গোপাল অধিকারী


শিক্ষাই জাতীর মেরুদন্ড। যে জাতি যত শিক্ষিত, সেই জাতি তত উন্নত। তাই শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। বর্তমান সরকারও শিক্ষাবান্ধব বলেই সমাদৃত। সরকারের সেই লক্ষ্য বা পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করতে কাজ করছে কিনডারগার্টেন বা কেজি স্কুলগুলো। আজকের যে শিক্ষার্থী সে আগামীর সম্পদ বা সম্বল। এই শিক্ষার্থীদের মধ্যেই কেউ হবে চিকিৎসক, কেউ শিক্ষক আবার কেউ হবে রাষ্ট্রনায়ক। তাইতো বলা হয় শিক্ষক জাতি গঠনের কারিগর। একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কারিগর ছাড়া যেমন একটি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে যেতে পারে না ঠিক তেমনি শিক্ষকদের ছাড়াও একটি সুন্দর জাতি গঠনের পথ সুগম হতে পারে না। তাই বর্তমান সরকারের সময়ে শিক্ষকরা রয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান ও সম্মানীর আসনে। এখানে সর্বোচ্চ সম্মানী বলতে পূর্বের সকল সম্মানীর থেকে বেশি বলতে চেয়েছি।

তবে বড়ই দুঃসময়ে রয়েছে কিন্ডারগার্টেনগুলোর শিক্ষকরা। স্বাভাবিক সময়েই এই বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকমন্ডলী ও কর্মচারীগণ কোন রকমে জীবিকা নির্বাহ করে চলে তারপর এই করোনাকালীন সময়ে একদিকে ভবনভাড়া অন্যদিক প্রাইভেট বন্ধ করে নিরব বসে থাকা। সবকিছু মিলিয়ে তাদের বড়ই দুঃসময় চলছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি স্থানে শিক্ষকদের আত্মহত্যার সংবাদও চোখে পরেছে। আমার জানা মতে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর বেশিরভাগ শিক্ষক জীবিকা নির্বাহ করে প্রাইভেট পড়িয়ে। অনেকে আছে সেই আয়েও চলে না জীবন। কোন রকম সম্মানের সাথে বসবাস করতে চালিয়ে যান পেশাটি। কারণ প্রাপ্তির জায়গা একটাই সম্মানের সাথে বেঁচে থাকা। জগতে এখনও এমন মানুষ আছে যারা শুধু সম্মানের জন্য বেঁচে আছে। যে কারণে টিকে আছে শিক্ষাব্যবস্থা।

বাংলাদেশের জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ এইভাবেই জীবন-যাপন করে বলে আমার মনে হয়। বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। ফলে বেকার সমস্যা একটি বড় সমস্যা বলা যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, দেশে এখন উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ১৪ লাখের বেশি। গবেষণায় দেখানো হয়েছে, শিক্ষিতদের এক-তৃতীয়াংশই বেকার। বিআইডিএসের গবেষণা অনুযায়ী, সার্বিকভাবে শিক্ষিতদের মধ্যে ৩৩ শতাংশের বেশি বেকার। আর এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যাঁরা প্রথম শ্রেণি পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে বেকারত্ব সাড়ে ১৯ থেকে সাড়ে ৩৪ শতাংশ। বিশেষ করে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্তদের মধ্যে ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশই বেকার।

স্নাতক পর্যায়ে এমন মেধাবীদের বেকারত্বের হার প্রায় ২৮ শতাংশ। আর্ন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী, কাজ প্রত্যাশীদের মধ্যে সপ্তাহে ন্যূনতম এক ঘণ্টা মজুরির বিনিময়ে কাজের সুযোগ না পেলে বেকার হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশে এমন বেকার ২৭ লাখ। এই বেকারসংখ্যার অনেকেই কাজ করছে একজন কেজিস্কুলের শিক্ষক হিসেবে। তারা বিপথে যায় নাই, তারা অন্যায় কাজটা করে নাই। আমার মনে হয় বেকারত্ব্রে বৃদ্ধির কারণেই সমাজে বেড়ে যায় অপরাধ। ঝড়ে যায় অসংখ্য প্রাণ। বেড়ে যায় সন্ত্রাস ও মাদকের ছোবল। এমনই শিক্ষিত অনেক বেকার জীবন পাড়ি দিচ্ছে এই মহান পেশায়।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের সভাপতি ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেছেন, ‘করোনার ক্রান্তিলগ্নে প্রায় ৬০ হাজার প্রতিষ্ঠান সাথে সংশ্লিষ্ট ২০ লাখ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিবার মানবেতন জীবনযাপন করছে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমরা কোনো টিউশন ফি আদায় করতে পারিনি। তাই শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি।’কিন্ডারগার্টেন জাতীয় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই ভাড়াবাড়িতে পরিচালিত হয় (৯৯ শতাংশ) কিংবা একটু সচ্ছল অথচ বেকার কোনো ছেলে বা মেয়ে নিজের বাসার একটি রুমে হয়তো এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান চালু করেন। করোনাকালীন বন্ধেও প্রতিষ্ঠানগুলোর বাড়িভাড়া ঠিকই দিতে হয় যদিও শিক্ষার্থী বেতন নেই এই কয় মাস। অন্যান্য বিলও প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাণিজ্যিক হারে পরিশোধ করতে হয় যা এখনও অব্যাহত আছে। এমতাবস্থায় দিশেহারা জাতী গঠনেরএই কারিগরগুলো।

