তালিকা আছে, তা প্রকাশ করাই প্রকৃত সাংবাদিকতা। কিন্তু, তা প্রকাশ করলে বা প্রকাশের উদ্যোগের প্রস্তাব দিলেও আপনি হবেন, সাংবাদিকতার ঈর্ষার শিকার। আপনাকেই বলা হবে অপসাংবাদিক। হলুদ সাংবাদিক।

তাই, এই ঈর্ষার উৎপত্তি নিয়ে আলোচনা করতে চাই।ঈর্ষার সমার্থক আর প্রতিশব্দ হচ্ছে : হিংসা, দ্বেষ, বিদ্বেষ, বিরাগ, আক্রোশ, দমিতকরা, প্রতিহত করা, অসূয়া, পরশ্রীকাতরতা, রেষারেষি, রিষ, বৈরীভাব, বৈরিতা, অন্তর্দাহ, অভিষঙ্গ, চিত্তদাহ, পরহিংসা, খলতা করা, বিরক্ত করা, জ্বালাতন করা আর মাৎসর্য।

ঈর্ষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত সেই দুই লাইন- “আমাদের আজন্ম কালের প্রতিনিয়ত অভ্যাস দৃষ্টান্তে আমাদিগকে অন্ধ বাধ্যতার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত করিয়া রাখে। তাহাতে আমরা অধীনস্থ লোকের প্রতি অত্যাচারী,সমকক্ষ লোকের প্রতি ঈর্ষান্বিত এবং উপরিস্থ লোকের নিকট ক্রীতদাস কইতে শিক্ষা গ্রহণ করি”।

বর্তমান সময়ে এ বাক্যগুলো চরমভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। আমরা একজনের ভালো কাজ দেখে,কারো প্রশংসা দেখে ঈর্ষাম্বিত হয়ে পড়ি।

আমাদের মন-মানসিকতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, আমরা কারও ভালো কাজে বাহবা না দিয়ে হিংসাত্মক আচরণ করি।
আপনি সাংবাদিকতা পেশায় সফল হয়েছেন, আপনার এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট প্রকাশিত বা প্রচারিত হচ্ছে ? আপনি টিভি চ্যানেলে ঘন ঘন লাইভ কিংবা রিপোর্টে পিটিসি দিচ্ছেন ? টিভি চ্যানেলে আপনাকে নিয়মিত দেখা যাচ্ছে, কিংবা নতুন কিছু প্রপ্তি এসেছে আপনার সাংবাদিকতা পেশায় ? পেশাগত খ্যাতি অর্জন করেছেন ? পেশাদারদের সু-সংগঠিত করতে নতুন কোন সংগঠন করছেন ? আপনার কষ্টার্জিত সাফল্যে হয়তো একটু সুখ আর শান্তি উপভোগ করছেন ?

এক সময় আপনি লক্ষ্য করবেন আপনার পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরাই আপনাকে ঈর্ষা করছে। আপনার কর্মরত হাউজ বা সংগঠন থেকেও আপনার পেশায় নিয়োজিতরাই আপনার প্রতি হচ্ছে, ঈর্ষাপরায়ন। এই ঈর্ষা অনেকের প্রকাশ্য ব্যবহারে ফুটে ওঠছে, আবার অনেকের ক্ষেত্রে গোপনে রয়েছে! প্রকশ্যগুলো তো আপনি বুঝেই নিচ্ছেন কিন্তু গোপন ঈর্ষাগুলো কিভাবে বুঝবেন?

