রণেশ মৈত্র


পাবনা শহরে যে বাসায় আমরা বাস করি সেই বাসায় আরও একটি ফ্যামিলি বাস করেন। সেই ফ্যামিলির একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটির আয়ের উৎস ছিল একটি পথি পার্শ্বস্থ ছোট্ট রেস্তোঁর চাকুরী। করোনার ধাক্কায় ২৬ মার্চ তারিখ থেকে (যেদিন থেকে সারা দেশে সাধারণ ছুটি এবং দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্য বিপণী, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি সব কিছু বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বন্ধ ঘোষণা করেন মালিক আরও অসংখ্য দোকান মালিকের মত। ফলে ব্যক্তিটির বেতন বন্ধ থাকে। এর উপর তাঁর শারীরিক কিছু সমস্যা দেখা দিলে বাসার সবারই করোনা টেষ্ট করে আমাদের সবারই নেগেটিভ হলেও তাঁর পজিটিভ রিপোর্ট আসে। 

এর ভিত্তিতে ৬ জুন তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আজ এই নিবন্ধ লেখাতক (২৩ জুন) তিনি হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন আছেন। যেদিন তাঁকে ভর্তি করা হলো সেদিনই অকস্মাৎ পুলিশ এসে পুরা বাড়ীটি ‘লক ডাউন’ করে দিয়ে যায়। তাতে অবশ্য আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কোন হেরফের হয় নি। কারণ আমরা ঐ মার্চ থেকেই আজতক গৃহবন্দী হয়ে রয়েছি। আদৌ বাইরে বেরুই না। বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, চোখে মুখে হাত না দেওয়া, বাড়ী-ঘর জীবাণু মুক্ত রাখা-এসব কিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।

একটু আগে পাবনা সদরের ইউ.এন.ও জয়নাল আবেদীন ফোন করে জানালেন, লক ডাউন করার পর ১৪ দিন অতিবাহিত হওয়াতে সিভিল সার্জনের মত অনুসারে আজই আনলক করে দেওয়া হবে। বেশ সুখবর। রোগী মোটামুটি ভালই আছেন হাসপাতালে। রবি সাহা নামক রোগীটির অবস্থা ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে-এটা আর একটি সুখবর। তাঁর করোনা স্যাম্পল ৫/৬ দিন আগে পুনরায় নিয়ে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট এখনও না আসায় রবি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাচ্ছে না। আশা করি রবি অপর একজন করোনাজয়ী হয়ে ফিরবেন।

কিন্তু এই আনন্দের খবর তো নেহায়েতই পাবনার দু’টি মাত্র পরিবারের। দুই শতাধিক রোগী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন পাবনা জেলায়-সারা দেশে লক্ষাধিক। অনুমান করি, কম বেশী সংক্রমিত সকল রোগীর পরিবারই এভাবে আটকে আছে। এর অর্থ দাঁড়ায় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ আজ পর্য্যন্ত বাংলাদেশের নানাস্থানে এক স্থবির জীবনযাত্রার শিকার হয়ে আটকা আছেন। স্বাস্থ্য বিধি মেনে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের আশংকায় আরও অগণিত পরিবার এভাবে স্থবির জীবনযাত্রার অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই।

আবার মৃত্যুর মিছিলও চলছে। গত ২০ জুন পর্য্যন্ত সরকারি হিসেবে ১,৫০২ জন করোনা সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। বেসরকারি নানা দেশী-বিদেশী মহল জানাচ্ছেন, বাংলাদেশে করোনার লক্ষ¥ণ নিয়ে মারা গেছেন আরও লক্ষাধিক রোগীর মৃত্যু ঘটেছে-যেহেতু তাঁদের স্যাম্পল নিয়ে টেষ্ট করা হয় নি তাই তাঁরা মৃত্যুর সরকারি তালিকায় স্থান পান নি।

ফলে, দেশের প্রতিটি পরিবারে গভীর আতংক বিরাজ করছে এবং তা আরও গভীরতর হয়ে উঠছে দিনে দিনে। সর্বাধিক বেদনার্ত হয় যখন প্রায় প্রতিদিনই একজন করে অতি আপনজন করোনার আঘাতে হারিয়ে যাওয়ার খবর আসে তখন ছুটে গিয়ে তাদের কাউকেই শেষ দেখাটা দেখতে যাওয়া যায় না। স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপার তো আছেই, তার উপরও রয়েছে যেন জীবনের ভয় যে ভয় রাষ্ট্রশক্তিকেও পায় নি বাঙালি জাতি।