সংবাদপত্রে দেখেছি এই সকল স্কুলের প্রণোদনা বিষয়ে এই আবেদন তারা সরকারের কাছে করেছে। একজন রাষ্ট্রের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি এই সংকটময় সময়ে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে সরকারের দাড়ানো উচিত। কারণ এই প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান গুলো শেখ হাসিনার প্রতিষ্ঠান। সরকারি স্কুলের ন্যায় এই কেজি স্কুলগুলোও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকেই শেখায় ও মান্য করে। আমরা দেখেছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর প্রিয় শিক্ষক আনিসুজ্জামানকে শ্রদ্ধা করে লাল গালিচা ছেড়ে দিছেন। আমার বিশ্বাস তিনি শিক্ষককে মূল্যায়ন করতে জানেন। জানেন কিভাবে একটি জাতিকে এগিয়ে নিতে হয়।

শিক্ষকরা দেশপ্রেম শেখায়, শিক্ষকরা শেখায় নীতি-নৈতিকতা । বেকারত্ব কমাতে, শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নতির লক্ষ্যে সরকারি প্রণোদনা বিশেষ প্রয়োজন বলেই আমার মনে হয়। কারণ এই সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনি এমনি সৃষ্টি হয় নি। যুগের সাথে শিক্ষাব্যবস্থার তাল মেলাতে, সরকারি স্কুলগুলোতে শিক্ষার কৌশলগত সমস্যার কারণেই কেজি স্কুলে চলমান প্রক্রিয়া। তাছাড়া সরকার যেভাবে ঘরে ঘরে শিক্ষা বিলিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে তাতে বেসরকারি স্কুল ছাড়া মানসম্মত শিক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেই জায়গা বা শিক্ষক কোনটাই নেই। সবমিলিয়ে কিন্ডারগার্টেনগুলো সরকারি ইশতেহার বাস্তবায়নে ভ’মিকা রাখছে বলেই আমার মনে হয়।

সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের অবশ্যই দৃষ্টিপাত এই সেক্টরে দেওয়া উচিত। বাঁচানো উচিত বেসরকারি স্কুল ও স্বল্প পারিশ্রমিকে দেশের জন্য কাজ করা এই মানষগুলো, তাদের সন্তান, পরিবার-পরিজনদের। এই বেসরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষকমন্ডলী ও কর্মচারী তারা বাংলাদেশের বৈধ নাগরিক। তাদের দেশের প্রতি দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকার সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত। তাঁরা দেশের প্রচলিত আইন মেনে চলে, তারাও সরকারকে নিয়মিত কর দেয়। সুতরাং নাগরিকতার বৈধ জায়গা থেকে তাদের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা কোন ভাবেই এড়াতে পারে না।

তাছাড়া বিদ্যমান বেকার সমস্যায় এই সেক্টর ধ্বংস হলে সেই বেকার সমস্যার দায়ভার সরকার কোনভাবেই এড়াতে পারবে না। কারণ প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা থেকে চাকর সকলের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা রয়েছে। ঠিক যেমন আইন প্রণয়ন ও মান্য করার ক্ষেত্রে আমরা দেখি। ইতিমধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে সরকার এই বেসরকারি শিক্ষকদের প্রণোদনা দিবেন বলে জানতে পারছি। সরকারের সেই সিদ্ধান্তকে আমি সাধুবাদ জানাই সেই সাথে জাতি গঠনের এই কারিগরদের পরিবার-পরিজনদের পাশে থাকার নিবেদন করছি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।