এই গোপন ঈর্ষা নিয়ে মনস্তত্ত্ব বিষয়ক আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইট 'দ্য মাইন্ডস জার্নাল' একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে কয়েকটি লক্ষণের কথা বলা হয়েছে, যেগুলো দেখে চিহ্নিত করা যেতে পারে যে কোন ব্যক্তি আপনাকে গোপনে ঈর্ষা করছে।

কেউ যদি আপনার কোনও সাফল্যকে ছোট করে দেখেন, জানবেন, তিনি আপনার প্রতি ঈর্ষাকাতর। সব সময় আপনার খুঁত ধরার চেষ্টা করেন, এমন লোক থেকে সাবধান! তারা কিন্তু আপনার প্রতি গোপনে হিংসের জাল বুনে চলেছেন। চরম ক্ষতি করতে পারে আপনার। এমন কি আপনার প্রাণ নিতেও তার দয়া-মায়া নেই। আপনার প্রাণ নিতে ৩য় পক্ষ অর্থাৎ আপনার শক্রকে বেশি সহায়তা করবে সে। প্রসঙ্গতঃ প্রকৃত সাংবাদিকের কোন বন্ধু নেই। প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে তার শক্র। সঠিক সাংবাদিকতার জন্য।

খেয়াল করুন, কেউ আপনাকে অনুকরণ করছেন কি না। গোপনে ঈর্ষান্বিত ব্যক্তিদের এটা প্রাথমিক লক্ষণ।
খেয়াল রাখবেন, আপনার পিছনে কেউ কোনও গুজব রটাচ্ছেন কি না। যদি রটে, তা হলে সেই গুজবের উদ্যোগ দাতাকে খুঁজে বের করুন। জানবেন, তিনি কোনও গোপন ঈর্ষা থেকেই এই কান্ড ঘটাচ্ছেন।

কেউ কি আপনাকে অযাচিত উপদেশ দিচ্ছেন? এমন ক্ষেত্রে কিন্তু সেই ব্যক্তির গোপন ঈর্ষাকারী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

মূলতঃ চ্যালেঞ্জিং পেশা সাংবাদিকতা। মফস্বল জেলাগুলোতে ঝড় সামলিয়ে এ চ্যালেঞ্জিং পেশায় টিকে থাকার চেষ্টা করছেন অনেকেই। লেজুড়বৃত্তি সাংবাদিকতা পরিহার না করলে বা নিজ বিবেকের কাছে নতজানু না হলে অনেক ষড়যন্ত্রের শিকার হবেন আপনি। একারণে আপনাকে কুপোকাত করার অপপ্রয়াস চলবে। চলবে, দাঁতালো আক্রোমনের অভিসন্ধি! পেশাদারিত্বের কারণে ষড়যন্ত্রের শিকার হবেন আপনি। কন্ঠ রোধ করার অপপ্রয়াসে চলবে।সত্য প্রকাশের কারণে মিথ্যা মামলা ও অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে আপনাকে। শিকার হবেন, বিকার গ্রস্থ সাংবাদিকদের বিকৃত অভিরুচি’র।

মূলতঃ পেশাগত দুঃসাহসিতকায় কারণে আপনি হবেন.কারো কারো অপছন্দের। সেই সাথে ঘটবে আপনার প্রতি ঈর্ষনীয় বহিঃপ্রকাশ। আমাদের শুধু নয়, বহিঃবিশ্বের সাংবাদিকরা চ্যালেঞ্জিং পেশা সাংবাদিকতা থেকে নানা জুট-ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ছেন। হয়রানী, মামলা, হামলা এমন কি হত্যার শিকার হচ্ছেন, আপোষহীন সাংবাদিকরা। খোঁজ বা অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেন, এর অধিকাংশরই পেছনে রয়েছে,সাংবাদিকের হাত বা ইন্ধন ! অবাক হওয়ার কিছু নেই, এরই নাম ঈর্ষা ! সাংবাদিককের নেতা ও সংগঠকরাও এ থেকে রেহাই পাচ্ছেনা ! ভালো সংগঠক বা নেতা হলে আপনার পেছনেও লেগে যাবে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বি ঈর্ষাপরায়ন নেতা বা ব্যক্তি। আপনার বিরুদ্ধে কুৎসা রটাবে। কোন অনুষ্ঠানে অংশ নিলে ইচ্ছে করে আপনার নাম বা পদবী সে ভুল লিখবে। বুঝবেন, এটাও ঈর্ষা।