তবে কি আবারও এক ধরণের পদধ্বনি? মিলবে না কিন্তু চেতনে অবচেতনে কখনও কখনও তেমনটাই যেন মনে হয়। পেছনে ফিরে একাত্তরের দিনগুলির কথা ভাবলে দেখা যায় সামগ্রিক স্বার্থকে বড় বলে ভাবলেও শত্রু আসার খবর পেলে অনেকে কাউকে না বলেই অজানা গন্তব্যে চলে যেতেন যেন এই গৃহত্যাগের খবরটি যেন কেউ জানতে না পারে।
আবার শত্রুর আক্রমণে কারও বাড়ীঘর আগুনে পুড়লে, লুটপাট হলে, নারী অপহৃত বা ধর্ষিত হলে বা হত্যাযজ্ঞ ঘটে গেলে ঐ বাড়ীর মানুষগুলি যতই আপন হোন না কেন-অনেকেই হয়তো ছুটে যাওয়ার সাহস পাওয়া যেত না। এ রকম আরও অনেক কথা বলা যাবে যা একাত্তর পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে প্রকাশিত গল্প, কবিতা, উপন্যাসে আমাদের সাহিত্যিক ও কবি সমাজ সুন্দরভাবে তুলে এনেছেন। যদি একতরফাভাবে যদি ভীতিগ্রস্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের কথা আদৌ না ভেবে লুকিয়ে তাকাই একমাত্র চিত্র একাত্তরে ছিল এবং ছিল অনেক বিপরীত ঘটনাও। সেগুলি বীরত্বের কাহিনী হিসেবে সাহিত্যে বিধৃত হয়েছে। এই দ্বান্দ্বিক ছবি একইভাবে আজ আমাদের সমাজে দৃশ্যমান?

তা আদৌ নয়। সব কিছুই তো ভিন্ন ধরণের। সেদিন আমরা আক্রান্ত হয়েছিলাম একটি শত্রু রাষ্ট্র দ্বারা। ঐ রাষ্ট্রের সমর্থনে দাঁড়িয়েছিল বিশ্বের দুই ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র। তাদের লড়াই ছিল ধর্ম বাঁচানোর নামে বাঙালি নিধন। তারা বেশ কিছু বাঙালি চাটুকারও গড়ে তুলেছিল নানা অঞ্চলে। তাদেরকেও অস্ত্র সজ্জিত করা হয়। তারা পথ চিনিয়ে দিতো মুক্তিকামী বাঙালির বাড়ীঘরে। যুবতী মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাক সেনাদেরকে উপহার দিয়ে আসতো তাদের যৌন লালসা মেটানোর উদ্দেশ্যে ইসলাম রক্ষার নামে বা খাঁটি মুসলমান পয়দা করানোর লক্ষ্যে, গ্রাম-শহরে হাজার হাজার নারী-পুরুষকে কোন মাঠে বা নদীতীরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করতো পাক-সেনারা। এভাবে তাদেরকে স্পষ্টভাবে চেনা যেত যে তারা বাঙালির শত্রু এবং বাঙালিরাও ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদেরকে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে এবং শেষ পর্য্যন্ত সাফল্য ছিনিয়ে আনতে দ্বিধা করেন নি।

তাই একাত্তরের শত্রুদেরকে চিনতে কারও সময় লাগে নি আদৌ। কিন্তু আজকের শত্রু তো শুধু বাংলাদেশের শত্রু নয়-বৈশ্বিক শত্রু নয়। গোটা বিশ্বকে, বিশ্বের সাদা-কালো, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, ধনী, নিধন অর্থাৎ দেশ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী, পুরুষ, শিশু, কিশোর, যুবক, প্রবীর, বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলকে নিষ্ঠুরভাবে করোনা ভাইরাস নির্দ্বিধায় সংক্রমণ করে চলেছে।

সারা বিশ্বে প্রায় প্রতিটি পরিবারে রোগী মৃত-এক আহাজারি। হাসপাতালগুলি ভর্তি ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বল্পতা। নেই কিটস, নেই টেষ্ট করার ল্যাব বা অন্যান্য বিজ্ঞানসম্মত কারিগরী ব্যবস্থা। অক্সিজেন, আই.সি.ইউ প্রভৃতিরও নিদারুন সংকট। অর্ধেকের বেশী রোগীর বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে বাধ্য হচ্ছেন।

