ব্যারিস্টার আহমেদ মাহবুবুল হক খান :

এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় ?

এমন যোগ্য সমাধি কই ?

মৃত্তিকা বলো , পর্বত বল

অথবা সুনীল সাগর জল

সব কিছু ছেঁদো , তুচ্ছ শুধুই

তাইতো রাখিনা এ লাশ আজ

মাটিতে পাহাড়ে কিংবা সাগরে ,

হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাই ।

-হুমায়ুন আজাদ

মুক্তিযুদ্ধের পর অনেক বন্ধু রাষ্ট্র ও বঙ্গবন্ধুর অনুরাগী রাষ্ট্র প্রধান তাকে বহুবার সাবধান করেছিলেন, সতর্ক করেছিলেন সম্ভাব্য অনেক বিপদ সম্পর্কে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কোনবারই সেগুলো আমলে নেন নি। তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তান জেলখানা থেকে যখন বেরুতে পেরেছি, তখন নিজের দেশের জল্লাদদের এড়াতে পারবো। এই ‘এড়ানো’ কে তিনি পাশ কাটিয়ে যাওয়া বোঝাননি বরং এই মনোভাব তার আপষবিমুখতা ও অসামান্য সাহসের কথাটাই জানিয়ে দেয় । কিন্তু তিনি পারেননি জল্লাদদেরকে এড়াতে। সাহস নিয়েই মুখোমুখি হয়েছেন , নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন তাদের হাতেই , যাদের কে স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য দুই দুই বার প্রায় ঝুলেছিলেন ফাঁসির দড়িতে ।

পাকিস্তানি শাসন আমলে বঙ্গবন্ধু তার শত্রু কে চিনতে ভুল করেননি । তখন তার শত্রু ছিল রাষ্ট্র । আর তার মিত্র ছিল জনগণ , বিশেষ করে সাধারন খেটে খাওয়া মানুষ ও মধ্যবিত্ত শ্রেনী । মধ্যবিত্তের সবাই যে তার সংগে এসেছিল তা নয় । যারা প্রতিষ্ঠিত ছিল , নানা রকম সুযোগ সুবিধা পেয়েছিল বা যাদের আরো পাবার আশা ছিল তারা প্রথমে আসেনি তার সাথে , এসেছিল অনেক পরে আর তখনই বঙ্গবন্ধু হয়েছিলেন অপ্রতিরোধ্য ।

কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্র আর তার শত্রু রইলো না । তিনিই তখন রাষ্ট্রের প্রধান । তিনি চেয়েছিলেন পাকিস্তানি পুঁজিবাদী আমলাতান্ত্রিক ভাবধারা থেকে বের হয়ে আসতে । বঙ্গবন্ধু চেষ্টা করেছেন । কিন্তু পারেন নি রাষ্ট্রের চেহারাটাকে সম্পূর্ণ বদলে দিতে । বরং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই পুঁজিবাদী আমলাতান্ত্রিক চেহারা ফিরে আসতে শুরু করলো খুবই দ্রুত গতিতে । আর এই সুযোগে মধ্যবিত্তের একটি অংশ রাষ্ট্রের সব সুযোগ সুবিধা কুক্ষিগত করতে থাকলো , হয়ে উঠলো ঘুসখোর অফিসার , বিদেশী এজেন্ট , মজুদদার , চোরাকারবারী , কালোবাজারি । বঙ্গবন্ধু যাদের কে তার অনুনকরনীয় ভাষায় বলতেন “ চাটার’’ দল । বঙ্গবন্ধু তাদের কে দমন করতে চাইলেন । তখন তারা আর বঙ্গবন্ধুর মিত্র রইলো না , পরিণত হলো শত্রুতে ।

কিন্তু এবার বঙ্গবন্ধু তার নিজের দেশের এইসব শত্রু কে চিনতে ভুল করলেন ।এই শ্রেণীটি বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে ফেললো একটি বিত্তের মধ্যে । পাকিস্তানি শাসকরা বহু বার তাকে আটক করেছে কিন্তু বন্দি করতে পারেনি । তিনি সারাজীবন থেকেছেন জনগণের সাথে । জনগণও ছিল তার সাথে । সুবিধাবাদী এই শ্রেনী তাকে বিচ্ছিন্ন করলো জনগণ থেকে যারা ছিল তার প্রধান শক্তি। আমরা বাকশাল বলি বা দ্বিতীয় বিপ্লব বলি, অনিবার্য হলেও, সবই ছিল বন্দি মানুষের পদক্ষেপ । তাইতো বাকশাল গঠনের প্রারম্ভিক ভাষনে তিনি তার সহকর্মীদের উদ্দেশে বলেছিলেন ‘ আমার কাজ আমি করেছি , এবার আমাকে ছুটি দাও ।

পচাত্তরের ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুর জনগণের সাথে বিছিন্নতার এই সুযোগ নিয়েছে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও দেশীয় বিশ্বাসঘাতকদের সহযোগিতা নিয়ে । অতর্কিতে আঘাত করেছে । সপরিবারে তিনি নিহত হয়েছেন । পাকিস্তানি শাসকরা তাকে হাতের মুঠায় পেয়েও আঘাত করবার সাহস সঞ্চয় করতে পারে নি । কারন তারা জানতো যে , বঙ্গবন্ধুর সাথে লক্ষ কোটি মানুষ আছে । মানুষের সেই বিক্ষোভের মুখে তারা দাঁড়াতে পারবে না , বরং তারা নিজেরাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে । হানাদাররা যে সাহস করেনি , বাংলাদেশী দুর্বৃত্তরা সে সাহস করেছে । তারা সঠিক ধারনাই করেছিল যে জনগণকে তারা নিয়ন্ত্রনে আনতে পারবেন । ওদিকে বঙ্গবন্ধু যাদের জন্য অত করেছেন , তারাও সাড়া দিল না , বেড়িয়ে এলো না রাজপথে , রুখে দাড়ালো না সাহস করে । ঘাতকরা জানতো তার অনুসারীরা আর যোদ্ধা নাই , অনেকেই রীতিমত দুর্বৃত্ত ও ষড়যন্ত্রকারী । তাই বড় কোন প্রতিরোধ তো গড়ে তোলেই নি বরং অনেকেই তো চলে গেছে ঘাতকদের সাথে । দেশের রাষ্ট্রপতি আক্রান্ত হয়েছেন , সেনা বাহিনী , বিমান বাহিনী , নৌ বাহিনীর সদস্যরা চুপচাপ বসে থেকেছেন , পুলিশ বা রক্ষী বাহিনীর কোন সদস্য একটি গুলি পর্যন্ত ছোঁড়ে নি । দায়িত্বে অবহেলার বিচার তো কারো হয়নি , বিভাগীয় ইঙ্কোয়ারী হয়েছে বলেও শুনিনি ।যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল । তারা বহাল তবিয়তে ছিলেন , এখনও আছেন । আইন পাশ হয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করা যাবে না । খুনিদের পুরস্কৃত করা হয়েছে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে চাকরী দিয়ে । যারা করেছে তাদের কেউ কেউ তো আওয়ামী লিগের নেতা ও বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষ ছিল । এখনও দেখা যাচ্ছে এক সময়ের বঙ্গবন্ধুর, আওয়ামী লিগের চরম বিরোধীতাকারীগন মন্ত্রীসভার সদস্য হয়ে শেখ হাসিনার কাছাকাছি থাকছেন । বিপদ এলে তাদের অবস্থান কি হবে তা ভবিষ্যতই বলে দেবে ।