আপনি আপনার হাউস থেকেও হতে পারেন, এমন ঈর্ষার শিকার। হাউজের কারো বিশেষ চাহিদা পুরণ করতে পানেনি, দিতে পারেননি অন্যের মতো কিছু উপহারের নামে উপঢৌকন। খবর আছে আপনার। আপসি যতোই ভালো বা এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট করেন, আপনার রিপোর্ট ভালো নয়, দেরিতে দিয়েছেন,ফুটেজ ভালো সয়, আপনার ভয়েস খারাপ,রিপোর্টের সত্যতা নেই, সময় উপযোগী রির্পোট নয়, পক্ষ পাতিত্ব রিপোর্ট, এক ঘেয়েমি রিপোর্ট, ইত্যাদি ইত্যাদি নানান অভিযোগ বা অযুহাতে আপনাকে সিজার অর্থাৎ কাচি করার চেষ্টা চলবে। এতে অশচর্য হবার কিছু নেই।

সব পেশাতেই ইর্ষা আছে। তবে,সাংবাদিতায় ঈর্ষা বেশি। কারণ,একটাই সাংবাদিকরা নিজেদের ভাবে বুদ্ধিজীবী। সমাজের দর্পন। রাষ্ট্রীয় স্তম্ভ। প্রকৃতভাবেই তাদের মধ্যে বিবেকের দংশন কম। তাই,তারা বেশি ঈর্ষাপরায়ন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণা উঠে এসেছে, ঈর্ষা মানুষকে নানা ভাবে অশান্ত করে তোলে, কুড়ে কুড়ে খায়, স্ট্রেস তৈরি করে। এক কথায় ঈর্ষা মানুষকে ভয়াবহ অসুস্থ করে তোলে। আমরা এখন অন্যের সুখ দেখে হিংসায় অসুস্থ হয়ে পড়ি। তাই অন্যকে অশান্তিতে ফেলতে না পারলে নিজেরা শান্তি পাই না। অন্যকে কষ্ট দিয়েই এক ধরণের শান্তি বা তৃপ্তি আমরা লাভ করি। অন্যের ঘরে হট্টগোল লাগিয়ে নিজের ঘরে শান্তি চাই। আবার মিথ্যা কথা বলে, প্রতারণা করে, অবহেলা করে মানুষের বে-ইজ্জুত করে, মানুষের সম্পদ লুটপাট করে এক ধরণের শান্তি পেতে চাই।

মুঘল বাদশাহ শাহজাহানের উত্তরসূরি কে হবে তা নিয়ে তার সন্তানদের মধ্যে যে রক্তক্ষয়ী বিরোধ হয়েছিলো এবং তার করুণ পরিণতির পেছনেও রয়েছে এই ঈর্ষা। বড় ছেলে দারাশিকোর প্রতি অতিরিক্ত স্নেহ ও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণই তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেবকে হয়তো ঠেলে দিয়েছিলো ভাইদের প্রতি তার নিষ্ঠুরতা দিকে। যার পরিণতিতে সে পর পর হত্যা করেছিলো আপন ভাই সুজা, মুরাদ এবং দারাশিকো’কে। আসলে ঈর্ষা এত মারত্মক একটি দোষ যার সূক্ষ্ম উপস্থিতিও অনেক বড় ক্ষতি সাধন করতে পারে। ঈর্ষা মানুষের অত্মবিশ্বাস নষ্ট করে, আত্মসম্মান বোধকে ধ্বংস করে, জীবনের আনন্দকে মাটি করে দিতে পারে। সম্পর্ক নষ্ট করা থেকে শুরু করে জটিল রোগ-এমনকি ক্যান্সার সৃষ্টিরও কারণ হতে পারে। অথচ একটু চেষ্টা করলেই আপনি ইতিবাচক শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারেন।

নিজের যা নেই, অন্যের আছে তা পাওয়ার আকাঙ্খা থেকেই ঈর্ষার জন্ম । অস্বাভাবিক এবং অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া ঈর্ষা । কিন্তু, ঈর্ষা কেন হয়? মনোবিদ্যা বলছে, এক ধরনের অনুভূতিজনিত আঘাত থেকে মানুষ ঈর্ষা করতে শুরু করেন এবং তার মূলে থাকে নিজের কোনও খামতি বা দুর্বল দিক।

মানুষ মাত্রেই তার কিছু ভাল দিক থাকবে এবং কিছু খারাপ দিকও থাকবে। তারই মধ্যে বাসা বাঁধে এক বিশেষ অনুভূতি যার নাম ঈর্ষা। কিন্তু কেন?

মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে শব্দজনিত একটি কনফিউশন দূর করে নেওয়া প্রয়োজন। ইংরেজি ভাষায় জেলাসি এবং এনভি দু’টি ভিন্ন শব্দ। প্রথমটির অর্থ অন্যের যা আছে তা দেখে সেটি নিজের কেন নেই সেটি ভাবা এবং ওই জিনিসটি নিজের জন্য কামনা করা। অর্থাৎ এনভি ঘটে দু’জন মানুষের মধ্যে। কিন্তু জেলাসিতে দু’জন নয়, তিনজনের ভূমিকা রয়েছে। এই শব্দটি মূলত সম্পর্কেও ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ কেউ যখন ভাবেন যে তৃতীয় ব্যক্তি কেউ এসে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে তাঁর থেকে কেড়ে নেবেন, তখন সেই অনুভূতিটি হল জেলাসি।

কথ্য বাংলায় যখন ঈর্ষা শব্দটি ব্যবহার করা হয় তখন অনেক সময়েই সাইকোলজির এই দুই আলাদা টার্মিনোলজিকে এক করে ফেলা হয়। ‘এনভি’ শব্দটির সঠিক বাংলা হল পরশ্রীকাতরতা এবং জেলাসিকে বরং ঈর্ষা বলা যায়। জেলাসি হওয়ার কারণটা সোজাসাপ্টা আমার যা আছে তা যেন হারিয়ে না যায়।

কিন্তু ঈর্ষা কেন হয়? মনোবিদ্যা বলছে এক ধরনের অনুভূতিজনিত আঘাত থেকে মানুষ ঈর্ষা করতে শুরু করেন এবং তার মূলে থাকে নিজের কোনও খামতি বা দুর্বল দিক। অন্য কেউ ‘আমার চেয়ে ভাল’ এই ভাবনাই মানুষের মধ্যে ঈর্ষা তৈরি হওয়ার প্রাথমিক শর্ত।

ঈর্ষা তৈরি হতে আর একটি উপাদান খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং তা হল নিজের সম্পর্কে হীন মনোভাব। এই হীনমন্যতাই মানুষকে অন্যের সম্পদ, জীবনযাপন, শিক্ষাগত যোগ্যতা, কেরিয়ার, সামাজিক প্রতিষ্ঠা সবকিছু নিয়ে ঈর্ষা করতে শেখায়। এবং তাই ঈর্ষার কোনও শেষ নেই বরং ঈর্ষা জমতে জমতে বিরাট আকার ধারণ করে এবং মানুষকে ক্রমশ অপরাধের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়।

ঈর্ষান্বিত হয়ে আমরা প্রায়শই নকল সুখ, শাস্তি আর স্বাচ্ছন্দ্যের খোঁজে অস্থির হয়ে পড়ি। কিন্তু, নকল সুখের পিছনে যে খাঁটি যন্ত্রণার চেহারাটা রয়েছে এবং যা সহজে দেখা যায় না, তা উপলব্ধি করেছেন কি একবারও? অন্যের দিকে তাকিয়ে অন্যের নকল সুখ দেখে দেখে তো সময় নষ্ট করেছেন। উপলব্ধি করেছেন কি কখনো যে, তার অনেক দুঃখ রয়েছে, এমন কি আপনার চেয়েও তা অনেক দুঃখজনক। তারপরও কি ঐ সুখ চাইবেন?

