রণেশ মৈত্র


আওয়ামী লীগ ১৯৪৯ এ জন্ম নিয়ে ২০২০ সালের ২৩ জুন একাত্তরে পদার্পন করেছে। উত্থান, পতন, সাফল্য-ব্যর্থতা সবই রয়েছে আওয়ামী লীগের এই সুদীর্ঘপথ পরিক্রমায়। সব দলেরই, এমন কি ব্যক্তিরও জীবনে ভুল ভ্রান্তি, উত্থান-পতন, সাফল্য-ব্যর্থতা থেকে থাকে। তবে দেখার বিষয় দলটি বা ব্যক্তিটি তার ভুল-ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নেয় কিনা-শিক্ষা নিয়ে নিজেকে সংশোধিত হয় কি কিনা। এই নিবন্ধে অবশ্য এই বিষয়টি আলোচনার মুখ্য বিষয় নয়। বরং সচেষ্ট থাকবো দেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতনে দলটির ভূমিকা নিয়ে জাতীয় স্বার্থের নিরিখে।

২৩ জুনের বেশীরভাগ জাতীয় সংবাদপত্রগুলি স্বভাবত:ই প্রথম পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী দিবসের ছবি ছেপেওেছ। একটি প্রাচীন পত্রিকায় দেখলাম চার নেতার ছবিসহ প্রথম পৃষ্ঠায় খবরটি ছাপতে। আমি অবাক বিস্ময়ে ছবিগুলি এবং তা যেভাবে সাজানো হয়েছে তা লক্ষ্য করলাম। বিস্ময়ে এ কারণে, এভাবে সাজানোর ফলে শুধুমাত্র ইতিহাসের বিকৃতিই ঘটে নি-ইতিহাসের সঠিক প্রতিফলনও নয়-যদিও পত্রিকাটির লক্ষ্য সম্ভবত: ছিল ইতিহাসের সঠিক উপস্থাপন। বিষয়টি পরে খোলাসা করবো।

আওয়ামী লীগ আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে প্রতম আত্মপ্রকাশ করে ১৯৪০ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খানের নেতৃত্বে। ঢাকার রোজ গার্ডেনে অনুষ্ঠিত সেদিনের কর্মী সম্মেলনে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবর রহমানকে যুগ্ম সম্পাদক করে দলটির প্রথম কেন্দ্রীয় কার্য্য নির্বাহী কমিটি গঠিত হয়। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার কিছুকাল পর শামসুল হক অকাল মৃত্যু বরণ করেন। অত:পর যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক পদে উন্নীত করা হয়।

আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্মকালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী পাকিস্তানে ছিলেন না। ছিলেন ভারতে। পাকিস্তানে আসেন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের কয়েক বছরপর। তখন তিনি দলের কার্য্য নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে কো-অষ্টেড হন এবং তাঁকে বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানে দলটি গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীত্বের পদে (একবার প্রদানমন্ত্রী) আসীন হওয়া সত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানের কোন অঞ্চলে তা গড়ে উঠতে সক্ষম হন নি। দলীয়ভাবে কোন পদে কখনও অধিষ্ঠিত না হলেও তিনি আজীবন আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে বরিত ছিলেন, ছিলেন বিতর্কিতও। চুয়ান্ন সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে গঠিত যুক্তফ্রন্টের তিন নেতার অন্যতম ছিলেন তিনি।উল্লেখ্য, হক-ভাসানী-সোহরাওয়াদীর নেতৃত্বে ঐ যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল ক্ষমতাসীন লীগকেপরাজিত করার লক্ষ্যে।

অপর দিকে শেখ মুজিবর রহমান তাঁর মুরুব্বি মওলানা ভাষানী সারা পূর্ব বাংলা চষে বেড়ালেন আওয়ামী মুসলিম লীগ সর্বত্র গড়ে তুলতে ও মানুষকে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ও গণতন্ত্রের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে। এই দুই নেতাকে প্রথম যুগে অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকে বারংবার বিনা বিচারে জেলে আটক করা হয়েছে কিন্তু দমানো যায় নি।

বেরিয়েই তাঁরা আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন সে আন্দোলন গড়ে তুলেছে তৎকালীন মুসলিম ছাত্র লীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনেবাংলার জনমত অত্যন্ত সঠিকভাবে প্রতিফলিত হলো। আর এই নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও যুক্তফ্রন্টের অপরাপর পরীক্ষা দলের তুলনায় বেশী আসনে জয়যুক্ত হওয়ায় দলের বিস্তার লাভে অনুকূল পরিবেশ রচিত হয়।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিষ্ট পার্টি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বে-আইনী ঘোষিত হওয়ায় তারা যুক্তফ্রন্টকে সমর্থন জানিয়ে তাদের গোপনে অবস্থানরত কর্মীদেরকেও যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীদেরকে, বিশেষ করে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রার্থীদেরকে সমর্থন দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ কারনে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কর্মীরাও সারা দেশে ঐ পরামর্শ মোতাবেক কাজ করেছিল জীবন মরণ পণ করে। এ ছাড়াও গোপনে কমিউনিষ্ট পার্টি ও আওয়ামী লীগ নেতারা, বিশেষ করে মওলানা ভাসানী ও খেশ মুজিবর রহমান বৈঠকে মিলিত হয়ে দেশের পরিস্থিতি ও করণীয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করো না। এভাবেকিছু কিছু করে আওয়ামী লীগের উপর বাম রাজনীতির প্রবাব পড়ে।

পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে দেশে সামরিক শাসন জারী হয় মূলত: পূর্ব বাংলার গণ-আন্দোলন, তার নির্বাচনী ফলাফল নস্যাতৎ করে অগণতান্ত্রিক শাসন চাপিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে। আওয়ামী লীগের সাথে শেরে বাংলার কৃষক শ্রমিক পার্টির কোন্দলের সুযোগ নিয়ে সামরিক শাসন চাপানো হয়। কাজটি হয় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ইঙ্গিতে।

ব্যাপকভাবে গ্রেফতার হলেন আওয়ামী লীগ, গোপন কমিউনিস্ট পার্টির এবং ছাত্র লীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা। সরকারের এই দমন নীতি সরকারকেই অজনপ্রি করে তোলে। ১৯৬২ সালে প্রথম ঐক্যবদ্ধ ছাত্র সমাজ ঢাকয় সামরিক শাসন বাতিল, রাজবন্দীদের মুক্তি ও নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার দাবীতে আন্দোলন শুরু করে।

ধীরে ধীরে, গণ আন্দোলনের চাপে আওয়ামী লীগ, কমিউনিষ্ট পার্টি এবং ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীরা মুক্তি পেতে থাকেন।
এবারে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দিকে নজর দেওয়া যাক।

১৯৫৫ সালে অনুষ্ঠিত দলীয় কাউন্সিল সভায় আওয়ামী লীগ তার নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি তুলে দিয়ে অসাম্প্রদায়িক দলে পরিণত হয়। এই কাউন্সিলে পুনরায় মওলানা ভাষানীকে সভাপতি ও শেখ মুজিবর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক পদে পুননির্বাচতি করা হয়।

ফলে দলে ক্রমান্বয়ে প্রগতিশীলতার ছাপ স্পষ্ট হতে থাকে। সকল ধর্ম নিরপেক্ষ শক্তিগুলির সাথে, কমিউনিস্ট পার্টিসহ, সম্বর্ক নিকটতম হতে থাকে। আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িকতা বিরোধীই মুধু নয়, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগঠন হিসেবেও রূপ নিতে থাকে প্রদানত: মওলানা ভাসানী ও অপরাপর বাম ধারার আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্যোগে। এঁদের মধ্যে শেখ মুজিবর রাহমান, তাউদ্দিন আহমেদ, বেগম সেলিনা বানু, অলি আহাদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালেই তাঁরা “পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবীতে যুক্ত বিবৃতি প্রকাশ করেন। এগুলি নিঃসন্দেহে ক্রমান্বয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনা বিকাশের প্রমাণ বহন করে।

কিন্তু হঠাৎ করেই যখন পাশ্চাত্যের অনুসারী আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী পশ্চিম পাকস্তিানের প্রতিক্রিয়াশীল নেতাদের একাংশের সাথে আঁতাত করে কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রীত্বগ্রহণ করেন তখন তাঁর বিদেশ নীতিতে সাম্রাজ্যবাদের কাছে আত্মীয় সমর্পন করায় ব্যাপারটি আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল অংশের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি করে। কেন্দ্রে তখন আওয়ামী লীগের সাংসদ ছিলেন মাত্র ১২ জন। সোহরাওয়ার্দী পূর্ব বাংরার মানুষের মধ্যেও ক্ষোভের সৃষ্টি করে বলে ফেললেন। পূর্ব পাকিস্তানশতকরা ৮০ ভাগ স্বায়ত্ত্বশাসন পেয়ে গেছে যদিও পাকিস্তানের সংবিধানে এ জাতীয় আদৌ কোন সংশোধনী উত্থাপন বা অনুমোদন করা হয় নি।

পূর্ব বাংলার আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দআওয়ামী লীগের বিগত কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, জোট নিরপেক্ষতা ও পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বাপ ও মাসনের প্রতি নিষ্ঠাশীল থাকার জন্য প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রতি আহ্বান জানান।

কিন্তু সে আহ্বানের প্রতি কোন প্রকার সাড়া দেওয়া দূরের কথা, তিনি পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, সিয়াটো, সেন্টো চুক্তি এবং গ্রীক ইউনিট প্রথা প্রবর্তন করে সংখ্যালঘিষ্ট পশ্চিম পাকিস্তান ও সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সকল ক্ষেত্রে সংখ্যা-সাম্য ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।

এই পর্য্যায়ে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানী কাগমারীতে দলের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করেন। তিন দিন ব্যাপী এই কাউন্সিল অধিবেশনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদীও তাঁর অনুসারীদের সহ অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি তুমুল প্রতিবাদকে অগ্রাহ্যকরে সাম্রাজ্যবাদ ঘেঁষা পররাষ্ট্র নীতি ও এক ইউনিটের (পূর্ব পাকিস্তান ও পাকিস্তানের প্রদেশ সমূহের স্বায়ত্বশাসন বিরোধী ব্যবস্থা) প্রতি সমর্থন অভ্যাহত রাখলে কাউন্সিলে ভোটাভূটির মাধ্যমে দলের পূর্বতন নীতির প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করে কাউন্সিলে প্রায় একতরফা বোটাধিক্যে প্রস্তাব গৃহীত হলে নিজের সমর্থকদের নিয়ে শহীদ সোহরাওয়াদী কাগমারী ত্যাগ করে ঢাকা চলে যান এবং কিছুদিনের মধ্যেই ঢাকায় পাল্টা কাউন্সিল অধিবেশন ডেকে তাঁর গৃহীত নীতি সমূহের প্রতি দলের পক্ষ থেকে সমর্থন ঘোষণা করেন।

লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।