এই ভাইরাসটি অদৃশ্য। এর সংক্রমনের কয়েকটি লক্ষণ সকলের জানা থাকলেও ঐ কোন প্রকার লক্ষণ প্রকাশ না পেলেও করোনা সংক্রমণ ঘটে এবং ঘটছে। তাই বহুক্ষেত্রে আবার মৃত্যুর পরে পরীক্ষা করে জানা যায়, রোগী করোনা আক্রান্ত।
তাই এ শত্রু অদৃশ্য, ভয়াবহ ও মারাত্মক। ছোঁয়াচে হওয়ায় এই রোগীকে হতে হয় মারাত্মক অসহায়ত্বের শিকার। স্বামীকে স্ত্রী, স্ত্রীকে স্বামী, সন্তানকে তাদের মা-বাবা, বাবা-মাকে তাদের সন্তান ও রোগী হলে ছুঁতে দূরের কথা-সে ঘরেই যাওয়া, রোগীর কোন জিনিষপত্রে হাত দেওয়া পর্য্যন্ত নিসিদ্ধ হওয়ায় যে মর্মান্তিক পরিবেশ সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলিতে রচিত হয় তা সহজেই অনুমেয়।

একাত্তরের শত্রুকে চিহ্নিত করা যেতো, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা যেত, সশস্ত্র যুদ্ধ করা যেত কারণ ঐ শত্রুরাই প্রথম অস্ত্র হাতে রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত বাঙালি জাতিকে আক্রমণ করেছিল।

সে আক্রমণ প্রতিরোধ করা গেল ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে। ভিয়েতনামীরা জিতেছেন বছরের পর বছর ধরে মূলত: গেরিলা যুদ্ধে অজস্র প্রাণের বিনিময়ে। এইসব জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম ছিল পরিচিত দেশী বিদেশী শত্রুর বিরুদ্ধে। একের সাথে অপরের নৈকট্য, সামাজিক ঐক্য ও পারস্পারিক সাহায্য সহযোগিতাই সেদিনের সাফল্যের মূলে। এতে বাঙালি সেদিন শুধুমাত্র ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তাই নয় ঐ ঘোর দুর্দিনের মধ্যেও বাঙালি সংস্কৃতি ও মমত্ববোধকে উজ্জীবিত করেছিল।
আর আজ? নৈকট্য নয় দূরত্ব।

ঐক্যবদ্ধ নয় ব্যক্তিগত প্রচেষ্টাই হলো সাফল্যের মাপকাঠি। এই নৈকট্যহীনতা, এই পারস্পারিক ব্যবধান-তা-ও আবার অনির্দিষ্টকাল ধরে মানুষকে সহ্য করার ক্ষমতা হারাতে উচ্ছৃংখল হতে, নিয়ম-কানুন না মানতে যেন সকলকে উদ্বুদ্ধ করছে প্রতিদিন, প্রতি মুহুর্তে, প্রতি দেশে। এতে কি শত-সহশ্র বছর ধরে গড়ে তোলা সভ্যতা-সংস্কৃতি মানুষ বিস্মৃত হবে? নতুন অপর একটা গড়ে উঠবে? প্রশ্নটা মনকে আলোড়িত করে। করে আরও এ কারণে সাবধানতা মানা, না-মানা উভয় ধরণের মানুষই সংক্রমিত হচ্ছে এবং মৃত্যুর শীতল গহ্বরে ঢলে পড়ছেন-আত্মীয়-বন্ধু ও স্বজনদেরকে নিষেধ করা হচ্ছে হাসপাতালে রোগীতে বা তার মৃত্যুর পরে মৃতদেহকে চোখের দেখাটুকু দেখতেও। এমনই অস্বাভাবিক ব্যাপার যে, দূরদেশে বা দূরবর্তী কোন শহরে বা গ্রামে নিকটজনরা কেউ কেউ দেখতে আসতে চানও-তার জন্যে অপেক্ষা করা হচ্ছে না মৃতদেহ সৎকার। কদাপি কেউই আমরা এমন ভয়াবহ এবং অজানা এক অমানবিক পরিস্থিতির শিকার হই নি।

কোনক্রমেই কমে আসছে না করোনায় সংক্রমিতদের সংখ্যা বা ছোট হয়ে আসছে না বরং প্রতিদিনই বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হয়ে উঠছে শবের মিছিল। এ ভয়াবহ একাত্তরকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে এবং আহ্বান জানাচ্ছে একাত্তরের মত জাতীয় ঐক্য নয় নতুন ধরণের আন্তর্জাতিক ঐক্য এই ভাইরাসকে ধীরে ধীরে পরাজিত করতে। মানুষ তা অবশ্যই করতে পারবে-হতে পারবে সফলও বিজ্ঞানের জয়যাত্রার এই যুগে। তবে সবাই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে নিয়ম মানতে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে, একজন থেকে অপরজনের ছোঁয়া এড়িয়ে চলতে ঠিক ততদিন পর্য্যন্ত যতদিন না বিজয় অর্জিত হয়।

লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।