অপরদিকে ঈর্ষা হচ্ছে- সে পেলো, আমি কেন পেলাম না? বা আমি পাবো, কিন্তু সে যেন না পায়। ঈর্ষার প্রকৃতিটা হচ্ছে সে কাউকে অংশীদার করতে চায় না। ঈর্ষা মানে অন্যের ভালো সহ্য করতে না পারা। আপনার চেয়ে একজন ব্যক্তি যখন একটু এগিয়ে আছে রেজাল্টের দিক থেকে বা চাকরিতে বা ভালো পাত্রের সাথে তার বিয়ে হয়েছে- এটিই আপনার প্রচন্ড মর্মবেদনার কারণ। তার কোনো আনন্দের সংবাদ শুনলে আপনার ভেতরে কষ্ট লাগে, তখনই বুঝতে হবে আপনি ঈর্ষায় ভুগছেন।

ক্ষোভ ও ঈর্ষা মনের শক্তির জট লাগায়। আর মানুষ শুধু দৈহিক শক্তিতে কাজ করে না, সাফল্যের অন্যতম বড় নিয়ামক হচ্ছে মানসিক শক্তি। এই শক্তিকে যে যত বেশি পরিমাণে ব্যবহার করতে পারবে সে তত এগিয়ে যাবে।
বোখারী শরিফে রয়েছে– ক্বালব বা মন ভালো থাকলে দেহ ভালো থাকে আর তা যখন খারাপ হয় সারা দেহ খারাপ হয়।

জীবনে সাফল্য লাভের সহজ পথ হচ্ছে,অন্যের হৃদয়কে জয় করে নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাদের সম্মিলিত শক্তি প্রয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করা। কিন্তু ঈর্ষাকারী কখনো অন্যের হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারে না। যাকে আপনি ঈর্ষা করবেন তার সাথে কখনো আপনি সুসম্পর্ক রক্ষা করতে পারবেন না। হয়তো তাকে আপনি বাস্তবে কিছু বলছেন না, কিন্তু অবচেতন ভাবেই তার সাথে আপনার একটা দূরত্ব তৈরি হবে। আপনার যত কাছের মানুষ হোক, তাকে দেখা মাত্রই আপনার মাঝে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হবে।

এছাড়া ক্ষোভ ও ঈর্ষা দুটোই স্রষ্টার অপছন্দনীয় বিষয়। মনের ভেতর এই নেতিবাচক আবেগ থাকলে ¤্রষ্টার রহমত থেকে বঞ্চিত হবেন। যুগে যুগে মনীষীরা তাই ক্ষোভ ঈর্ষা থেকে মুক্ত থাকার উপদেশ দিয়ে গেছেন।

ঈর্ষা করে নয় বরং যদি আপনার সহকর্মী সত্যিই আপনার চেয়ে দক্ষ হয় তাহলে আপনি তাঁর কাছ থেকে শেখার শক্তি আর সাহস অর্জন করুন, দেখবেন আপনার দক্ষতাও কেবল উন্নত হবে তাই নয়, বরং আপনার মধ্যে উদার মনের মানুষটাও জেগে উঠবে।

আপনি যদি সর্বদাই অন্যদের দিকে তাকিয়ে থাকেন তাহলে নিজের মধ্যে অজানা সব মহত্তর গুণাবলী আর ভাল দিকগুলো আপনি দেখতেই পাবেন না বা উপলব্ধিও করতে পারবে না। ফলে সহজেই আপনি হিংসা দ্বারা আক্রান্ত হবেন। আর এ জন্য আপনি নিজের ভালো দিকগুলোর ওপর নজর দিন এবং ক্রুটিগুলো সংশোধন করুন। আর এভাবে আপনি সহজেই হিংসা আর ঈর্ষামুক্ত দৃঢ় অথব শক্তিশালী মন গড়ে তুলতে পারেন। যা সহজেই অন্যদের সাথে শাস্তি ও সৌহার্দপূর্ণ আচরণে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।

তাই সাংবাদিকতার মতো একটি মর্যাদাশীল ও মহৎ পেশাকে টিকিয়ে রাখতে আসুন,আমরা ঐক্যবদ্ধ হই,অশুভ শক্তিকে চিহ্নিত করি। অনুপ্রেরণা যোগাই সৎ ও বস্তুুনিষ্ঠু সাংবাদিকতার।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।