আন্তর্জাতিক ডেস্ক : পার্ক উন-সুন টানা নয় বছর ধরে সিউলের মেয়র, নিজ কর্মগুণে হয়ে উঠেছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর কর্মকর্তা। দেশটির আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীও ধরা হচ্ছিল তাকে। গত সপ্তাহে হঠাতই উন-সুনের নাটকীয় মৃত্যুতে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে দক্ষিণ কোরিয়া।

৬৪ বছর বয়সী জনপ্রিয় এ নেতা মানবাধিকার রক্ষায় লড়েছেন দীর্ঘদিন। দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রথম যৌন হয়রানি মামলার আইনজীবী ছিলেন তিনি। কিন্তু, মৃত্যুর পর আশ্চর্যজনকভাবে প্রশ্ন উঠেছে তারই চরিত্র নিয়ে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, পার্ক উন-সুনের বিরুদ্ধেই যৌন হয়রানির অভিযোগ ছিল। পুলিশও নিশ্চিত করেছে, এ নিয়ে একটি মামলা হয়েছিল সিউল মেয়রের বিরুদ্ধে।

গত বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশের কাছে উন-সুন নিখোঁজ হওয়ার খবর দেন তার মেয়ে। প্রায় সাত ঘণ্টা অনুসন্ধানের পর সরকারি বাসভবনের কাছেই পাওয়া যায় মেয়রের মরদেহ। তিনি কীভাবে মারা গেছেন তা নিশ্চিত করেনি কর্তৃপক্ষ, তবে হত্যাকাণ্ডের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন তারা।

শুক্রবার পার্কের লেখা একটি ছোট চিঠি দেখানো হয় স্থানীয় গণমাধ্যমে। এতে লেখা ছিল, ‘আমি সবার জন্য দুঃখিত। জীবনভর যারা আমার পাশে ছিলেন তাদের ধন্যবাদ। শুধু কষ্টই দেয়ার জন্য আমি আমার পরিবারের জন্য দুঃখিত।’

বর্ণাঢ্য কর্মজীবন

মৃত্যুর আগপর্যন্ত পার্ক উন-সুনকে অত্যন্ত কর্মঠ ও ব্যক্তিত্ববান নেতা হিসেবে মনে করা হতো। তিনি লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে আন্তর্জাতিক আইনে ডিপ্লোমা করেছেন। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির মানবাধিকার প্রোগ্রামের ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো ছিলেন উন-সুন।

সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রমে ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল এ নেতার। তরুণ বয়সে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পার্ক চুং-হি, যাকে সামরিক স্বৈরশাসক বলে মনে করেন অনেকে- তার বিরুদ্ধে মিছিল করে গ্রেফতার হয়েছিলেন উন-সুন। দক্ষিণ কোরিয়ায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক একাধিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন এ নেতা।

২০১১ সালে অরাজনৈতিক ব্যক্তি হয়েও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকে হারিয়ে সিউলের মেয়র নির্বাচিত হয়ে বড় চমক দেখান পার্ক উন-সুন। ধীরে ধীরে শহরটির উন্নয়ন ও সংস্কারের প্রতীক হয়ে ওঠেন তিনি। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকেই ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম মেয়র হিসেবে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার ইতিহাস গড়েন। ২০২২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অন্যতম প্রধান প্রার্থী হিসেবে মনে করা হচ্ছিল তাকে।

মৃত্যুর পর বিভক্ত দেশ

পার্ক উন-সুনের অকাল মৃত্যুতে মুষড়ে পড়েছেন সমর্থকেরা। স্থানীয় গণমাধ্যমের ভিডিওতে তার মরদের রাখা হাসপাতালের বাইরে বহু মানুষকে বিলাপ করতে দেখা গেছে।

তবে কারও কারও মনে ক্ষোভও আছে। অনেকের অভিযোগ, উন-সুন মারা যাওয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আর আমলে নেবে না দেশটির আদালত। দক্ষিণ কোরিয়ার আইন অনুসারে কোনও সন্দেহভাজন মারা গেলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার আর কোনও সুযোগ থাকে না, এ কারণে বন্ধ করে দেয়া হয় সব তদন্ত।

সিউলের মেয়র মারা যাওয়ার পর মাত্র একদিনের মধ্যেই প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ একটি আনুষ্ঠানিক পিটিশনে স্বাক্ষর করেছেন, যেন তার শেষকৃত্য আটকে দেয়া হয়। আগামী ১৩ জুলাই উন-সুনের শেষকৃত্য হওয়ার কথা।

তবে মেয়রের পরিবার জনগণকে সংযম দেখানোর অনুরোধ করেছেন। পাশাপাশি, এভাবে মানহানি চলতে থাকলে আইনি ব্যবস্থা নেয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।

চিত্রটা আরও বড়

দক্ষিণ কোরিয়ায় নারীদের যৌন হয়রানির অভিযোগ বহু পুরোনো। অনেকেই এটিকে কোরীয়দের নারীবিদ্বেষী মনোভাবের পরিচয় বলে মনে করেন।

অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) তথ্যমতে, বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ আত্মহত্যার হার দক্ষিণ কোরিয়ায়। দেশটিতে অহরহই বিনোদন তারকা, স্পোর্টস কোচ, শীর্ষ আইনজীবীর মতো হাই-প্রোফাইল ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠছে।

অভিযোগ থেকে বাদ নেই শীর্ষ রাজনীতিবিদরাও। গত বছরই সাবেক গভর্নর ও একসময়ের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী আন হি-জুং সাবেক সহকারীকে ধর্ষণের দায়ে তিন বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। চলতি বছরের শুরুতে বুসানের মেয়র ওহ কিও-ডন যৌন হয়রানির দায়ে পদত্যাগ ও ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন। এ দুই নেতাই প্রেসিডেন্ট মুন জা-ইনের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। সিএনএন।

(ওএস/এসপি/জুলাই ১৩, ২০২০)