আবীর আহাদ


মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ বাঙালির রক্ত এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সীমাহীন শৌর্য বীর্য ত্যাগ ও বীরত্বে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ । স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের পাদপীঠে দাঁড়িয়ে আমরা দিব্য চোখে দেখতে ও হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারছি যে, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ক্ষমতা ও অর্থলিল্পার কারণে তাদেরই হাত ধরে দেশের বুকে দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াগোষ্ঠীর পাশাপাশি স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক অপশক্তির একটা দানবীয় উত্থান ঘটেছে ! বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধ্বজাধারী বলে যারা নিজেদের জাহির করে থাকে, তাদের হাতেও এ-দু'টি অপশক্তি নানান পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে । সুতরাং এ-দু'টি অপশক্তির উত্থানের সাথে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষের রাজনৈতিক শক্তি সমানভাবে জড়িত । বঙ্গবন্ধুর তিরোধানের পর থেকে অদ্যাবধি যারাই দেশ শাসনের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সেই সামরিক বাহিনী, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ, বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী জোটের অন্তরালে অন্যান্য স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধ ইসলামী রাজনৈতিক গোষ্ঠীসহ হেফাজতে ইসলামের মতো আইএস-তালিবানী চেতনার ধর্মীয় সংগঠনগুলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মধ্যে থেকে পরিপুষ্ট হয়ে উঠেছে । এখন তারা নিজেরাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখছে ! ইতোমধ্যে হেজাফতী আমীরকে তারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি করার দু:সাহসিক দাবিও করে বসেছে !

এসব স্বাধীনতাবিরোধী ইসলামী সংগঠন তাদের সমর্থিত রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় ধর্মের নামে সারা দেশব্যাপী আরবী ভাষার নানান কিংভূতকিমাকার ইসলামী সংগঠন, ইসলামী এনজিও, ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী কিণ্ডারগার্টেন, ইসলামী স্কুল, ইসলামী মাদ্রাসা, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী ইন্সিওরেন্স, ইসলামী হাসপাতাল, ইসলামী এতিমখানা, ইসলামী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলেছে । তাদের এসব কিছুর উদ্দেশ্য কিন্তু ইসলাম বা ধর্ম শিক্ষা, প্রচার ও প্রসার নয় ।

তাদের মূল লক্ষ্য, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ তথা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নির্যাস জাতীয় চার মূলনীতি গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা, জাতির পিতা, মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতিকে ইসলামবিরোধী কুফরি মতবাদ বলে আখ্যায়িত করা । এ-লক্ষ্যে তারা মসজিদ, ধর্মীয় জলসা, ইউ টিউব, ফেসবুকসহ নানান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে প্রকাশ্যভাবে ব্যবস্থার করে চলেছে । কিন্তু দু:খজনক সত্য এই যে, এসব ব্যাপারে কোনো সরকার ও রাজনৈতিক দলের কোনো মাথাব্যথা নেই । মনে হয়, অতীতের মতো বর্তমান সরকারও এসব ধর্মীয় গোষ্ঠীর সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে চায় । আদর্শ, চেতনা ও জনকল্যাণ নয়-----রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও লুটপাটের স্বার্থে ক্ষমতালোভীদের যেকোনো কারো সমর্থন নিতে কোনোই আপত্তি নেই !

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকার । রাষ্ট্রীয় আদর্শ, রাজনৈতিক দর্শন, প্রশাসন পরিচালন, দেশের আর্থসামাজিক সাংস্কৃতিক জীবন ব্যবস্থা, জনগণের মনোজগতে নৈতিকতা ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা নির্মাণ তথা জাতীয় চেতনার বেদীমূলে যেখানে প্রবিষ্ট করা উচিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ-----যাতে গোটা জাতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশপ্রেমিক অসাম্প্রদায়িক হয়ে গড়ে ওঠে । সে-লক্ষ্যে প্রতিটি ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় শহরে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে তোলা উচিত ছিলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাজাত বিভিন্ন শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, ক্লাব, সঙ্গীতসহ নানান প্রতিষ্ঠান-----যাতে আমাদের নতুন নতুন প্রজন্ম মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনায় উজ্জীবিত হতে থাকে ।

কিন্তু আমরা কী দেখতে পাচ্ছি ? স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক সরকারগুলো অতীতে যা করেনি, করতে সাহস পায়নি, সেকাজগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আওয়ামী লীগ সরকার নির্দ্বিধায় করে যাচ্ছে ! তারা হেফাজতে ইসলামের সাথে কী এক গাটছড়া বেঁধে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা কারিকুলামে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের মনোজগতে সাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটে এমনসব লেখনী সন্নিবেশিত করেছে, বিশেষ করে প্রখ্যাত হিন্দু ধর্মীয় লেখকদের লেখনি বাদ দেয়া হয়েছে ! অর্থাত দেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ থেকে সরিয়ে এনে মুসলমানিত্বের বীজ বপন করা হচ্ছে । অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানসহ দাওরায়ে হাদিসকে বিশ্ববিদ্যালয় মানের সনদ দেয়া হয়েছে যা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার দেয়নি !

আর সবচেয়ে ভয়াবহ যে প্রকল্পটি আওয়ামী লীগ সরকার হাতে নিয়েছে সেটি হলো, প্রতিটি ইউনিয়ন হয়ে উপজেলা পর্যায়ে বিশাল ব্যয়বহুল দৃষ্টিনন্দন মসজিদ প্রকল্প-----যেখানে থাকবে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার আয়োজন । আসলে এখানে তো কোনো ইসলামী শিক্ষা হবে না, হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিনাশী শিক্ষা কারিক্রম । রাজাকার তৈরির আদর্শিক প্রতিষ্ঠান । ধর্মের আবরণে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে যে কিংভূতকিমাকার শিক্ষা নিয়ে পর্যায়ক্রমে শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে আসবে, তারা মনেপ্রাণে আলবদর ও রাজাকার হিসেবেই গড়ে উঠবে-----যাদের মূল লক্ষ্য হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উৎখাত । এভাবেই ধর্মের নামে তারা দেশে তথাকথিত ইসলামী (তালেবানী-আইএস) জঙ্গিবাদী বিপ্লব সংঘটিত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে ।

অনেকে মনে করেন যে, ক্ষমতার স্বার্থে আওয়ামী লীগ যেমন স্বাধীনতাবিরোধী হেফাজত, জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামী দলগুলোকে ব্যবহার করছে, তেমনি এসব ইসলামী দলগুলোও ভবিষ্যত ইসলামী বিপ্লব ও ক্ষমতার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করছে ! যেমন তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগসহ এর অঙ্গ সংগঠনের সব কমিটিতে এখন জামায়াত শিবির রাজাকার, ফ্রিডমপার্টি বিএনপি জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য স্বাধীনতাবিরোধী দলের সমর্থক ও সমাজের অপরাধীচক্র বিপুল অর্থের বিনিময়ে বড়ো বড়ো পদ দখল করে নিয়েছে । জেলা, কেন্দ্রীয় ও উপদেষ্টা কমিটির দিকে দৃষ্টি দিলেও দেখা যাবে সেখানে বড়ো বড়ো পদে কারা বসে আছে ! এটাই দু:খজনক যে, এসব অপকর্ম সংঘটিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বর্তমান আওয়ামী লীগেরই আদর্শহীন, সুবিধাবাদী, অপরিপক্ক ও অপরিণামদর্শি অপরাজনীতির ফলশ্রুতিতে !

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।