আবীর আহাদ


ইতিহাসের অনন্য উচ্চতায় আওয়ামী লীগ নেতাদের অবস্থান হলেও তারা মনে হয় রাজাকারদের প্রতি মানসিকভাবে দুর্বল ! তারা হয়তো মনে করতেন যে, রাজাকাররা বনেদি ও ধনাঢ্য পরিবারের লোক । তাদের বংশমর্যাদা ও সম্মান তাদের থেকে অনেক উঁচুতে ! সে-কারণেই স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের হাত থেকে রাজাকারদের রক্ষা করতে আওয়ামী লীগ নেতারা মরিয়া হয়ে কাজ করেছে । অনেক ক্ষেত্রে তারা রাজাকারদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তুলেই ক্ষান্ত হয়নি, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে তাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ করে দিয়েছে । রাজনৈতিক কারণে যুদ্ধাপরাধের বিচার করে তাদের মধ্যকার হাতেগণা কয়েকজনকে শাস্তি দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজাকারবিরোধী অবস্থান দেখানো হলেও তারা অন্যান্য সবদিক দিয়ে রাজাকারদের নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতাই করে আসছে । তারই ধারাবাহিকতায় রাজাকার পরিবারের সদস্যরা ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি-রাজনীতিসহ সবখানে পোক্ত অবস্থানে রয়েছে ।

আজ আওয়ামী লীগ ও তার সবক'টি সহযোগী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে রাজাকার শাবকরা ঠাঁই পেয়েছে । রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সর্বত্র এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদেও রাজাকারের বাচ্চাদের দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ! তাদের কনুইয়ের ধাক্কায় প্রকৃত আওয়ামী লীগার ও মুক্তিযোদ্ধারা ছিটকে পড়েছে । অর্থাত্ আওয়ামী লীগের রাজাকার-প্রীতির যূপকাষ্ঠে এখন আওয়ামী লীগ রাজাকারি আদর্শের মধ্যে ডুবে গেছে । আওয়ামী লীগের রাজাকার-প্রীতির আরেকটি দিক হলো, রাজাকাররা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল-----তারা গিভ এণ্ড টেক ভালো বোঝে । তাইতো তাদের নিকট থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে তাদেরকে বেহিসেবিভাবে দলে ও সরকারে ঠাঁই দিয়েছে । তারই ফলশ্রুতিতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজ ভুলুণ্ঠিত । রাজাকারি আদর্শের মধ্য দিয়ে জন্ম-নেয়া দুর্নীতিবাজ লুটেরা মাফিয়ারাই এখন আওয়ামী লীগের বন্ধু ! মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ও মুক্তিযোদ্ধরা আজ তাদের কাছে হয়ে পড়েছে অপাঙ্ক্তেয় ।

রাজাকারের বাচ্চাদের আওয়ামী লীগের আনুকূল্যে রাষ্ট্রীয় অবস্থান শক্তিশালী হওয়ার পর, তারা এখন মুক্তিযুদ্ধে তাদের রাজাকার বাপ-দাদা-চাচা-শ্বশুরসহ নিকটাত্মীয়দের মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পাদানি মার ও লাঞ্ছিত হওয়া এবং ন্যক্কারজনক পরাজিত হওয়ার মনোপীড়ায় তাড়িত হয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের ওপর নানাভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে । সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আজ মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারবর্গের ওপর হত্যা, অত্যাচার, লুটতরাজ, জায়গা জমি দখল, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নানান কটূক্তি করে যাচ্ছে ।

একনাগাড়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার অন্ধ অহমিকায় আজ আওয়ামী লীগ অতীতের বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের সম্পূর্ণ ভুলে গেছে । ৭২ থেকে ৭৫ এবং ৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনামলে একশ্রেণীর দলীয় নেতা-কর্মী, এমপি-মন্ত্রীদের দুর্নীতি ও লুটপাট-----অপরদিকে দেশি-বিদেশি স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির নানাবিধ ষড়যন্ত্র প্রভৃতি কর্মকাণ্ডের কারণে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চারনেতা নির্মমভাবে নিহত ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হন । ঐ সমস্ত কর্মকাণ্ড ও চক্রান্তের ফলে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের ইমেজ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যেমন সেই হৃত-ইমেজ পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা চালিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়েছে----তার পশ্চাতে কেবলই আওয়ামী লীগের অবদান নয়, তার পশ্চাতে মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী, লেখক-কবি-সাংবাদিক, সংস্কৃতিসেবী প্রভৃতি পেশার লোকজনেরও জীবনপণ বিপুল অবদান রয়েছে ।

সেসময় লেখালেখি ও নানান সাংগঠনিক তথা সভা-সমাবেশ-মিছিল, আলোচনা ও মতবিনিময় সভা, সংবাদ সম্মেলন প্রভৃতি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আমিও আমার জীবন বিপন্ন করে ও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার অভিযুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের ইমেজ পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রেখেছিলাম----যেটি এভাবে এখানে বলতে আমার নিজেরই খারাপ লাগছে । আজ অতি দু:খ ও পরিতাপের সাথে বলতে হয়, আওয়ামী লীগ আমাদের সবার সম্মিলিত অবদানকে অস্বীকার ও ভুলে গিয়ে, তাদেরকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে যাদের বিন্দুমাত্র অবদান নেই, বরং যারা নানাভাবে বিরোধিতাসহ বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের ইমেজ ধ্বংসের কাজ লিপ্ত ছিলো তাদেরকেই তারা জামাই আদরে দলে ও সরকারে ঠাঁই দিয়েছে ! আর এখন তো বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে যোজন যোজন দূরে সরে এসে তারা সরাসরি স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার শাবক এবং দেশের কুখ্যাত সব দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের দলে ও সরকারে ঠাঁই দিয়েছে ।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ও আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিতপ্রাণ সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ী হিশেবে এভাবে তাকে মণ্ডিত করতে হবে, এভাবে লিখতে গিয়ে আমাকে তাদের রোষানলে পড়তে হবে তা আসলেই ভাবতে পারি না । তারপরও বলে যাচ্ছি, অবিরাম লিখে যাচ্ছি----যদি তারা এ-থেকে কিছুটা শিক্ষা নিয়ে আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম, আত্মোপলব্ধি ও আত্মশুদ্ধির পথ বেছে নেন ।

লেখক :লেখক, গবেষক, চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।