রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার দেবহাটার শিমুলিয়া গ্রামের ইজিবাইক চালক মনিরুল হত্যা মামলায়  বৃৃহষ্পতিবার আদালতে নিহতের স্ত্রী রাবেয়া ও তার প্রেমিক সাঈদুর রহমান রাজু’র ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির আংশিক ভিন্নতা থাকায় এক হত্যাকারি রয়ে গেছেন শরা ছোঁয়ার বাইরে। ফলে ছিনতাই হওয়া ইজিবাইক ও নিহতের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি  নয় দিনেও উদ্ধার করা যায়নি।

সাতক্ষীরার আমলী আদালত - ৭ এর বিচারিক হাকিম বিলাস চন্দ্র মণ্ডলের কাছে দেওয়া জবানবন্দি শেষে বৃহষ্পতিবার বিকেল ৫টার দিকে আদালত চত্বরে দেবহাটার কামটা গ্রামের মুরগি ব্যবসায়ি সাঈদুর রহমান রাজু(৩৮) এ প্রতিবেদককে বলেন, তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের জেরে রাবেয়াকে নির্যাতন করতো মনিরুল। ২৫ জুন সকালে মনিরুল তার স্ত্রী রাবেয়াকে মারপিট করলে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গাজীরহাটে তার(রাজু) দোকানে যায় রাবেয়া।

বিয়ে করতে হলে মনিরুলকে সরানোর কথা বলে রাবেয়া। সে অনুযায়ি ভাড়াটিয়া কিলার ঠিক করতে রাজুর কাছে রাবেয়া ৫০ হাজার টাকা চায়। তবে রাবেয়াকে অপর কেউ টাকা দিয়েছিল। সে অনুযায়ি ভাড়াটিয়া কিলার ও সে চলমান অবস্থায় ইজিবাইক চালক মনিরুলকে প্লাস্টিকের দড়ি দিয়ে পিছন দিক থেকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। এরপর যে যার মতো চলে যায়। ভাড়াটিয়া কিলারকে রাজু চিনতো না।

এদিকে একই সময়ে আদালত চত্বরে রাবেয়া এ প্রতিবেদককে জানায়, মনিরুল হত্যাকাণ্ডে রাজুর সঙ্গে যে হত্যাকাণ্ডে যে অংশ নিয়েছিল সে কালিগঞ্জের নলতার জনৈক রমজান আলী। সে রাজু’র ঘনিষ্ট। রাজুর দোকানে মাঝে মাঝে কাজ করতো। গত ২৫ জুন দিবাগত রাত ১২টার দিকে মনিরুলকে হত্যা করা হয়।

এদিকে গত মঙ্গলবার গভীর রাতে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য পরিচয়ে কালিগঞ্জের নলতা ইউনিয়নের সোনাটিকারী গ্রামের শহর আলী সরদারের ছেলে রমজান আলীকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। নিয়ে যাওয়া হয় রমজান ও তার স্ত্রী নাজমার ব্যবহৃত মুঠোফোন।

সরেজমিনে শুক্রবার দুপুরে সোনাটিকারী গ্রামে গেলে নাজমা খাতুন বলেন, তার স্বামী রমজান এক সময় বিদেশে থাকতো। সেখান থেকে ফিরে এসে ভাই আবফানের গ্রীলের দোকানে কাজ করতো। সুবিধা না হওয়ায় ঢাকায় যেয়ে ফলের ব্যবসা করতো। কয়েক মাস আগে ফিরে এসে আবারো ভাই এর দোকানে কাজ করতো। মাঝে মাঝে দেবহাটার কামটা গ্রামের সাঈদুর রহমান রাজু’র গাজীরহাটের মুরগির দোকানে কাজ করতো। কাজ করলে হাত খরচের টাকা দিত রাজু।

তবে রাজু এক নারীর সঙ্গে ছাড়াও বিশেষ বিশেষ লোকের সঙ্গে রমজানের মোবাইল ফোনে টাকা ভরে কথা বলতো। ২৫ জুন সন্ধ্যার পর রমজান তার মাকে নিয়ে নলতা পাক রওজা শরীফে এক মিলাদে যায়। রাত ৯টার দিকে মা ও ছেলে ফিরে আসে। রাত ১০টার পরপরই রাজু ফোন করে রমজানের মোবাইল ফোনে। বাইরে যেয়ে কয়েক মিনিট কথা বলার পর রমজান আর বাড়ি থেকে বের হয়নি। মঙ্গলবার গভীর রাতে রমজানকে আইনপ্রয়োগকারি সংস্থার লোক পরিচয়ে ধরে নিয়ে যায়। শুক্রবার বিকেল ৬টা পর্যন্ত দেবহাটা থানা, সাতক্ষীরা ডিবি পুলিশ, সদর থানাসহ বিভিন্ন স্থানে যেয়েও সন্ধান মেলেনি তার।

তবে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, রাবেয়ার দাবিকৃত ৫০ হাজার টাকা রাজু দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় সে মরিয়া হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে সে ক্ষমতাসীন দলের উপজেলা পর্যায়ের এক শীর্ষস্থানীয় প্রভাবশালী পুরাতন প্রেমিক নেতার শরনপন্ন হয়। সে অনুযায়ি কালিগঞ্জের মৌতলা এলাকায় রাবেয়ার এক আত্মীয়কে ডেকে কিলিং মিশনে অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ি রাজু ও রাবেয়ার ওই আত্মীয় দু’জনে মনিরুলকে হত্যা করে। ইজিবাইক ও মনিরুলের ব্যবহৃত একটি মোবাইল নিয়ে চলে যায় রাবেয়ার ওই আত্মীয়। তবে আইনপ্রয়োগকারি সংস্থার সদস্যরা রাবেয়ার ওই আত্মীয়কেও খুঁজে বেড়াচ্ছে।

তবে মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা দেবহাটা থানার পুলিশ পরিদর্শক উজ্জ্বল কুমার মৈত্র বলেন, ইজিবাইক ও মোবাইল উদ্ধারসহ আরো হত্যাকারিদের সন্ধান চালানো হচ্ছে। নিরাপরাধ কাউকে এ মামলায় জড়ানো হবে না।

প্রসঙ্গত, গত ২৬ জুন সকালে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার সখীপুর- দেবহাটা সড়কের কামটা গ্রামের মিঠুর মুরগির দোকানের সামনে থেকে শ্বাসরোধ করা মনিরুলের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই দিন রাতেই নিহতের ভাই আমিরুল ইসলাম বাদি হয়ে থানায় একটি হত্যা মামলা (৯ নং)দায়ের করে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আইনপ্রয়োগকারি সংস্থার সদস্য পরিচয়ে কামটা গ্রামের সাঈদুর রহমান রাজু, নিহত মনিরুলের স্ত্রী রাবেয়া খাতুন, রায়োর মা ফতেমা খাতুনকে ২৮ জুন আটক করে আইন প্রয়োগকারি সংস্থার লোকজন।

পরদিন রাতে শিমুলিয়া গ্রামের স্টেশনারী গুডস ব্যবসায়ি আরিফুর রহমান সুমন (৩৩), সাংবাড়িয়া গ্রামের মুদি ব্যবসায়ি আব্দুর রশীদ (৪৫) ও আশাশুনি উপজেলার বসুখালি গ্রামের বর্তমানে তার মামা দেবহাটার শিমুলিয়া গ্রামের জহুরুল ইসলামের বাড়িতে বসবাসকারি তার ভাগ্নে আব্দুর রাজ্জাক (৩৫) ও কালিগঞ্জ উপজেলার নলতা ইউনিয়নের সোনাটিকারী গ্রামের শহর আলী সরদারের ছেলে রমজানকে আটক করা হয়। পহেলা জুলাই বুধবার দুপুরে রাজ্জাক, রশীদ ও সুমনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ২ জুলাই রাবেয়া ও রাজু আদালতে মনিরুল হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকারে করে জবানবন্দি দেয়।

(আরকে/এসপি/জুলাই ০৩, ২০২০)