নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার : জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমানো ২৬ বাংলাদেশী লিবিয়ায় খুন হওয়া বর্তমানে আলোচিত ঘটনার একটি। করোনাকালে অর্থনীতি যখন ধ্বংসের পথে মৃত্যুর মিছিল যখন হচ্ছে দীর্ঘায়িত ঠিক সে সময় লিবিয়ায় মানব পাচারকারীদের হাতে প্রাণ দিল ২৬জন আহত হলো আরও ১১জন। সত্যিকার অর্থে যা আমাদের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে এবং এসব পরিবারে চলছে শোকের মাতম। লিবিয়ার সংবাদ মাধ্যমে জানা যায় ২৬ বাংলাদেশীসহ ৩০ অভিবাসী শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করে মানব পাচারকারী চক্রের এক সদস্যের সহযোগী ও স্বজনরা। এইসব বাংলাদেশীসহ অভিবাসীদের মিজদা শহরের একটি জায়গায় টাকার জন্য জিম্মি করে রাখে মানবপাচারকারী চক্র।

এ নিয়ে এক পর্যায়ে ওই চক্রের সঙ্গে মারামারি হয় অভিবাসী শ্রমিকদের। এতে এক মানব পাচারকারী মারা যায়। তারই বদলা নিতে সেই মানব পাচারকারীর পরিবারের লোকজন এ হত্যাকান্ড ঘটায়। আমরা এদের হত্যাকান্ডকে সংখ্যা দিয়ে বিচার করছি কিন্তু বাস্তবতা হলো যে পরিবার থেকে কর্মক্ষম ব্যক্তিটি হারিয়েছে সে পরিবারটি আজ দিশেহারা। কারণ যে মারা গেছে সে ছিল পরিবারের কাছে পৃথিবী। বর্তমানে মানব পাচারকারী চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে বিদেশ গমনেচ্ছুরা। উত্তর আফ্রিকার ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণে অবস্থিত একটি বৃহৎ রাষ্ট্র লিবিয়া। যার জনসংখ্যা ৬৫ লক্ষের কাছাকাছি। বিশাল এ রাষ্ট্রটি ১৯৬৯ সালে মুহাম্মদ গাদ্দাফি দখল করে নেয়।

বর্তমানে ইউরোপে মানবপাচারের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এদেশের উপকূলীয় অঞ্চল গুলো। এ ঘটনার কিছুদিন আগেও ভূমধ্যসাগরে ভাসতে থাকা অভিবাসী প্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে। ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে নারী পাচারকারী চক্রও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশের মা বোনদের এমন জায়গায় পাঠানো হচ্ছে যে ক্ষেত্রে তারা ওই দেশে গিয়ে নরক যন্ত্রণা ভোগ করছে। এছাড়াও প্রতিনিয়ত ঘটছে ছোটখাট দুর্ঘটনা। এখন প্রশ্ন হলো কেন এবং কিভাবে ঘটছে এসব মানবপাচার ? আমাদের দেশের আয়ের একটা বিশাল অংশ আসে বিদেশী রেমিট্যান্স থেকে। বিদেশে যাওয়ার আসায় জমি বাড়ি বিক্রি ও ব্যাংক ঋণ করে এদেশের বেকার যুবক যুবতীরা।

এদের বেশির ভাগই অল্প শিক্ষিত অথবা উচ্চ শিক্ষিত বেকার। এদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে স্থানীয় কিছু প্রতারক চক্র তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়ার লোভে এসব অপরাধমূলক কাজে নিজেকে নিয়োগ করছে। অনেক ক্ষেত্রেই ভূয়া এজেন্সি ও বিভিন্ন চক্রের খপ্পরে পড়ে সর্বশান্ত হচ্ছে এসব খেটে খাওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষ। এছাড়াও চুক্তিমত কাজও পাচ্ছে না বিদেশ গিয়ে। শুধু তাই নয় এসব চক্র এতটাই শক্তিশালী যে এদের সাথে অন্যান্য দেশের লোকজন জড়িয়ে রয়েছে। কাউকে স্টুডেন্ট ভিসা অথবা টুরিস্ট ভিসা দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছে দালালরা। যার পরিনতি হচ্ছে জেল জরিমানা নয় মৃত্যু। যারা বিদেশে গিয়ে প্রতারিত হয়ে আসছে তাদের পারিবারিক জীবনে অর্থনৈতিকভাবে নেমে আসছে ঝড়।

এসব ঘটনা বেশ কিছু দিন আলোচনায় থাকলেও কোনো প্রকার প্রতিকার ছাড়াই ধামাচাপা পড়ে নিঃশেষ হয়ে যায় অসহায় পরিবারগুলোর কান্না।স্থানীয়ভাবে এসব দালালরা এতটাই প্রভাবশালী যে এদের বিচার চাইতে গেলেও হয়রানির শিকার হচ্ছে ভূক্তভোগী পরিবার। তারপর বিদেশে যাওয়ার জন্য নিঃস্ব হওয়ার পর আইনি সহায়তা পাওয়ার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন হয় সেই সক্ষমতা আর থাকে না পরিবারের নিকট। সবচেয়ে বড় কথা হলো দালালরা যেভাবে টাকা নিয়ে থাকে সেগুলির কোনো আইনগত দলিল কারো হাতেই থাকে না কারণ এসব লেনদেনের বেশির ভাগই হয়ে থাকে নগদে এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে।

এসব মানবপাচারকারীদের একতা ও ভ্রাতৃত্বের ধারণা সম্ভবত: তাদের অপরাধমূলক কাজের ক্ষেত্রে অন্যতম মূল কারণ। এজন্য পুলিশ ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষে এসব অপরাধীকে চিহ্নিত করা ও গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে বেশ সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় কারণ এরুপ অপরাধীদের গোষ্ঠীগুলো তাদের নিজস্ব বোঝাপড়ার মাধ্যমে কাজ করে থাকে। তবে অবশ্যই একে উপলদ্ধি করতে হবে যে সংগঠিত অপরাধের বিষয়গুলোকে অবশ্যই দমন করতে হবে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে। এই অপরাধের পিছনে দুই কিংবা আরো বেশি দেশের অপরাধীরা জড়িত থাকার কারনে একপক্ষকে আইনের আওতায় আনা গেলেও অন্যসব পক্ষ থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক নেওয়ার্ক যার মাধ্যমে একটা জালের মতো করে এসব অপরাধীদের ধরা যায়।

ইতোমধ্যে বিগত কয়েকদিনে মামলা হওয়ার পর বেশ কয়েকজন দালালকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। এমনকি একজন জাতীয় সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধেও মানবপাচারের অভিযোগ উঠায় কুয়েত সরকার তাকে গ্রেফতার করেছে। এদেরকে আইনের আওতায় এনে তাদের দালাল চক্রদের খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের মতো অতিরিক্ত জনসংখ্যার দেশের জন্য এখাতটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রেখেছে। এখন এখাতে যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে হুমকির মুখে চলে যেতে পারে আমাদের বিদেশী রেমিট্যান্স।

এ অবস্থা চলতে থাকলে এখাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে এদেশের জনগণ। তখন প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বে এস্থান দখল করে নিবে অন্য দেশ। তাই এই বাজার ধরে রাখার স্বার্থে সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে হতে হবে আরো সতর্ক। দেশে প্রচলিত মানবপাচার আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন সাজা ও সর্বনি¤œ ৫ বছরের জেল এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এই আইনের পরিবর্তন করে মৃত্যুদন্ডের বিধান করা জরুরি হয়ে পড়েছে। যেসব দেশে আমাদের দেশের লোকজন যাচ্ছে বা শ্রমবাজার রয়েছে সেসব দেশের দূতাবাস গুলোকে আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

যাহাতে যেকোনো বিপদের সময় আমাদের দেশের কর্মীরা সহায়তা পায়। মনে রাখেতে হবে এরা আমাদের এবং আমাদের অর্থনীতির চালিকা শক্তিতে বড় স্থান দখল করে আছে। তাই তাদের বিষয়গুলিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তবে এক্ষেত্রে কেবল মাত্র সরকার সচেতন হলেই এসব অপকর্ম রোধ করা সম্ভব হবে না। এসব বিষয়ে জনগণকে আরো সচেতন হতে হবে। বৈধ পথে এবং সরকার অনুমোদিত এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশ যেতে হবে। কোন প্রকার মিথ্যা প্রলোভনের ফাঁদে পা দেয়া যাবে না। আমাদের সচেতনতা এবং সরকারের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেই বন্ধ হতে পারে মানবপাচার।


লেখক :শিক্ষক ও গণমাধ্যমকমী।