স্বাস্থ্য ডেস্ক : করোনাকালে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৫ গুণ বেশি মানুষ বিষণ্নতাজনিত রোগে এবং দশ গুণ বেশি মানুষ উৎকণ্ঠাজনিত রোগে ভুগছেন। বিষণ্নতাজনিত সমস্যায় ভুগছেন ৩২ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ, যা ২০১৯ সালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ পরিচালিত একটি জরিপে ছিল মাত্র ৬ দশমিক ৭ শতাংশ।

একই সঙ্গে ৪৭ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ উৎকণ্ঠাজনিত রোগে ভুগছেন, যা আগে ছিল মাত্র ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা আর্ক ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক অনলাইন গবেষণায় এসব চিত্র দেখা গেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষদের তুলনায় নারীরা মানসিক সমস্যায় বেশি ভুগছেন। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী পুরুষদের ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ সামগ্রিক মানসিক সমস্যায় ভুগলেও নারীদের মধ্যে এর হার ৩৩ দশমিক ১ শতাংশ। অন্যদের তুলনায় শিক্ষার্থী ও বেকাররা বেশি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।

‘দ্য ম্যাগনিটি অব ডিপ্রেশন অ্যান্ড এংজাইটি ডিউরিং কোভিড-১৯ : অ্যান অনলাইন সার্ভে এমং এডাল্টস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক অনলাইন গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ পুরুষ ও ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ নারী। এর মধ্যে ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ চাকরিজীবী এবং ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। একইসঙ্গে গবেষণায় অংশ নেয়া ৭৫ শতাংশই রাজধানীতে বসবাস করেন।

শনিবার (১৮ জুলাই) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় অনলাইন মিটিং প্ল্যাটটফর্ম জুমে পরিচালিত ‌‘কোভিড-১৯ ও মানসিক স্বাস্থ্য’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে এই গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ প্রাইমারি হেলথ কেয়ারের সাবেক পরিচালক ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ড. খালেদা ইসলাম। আর্ক ফাউন্ডেশন ও সেন্টার ফর ল অ্যান্ড পলিসি অ্যাফেয়ার্স (সিএলপিএ) যৌথভাবে এই ওয়েবিনারের আয়োজন করে।

আর্ক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রুমানা হকের সঞ্চলনায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড হসপিটালের শিশু, কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. হেলাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘করোনা মহামারির মধ্যে মানসিক সমস্যা বেড়েছে। সবাই এই সমস্যায় না ভুগলেও অনেকের মধ্যেই নমুনা দেখা যাচ্ছে। এই সময়টাতে এক ধরনের অনিয়ম তৈরি হয়েছে। তরুণরা রাতে ঘুমাচ্ছে কম, এতে তাদের মধ্যে এক ধরনের খিটখিটে স্বভাব তৈরি হচ্ছে। এ সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে হলে অন্যান্য রোগের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি দরকার। মানসিক রোগ নয় মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যার মানসিক স্বাস্থ্যের আঞ্চলিক অ্যাডভাইজার ড. নাজনীন আনোয়ার বলেন, ‘করোনার এ সময়ে বিশ্বব্যাপী মানসিক রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তাদের মধ্যে নানা ধরনের বিষণ্নতা তৈরি হচ্ছে। করোনা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়ে কাজ করছে। এ জন্য আমাদের প্রচুর তথ্য প্রয়োজন। মানুষের কীভাবে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা কমিয়ে আনা যায় আমরা তার জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি।’

ওয়েবিনারে ইউনিসেফের হেড কোয়ার্টারে কর্মরত এইচআইভি ও এইডস বিশেষজ্ঞ লাজিনা মুনা বলেন, ‘গবেষণায় মানসিক স্বাস্থ্যের যে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে তা আসলেই উৎকণ্ঠার। সবসময়েই নারী এবং তরুণরা মানসিক সমস্যায় বেশি ভোগেন। রাষ্ট্র, পরিবার, সমাজের সবার উচিত তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দেয়া। সারাবিশ্বেই করোনার কারণে এ সমস্যা ক্রমেই বাড়ছে। আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে মানুষকে সহায়তা করা যায়। আশা করি এ সমস্যা থেকেও মুক্তি পাব।’

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টর জেনারেল অধ্যাপক এএইচএম এনায়েত হুসাইন বলেন, ‘আমরা সবাইকে করোনার বার্তা ভালোভাবে পৌঁছাতে পারছি না। সবাইকে বলছি আপনারা ঘরে থাকুন। কিন্তু তারা যে বাসায় থেকেও জরুরি প্রয়োজনে এক ঘণ্টার শরীর চর্চার জন্য নিরাপদে বাইরে যেতে পারে সেটার নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। ফলে এ সময় নানা কারণেই মানসিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো থেকে বের হবার পথ সাধারণ মানুষ জানে না।’

সেন্টার ফর ল অ্যান্ড পলিসি অ্যাফেয়ার্সের সেক্রেটারি ও নীতি বিশ্লেষক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, ‘আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক যে আইন আছে সেটি মানসিক সমস্যা হওয়ার পর কী হবে তা নিয়ে। মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয় তেমন নেই। মানসিক রোগের আইন কাঠামো সংস্কার দরকার। লোকাল গভর্নমেন্ট আইনে কোথাও মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বলা নেই। স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, পারিবারিক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট আইনসহ অন্যান্য আইনে পরিবর্তন করে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়সমূহ যুক্ত করতে হবে।’

(ওএস/এসপি/জুলাই ২০, ২০২০)