বঙ্গবন্ধু জনগণের নেতা ছিলেন । তার মত জনপ্রিয়তা এবং জনগণের ভালোবাসা বাংলার ইতিহাসে অন্য কোন নেতা পাননি, আর ভবিষ্যতে পাবে বলে মনে হয় না । তিনি সবসময় থেকেছেন জনগণের সাথে । ১৯৫৭ সালে মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে আওয়ামী লিগের সাধারন সম্পাদক হয়েছেন । তিনি জনগন কে ভালবেসেছেন তার নিজের মত করে । পচাত্ত্ররের জানুয়ারী মাসে তার সংসদীয় বক্তৃতায় তিনি গরীব মানুষের দুঃখের কথা বর্ণনা করেছেন মর্মস্পর্শী ভাষায় । নিজের অক্ষমতাকে স্বীকার করে জনগণের কষ্ট বুঝে আকুতি নিয়ে তিনি বলেছিলেন “ আমাদের দেশের দুঃখী মানুষ না খেয়ে কষ্ট পায় । তাদের গায়ে কাপড় নেই । শিক্ষার আলো তারা পায় না । রাতে একটু হারিকেন জ্বালাতে পারে না । নানা অসুবিধায় তারা । তাদের প্রতি আমরা কতটুকু দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি । তিনি সমালোচনা করেছেন শিক্ষিত সমাজের মানুষদের কে । তিনি বলেছেন , বাংলার গরীব ভালো , বাংলার কৃষক ভালো , বাংলার শ্রমিক ভাল । যদি কেউ খারাপ হয় , তবে খারাপ আমরা , তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ । যত গোলমালের মূলে তারাই । যত অঘটনের মূলে তারা । কারন তারা ভোকাল শ্রেনী । তারা বক্তৃতা করেন , তারা কাগজে লিখেন । তারা এখানে এটা করেন ওখানে ওটা করেন । এ অবস্থায় দেশ চলতে পারে না । এ কে ফজলুল হক এদের বলতেন ব্যাঙের দল , কেবল লাফায় । বঙ্গবন্ধু এদের কে সায়েস্তা করতে চেয়েছিলেন , টুটি চেপে ধরতে চেয়েছিলেন চোরাকারবারি , কালোবাজারীদের । সময় চেয়েছিলেন জনগণের কাছে । কিন্তু সময় তাকে দেয়নি চাটার দল , তাদের পক্ষের ঘাতকেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার উপর কয়েক মাসের মধ্যে । ঘাতকরা তো তার আশেপাশেই ছিল , সংসদে ও দলের মধ্যে ।

বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি দেশ গড়াতে চেয়েছিলেন যার ভিত্তি হবে – বাঙালি জাতীয়তাবাদ , ধমনিরপেক্ষতা , গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র । দেখেছিলেন জনগণকে সংগে নিয়ে দারিদ্র্য , ক্ষুধা , অভাবমুক্ত স্বনির্ভর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন ।তাকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে । যারা তাকে থামিয়ে দিয়েছে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আদৌ বিশ্বাস করতো না । রাষ্ট্রকে তারা চালিত করতে চেয়েছিল বিপরীত দিকে । জয় বাংলার বদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ , বাংলাদেশ বেতারের জায়গায় রেডিও বাংলাদেশ , খন্দকার মোস্তাকের টুপিকে জাতীয় টুপি ঘোষনা- এগুলো ছিল একটি দৃষ্টি ভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ । ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ তাদের জন্য অসহ্য ছিল । তারা চেয়েছিল ভিন্ন নামে আরেকটি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ।

বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মাঝে নেই , কিন্তু তিনি আছেন প্রতিটি বাঙ্গালীর হৃদয়ে । তার মহান কৃতি বাঙ্গালী স্মরণ করবে কৃতজ্ঞ চিত্তে যতদিন বাংলাদেশ থাকবে । যত দিন যাবে, ততই উজ্জ্বল ও স্পষ্ট হবে জাতীয় ইতিহাসে তার ভুমিকা । কোন ষড়যন্ত্রই পারবেনা তার স্থান থেকে তাকে বিচ্যুত করতে ।যারা সত্যিকারের বঙ্গবন্ধুর আনুরাগী তাদের কাজ যেখানে তাকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে জনগনের সাথে থেকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া ।

লেখক : এডভোকেট , বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট.