চৌধুরী আবদুল হান্নান


পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ একটি অনুষ্ঠানে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশ্যে সম্প্রতি বলেছেন, অবৈধ অর্থ উপার্জন করতে চাইলে পুলিশের চাকরি ছাড়ুন, পুলিশ সদস্যরা কোনোভাবেই কোনো ধরণের দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন না।

পুলিশ প্রধানের দুর্নীতির বিরুদ্ধে এ অবস্হান আশা জাগানিয়া কিন্ত আমাদের ভরসার বড় অভাব কারণ আমাদের আলোগুলো জ্বলে উঠে মাঝ পথে নিভে যাওয়ার জন্য। দুর্নীতি করে বিত্তশালী হওয়া এখন আর কোনো লজ্জার বিষয় নয়।অর্থের আগমন যেভাবেই হোক, বিত্তবান লোক এখন সমাজের মাথা।আইন তার পক্ষে।

পরিস্থিতিটা এমন হয়েছে যে, ঘুষের বিরুদ্ধে যতই কঠোর হওয়া যাবে, ঘুষ ততই বৃদ্ধি পাবে।কারণ তাতে ভাগিদার বাড়ে,পরিমানও বেড়ে যায় । সম্প্রতি একটি দুর্নীতি মামলার শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন,কিছু লোক লেখাপড়া করে জনগণের টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য।এরা হোয়াইট কালার ক্রিমিনাল।

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কৌশলী যখন দেশের দুর্নীতির বিষয়ে এমন কথা বলেন, তখন দুর্নীতির সীমা পরিসীমা ব্যখ্যা করার দরকার হয় না।

আমাদের দেশটা আকারে ছোট হলেও দুর্নীতির দিক দিয়ে গোটা পৃথিবীতে একটি বড় যায়গা দখল করে আছে।
দেশের কোন প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিতে বেশি এগিয়ে তা নিয়ে বিতর্ক অর্থহীন।তবে এখানে পুলিশ প্রসঙ্গে আলোচনা করার প্রাসঙ্গিকতা আছে।

পুলিশ সম্পর্কে জন মানসে ধারণ ইতিবাচক নয়, তৃণমূলের সাধারণ মানুষের সাথে মূলত তাদের কাজ। চোর-ডাকাত-বাটপাড়দের ধর-পাকড় করা তাদের নিত্য কাজ, এখানে ঘুষের ব্যাপক লেনদেন হয় বলে মানুষের বিশ্বাস। ঘুষের কারবারটা রাখঢাক ছাড়াই চলে এবং তাৎক্ষণিকভাবে তা ব্যাপক প্রচার পায়, এটাই পুলিশের ভাবমূর্তি সংকটের প্রধান কারণ। তবে পুলিশে সংঘটিত দুর্নীতি পরমানের দিক থেকে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অতি নগন্য। কেবল স্বাস্হ্য খাতের দুর্নীতির সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে, পুলিশের ঘুষ-দুর্নীতি মোটেই উল্লেখ করার মতো নয়।

বর্তমানে ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে ক্ষমতাবান লোকেরা যে দুর্নীতি-অর্থপাচারের খেলায় মত্ত রয়েছে তার কোনো তুলনা নেই, দেশের অর্থ ভাল্ডার নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য এক মহোৎসবে নিয়োজিত রয়েছে তারা।

একটি সরকারি ব্যাংকের একজন পরিচালক যখন ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের সাথে জড়িত থাকেন,আর ৫ বছরেও তাকে আইনের জালে আটকানো যায় না,তখন অন্যান্য ছোট দুর্নীতির বিচার করার কতটুকু নৈতিকতা থাকে,সে প্রশ্ন থেকেই যায় ।রাঘব বোয়ালদের ছেড়ে দিয়ে চুনাপুটির বিচার করা শুভবার্তা দেয় না।

শত বছর পূর্বে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বলেছিলেন,” আমাদের আইনগুলো মাকড়সার জালের মতো , এর দ্বারা গরিব ও দুর্বলদের ধরে রাখা যায়। কিন্ত ধনী আর শক্তিমানেরা সহজেই তা ভেঙে বেরিয়ে যায় ।” যা আজও কত প্রাসংগিক !
দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশই কৃষিজীবী, একটা বড় অংশ দেশের ভিতরে ও বিদেশে নানা পেশায় শ্রমজীবী। তাদের ঘুষ-দুর্নীতির সাথে জড়িত হওয়ার সুযোগ নেই। বরং তারাই দেশের শরীরে অক্সিজেন সরবরাহকারী। তাদের বিরতিহীন অবদানের জন্যই বাংলাদেশ এখনও আফ্রিকার সোমালিয়া,কঙ্গো,সুদানের মতো অকার্যকর দেশের তালিকায় আসেনি এবং ভবিষ্যতেও এমন হওয়ার আশংকা নেই ।

দেশের জনসংখ্যার তুলনায় স্বল্প সংখ্যক লেখাপড়া জানা দুর্নীতিবাজদের হাতে ১৭ কোটি মানুষ আর কতকাল জিম্মি হয়ে থাকবে ? কোথাও তো থামতে হবে ! প্রতিটি প্রতিষ্ঠান প্রধান যদি নিজে সৎ হন আর সদিচ্ছা থাকে, তিনি তার প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি নিশ্চয়ই কমিয়ে আনতে পারেন। পুলিশের শীর্ষ নির্বাহীর এমন হুশিয়ারি কিছুটা হলেও পুলিশ বাহিনীর মধ্যে প্রভাব ফেলবে, তাতে সন্দেহ নেই।এবার যদি ড.বেনজীর আহমেদ দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে নজীর স্হাপনের সূচনা করতে পারেন, মানুষ আবার আশান্বিত হবে ।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার।